কোটা রামাস্বামী: ক্রিকেট-টেনিস এবং নিখোঁজ

১৮৯৬ সালের ১৬ জুন। মাদ্রাজ ক্রিকেটের জনক বলে পরিচিত বুচি বাবুর ঘরে আজ বড় আনন্দের দিন।

তার ঘর আলো করে এসেছে তৃতীয় ছেলে। ছেলের নাম রাখা হলো রামাস্বামী; যিনি পরবর্তীতে পরিচিত হন কোটা বা কোটাহ রামাস্বামী নামে। যদিও তার নামের প্রথম অংশের ব্যাপারে কেউই নিশ্চিত হতে পারেননি।

রামাস্বামীর পুরো জীবনটাই আসলে এমন রহস্যে ঘেরা। ভারতের ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে টেনিস ও ক্রিকেটে ভারতের জাতীয় দলে খেলেছেন। এতেই তার কিংবদন্তি হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু রামাস্বামী এরপর হারিয়েই গেলেন। মানে, কথার কথা নয়। হঠাৎ করেই দুনিয়া থেকে হারিয়ে গেছেন। তারপর এই কিংবদন্তি খেলোয়াড়ের কী হয়েছে, কেউ জানে না। উইজডেন বলে, মিসিং। আর ভারতীয়রা বলে সন্নাসী হয়ে গেছেন।

রামাস্বামী জন্মেছেন ভারতের প্রবাদ হয়ে যাওয়া এক ক্রীড়া পরিবারে। বাবা বুচি বাবু মাদ্রাজ ক্রিকেটের পুরোধা ছিলেন। বাকী দুই ভাই এবং চার ভাইপো প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট খেলেছেন।

ছোটবেলা থেকেই খুব চঞ্চল ছিলেন সবার ছোট রামাস্বামী। বড় দুই ভাইকে ক্রিকেট খেলতে দেখে ছোটবেলাতেই ক্রিকেটের প্রেমে মজে যান তিনি। ওয়েসলি হাই স্কুলে পড়ার সময়ই নিজের সহজাত ক্রিকেট প্রতিভার জানান দেন তিনি। এক ম্যাচে তার দল ৫০ রানে ৯ উইকেট হারিয়ে ফেললে শেষ উইকেটে তিনি ২০০ রান যোগ করেন যেখানে তার একাই অবদান ছিল ১৮৮!

১৯১৫-১৬ মৌসুমে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয় রামাস্বামীর। নিজের প্রথম ম্যাচে মোটামুটি ভালোই খেলেন তিনি। দুই ইনিংসে ২১ ও ৩১ রান করার পাশাপাশি ২৪ রানে নেন দুই উইকেট। পরের মৌসুমেই এক ম্যাচে ৯২ ও ৪৪ রান করার পাশাপাশি ১২৬ রানে নেন ছয় উইকেট। কিন্তু ১৯১৯ সালে রামাস্বামী ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলে ক্রিকেটজীবনে ছেদ পড়ে।

রামাস্বামী ১৯২৩ সাল পর্যন্ত ক্যামব্রিজে পড়ালেখা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে ডোহার্টি কাপ টেনিসে অংশ নেন। সিঙ্গেলসে অংশ নেন ১৯১৯ সালেই। পেয়ে যান ক্যামব্রিজের হাফ ব্লু, ২০২১ সালে ডাবলস জিতে পূর্ণাঙ্গ ব্লু পান রামাস্বামী।

সেখানে পড়াকালীন সময়েই তিনি টেনিস খেলা শুরু করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে নেদারল্যান্ডস সফরে ভালো করার দরুণ ডেভিস কাপের দলে ডাক পান। ডেভিস কাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই ভারত রোমানিয়াকে ৫-০ ব্যবধানে হারায়। রামাস্বামী ডা: হাসান আল ফাইজির সাথে জুটি বেঁধে ৬-২, ৬-৪, ৬-০ ব্যবধানে নিকোলাস মিসু এবং মিসু স্টার্নের বিপক্ষে জয় পান।

সে বছরের শেষের দিকে হওয়া উইলম্বডন ওপেনেও অংশ নেন তিনি। প্রথম রাউন্ডে ব্রিটেনের উইসেস উইলিয়ামকে হারিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠলেও ডেভিস কাপে হারানো নিকোলাস মিসুর কাছে হেরে যান। পরের বছরের ডেভিস কাপেও ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। ডাবলসে ডা: ফাইজির সাথে মিলে স্পেনের এদুয়ার্দো ফ্লাওকার এবং ম্যানুয়েল গোমারের বিপক্ষে ৩-৬, ৭-৫, ১১-৯, ৮-১০, ৬-৪ ব্যবধানে জিতলেও বাকিদের ব্যর্থতায় ভার‍ত টাইব্রেকারে ৪-১ এ হেরে যায়।

ক্যামব্রিজে পড়ালেখা শেষ করে রামাস্বামী ভারতে ফিরে কৃষি বিভাগে অফিসার হিসেবে চাকরি শুরু করেন। পাশাপাশি মাদ্রাজের হয়ে রঞ্জি ট্রফিতেও নিয়মিত খেলতে শুরু করেন তিনি। রঞ্জি ট্রফির ইতিহাসের প্রথম ম্যাচে মাইশুরের বিপক্ষে ২৬ রান করেন তিনি। হায়দ্রাবাদের বিপক্ষে চতুর্থ ইনিংসে ম্যাচজয়ী অপরাজিত ৩৫ রানের ইনিংস খেলার পর জ্যাক রাইডারের অস্ট্রেলিয়া দলের বিপক্ষে ডাক পান। অজিদের বিপক্ষে ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ৪৮ রান করেন তিনি। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসেই নিজের প্রতিভার জানান দেন তিনি।

২৫ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ভারত যখন কাঁপছে তখন ব্যাট হাতে ত্রাণকর্তার ভূমিকায় আবির্ভূত হন রামস্বামী। ৮২ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেন তিনি যদিও বাকিদের ব্যর্থতায় ভারত অলআউট হয় ১৬৫ রানে। তবে তার সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয় যখন অস্ট্রেলিয়া পাগলাটে ৭৭ রানের শেষ উইকেট জুটিতে ম্যাচ জিতে যায়।

১৯৩৬ সালে ৪০ বছর বয়সে ইংল্যান্ডগামী ভারত দলে ডাক পান তিনি। ল্যাঙ্কশায়ারের বিপক্ষে একমাত্র প্রস্তুতি ম্যাচে অপরাজিত ১২৭ এবং ৭৮ রানের ইনিংস খেললেও লর্ডসে প্রথম টেস্টের দলে জায়গা পাননি তিনি। ব্যাটিং ব্যর্থতায় লর্ডস টেস্ট হারার পর ওল্ড ট্রাফোর্ডে দ্বিতীয় টেস্টে অভিষেক হয় তার। অভিষেকের সাথে সাথে ইতিহাসের পাতায় নাম উঠে যায় তার, মাত্র দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে এমজে গোপালান (ক্রিকেট এবং হকিতে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন) এর পর দুইটি খেলায় ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন।

এছাড়াও রুস্তমজি জামশেদজির পর দ্বিতীয় বয়স্ক ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেক ঘটে তার। নিজের প্রথম টেস্টেই ব্যাটিংয়ে দারুণ মুন্সিয়ানা দেখান তিনি। হেডলি ভ্যারিটি, ওয়াল্টার রবিন্স, গ্যাবি অ্যালেনের মতো বোলারদের সামলে ৪০ এবং ৬০ রানের দারুণ কার্যকরী দুইটি ইনিংস খেলেন। যদিও ম্যাচটি পরিচিত হয়ে আছে দ্বিতীয় ইনিংসে বিজয় মার্চেন্ট এবং মুশতাক আলির ২০৩ রানের উদ্বোধনী জুটির জন্য।

প্রথম টেস্টে তিন নম্বরে নেমে দারুণ ব্যাটিং করার পরও পরের টেস্টে তাকে পাঁচ নম্বরে ব্যাট করতে পাঠানো হয়। প্রথম ইনিংসে ২৯ রান করার পর দ্বিতীয় ইনিংসে তাকে আট নম্বরে ব্যাট করতে পাঠানো হয়! ২২২ রানে ছয় উইকেট পড়ার পর ব্যাট করতে নেমে সিকে নাইডুর সাথে ৭৩ রানের জুটি গড়েন তিনি। ৩১২ রানে ভারত যখন অলআউট হয় তখন অন্যপ্রান্তে ৪১ রানে অপরাজিত ছিলেন রামস্বামী।

এই দুই টেস্ট খেলেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ইতি টানেন রামাস্বামী। চার ইনিংসে ৫৬.৬৭ গড়ে ১৭০ রান সংগ্রহ করেন তিনি। তার ব্যাটিং গড় টেস্ট ক্রিকেটে ভারতীয়দের মধ্যে চতুর্থ সর্বোচ্চ। জাতীয় দলে না খেললেও মাদ্রাজের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে যান ১৯৪১-৪২ মৌসুম পর্যন্ত। ৪৬ বছর বয়সে এসেও ১৯৩৯-৪০ মৌসুমে ইউরোপিয়ানদের বিপক্ষে নয় চার এবং দুই ছয়ে ১০৫ রান করেন তিনি।

অবসরের পরও মাদ্রাজ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সাথে যুক্ত ছিলেন কোটা রামাস্বামী। ১৯৫২-৫৩ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরকারী ভারতীয় দলের ম্যানেজার ছিলেন তিনি। এই দশকের শেষের দিকেই ভারতীয় দলের নির্বাচক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর আশ্চর্যজনক এক ঘটনা ঘটে যায়। ঘুম থেকে উঠার পর তার পরিবারের লোকজন খেয়াল করে তিনি বাড়িতে নেই। এরপর যেন স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে যান তিনি, আর কখনোই তার দেখা পাওয়া যাননি। রেকর্ড বইতে তাকে ‘সম্ভাব্য মৃত’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।

কয়েকবার করে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে তাকে দেখা গেছে বলে দাবি করা হয়। ফলে তার মৃত্যুর কোনো তারিখ নথিভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে নব্বই দশকের শুরুতে মেনে নেওয়া হয় যে, রামাস্বামী আর বেচে নেই।

সবমিলিয়ে ভারতীয় খেলাধুলার ইতিহাসের আজব এক চরিত্র ছিলেন রামাস্বামী। তার নামের প্রথম অংশের ইতিহাস জানা যায়নি, দুই খেলায় দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, দ্বিতীয় বয়স্ক ভারতীয় ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট অভিষেক, টেস্টে ভারতীয়দের মাঝে চতুর্থ সর্বোচ্চ গড় এবং সর্বোপরি কেউ জানে না কখন-কোথায় তিনি মারা গেছেন; হয়তো পৃথিবীর অনেক অমীমাংসিত রহস্যের মতো তার অন্তর্ধানও রহস্যই থেকে যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link