ক্রিকেটে ব্যাটিং যদি কোন মাপকাঠি হয় তবে ভারতীয় ক্রিকেটকে নির্দ্বিধায় দু ভাগে ভাগ করা যায়। সুনীল গাভাস্কার পূর্ববর্তী এবং গাভাস্কার সমসাময়িক ও পরবর্তী যুগ। বিশ্বক্রিকেটে ভারতের ব্যাটসম্যানদের যে সুনাম, সেটা মূলত এই দ্বিতীয় ভাগের জন্য।
আর নয় নয় করে এ যুগের বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেল। এই পঞ্চাশ বছরে বিদেশের মাঠে ভারতীয় ক্রিকেটকে কাটাছেঁড়া করতে বসলে (প্রধানত লাল বল ক্রিকেট) যেটা উঠে আসবে সেটা হলো বিদেশে বহু ম্যাচে ভারত জয় পায়নি একই সঙ্গে একই ম্যাচে ব্যাটিং এবং বোলিংটা সর্বোচ্চ মানের না করতে পারায়।
কোনো ম্যাচে ব্যাটিং ইউনিট ভালো খেলেছে তো কোনো ম্যাচে বোলিং। আর নব্বই এর শুরু থেকে বিষয়টা অনেকটা এরকম হয়ে দাঁড়ায় ব্যাটসম্যানরা রান করে গেছে কিন্তু বোলাররা ঠিক সময়ে পারফর্ম না করতে পারায় ম্যাচের ফল ভারতের পক্ষে আসেনি। বিশেষত ইংল্যান্ডের মাটিতে।
ভারতীয় ক্রিকেটের এই গৌরবময় ব্যাটিং এর পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসকে আবার দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। গাভাস্কার যুগ এবং গাভাস্কার পরবর্তী যুগ। এই দ্বিতীয় ভাগের অধিকাংশ জুড়ে রয়েছেন শচীন টেন্ডুলকার। এই সময়ের প্রতিটা ইংলিশ সফর বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে যে ১৯৯০এর এর সফর থেকে ২০০৭ পর্যন্ত প্রতিটা দল এবং ২০১১’র রাহুল দ্রাবিড় ইংল্যান্ডের মাটিতে ব্যাট হাতে চূড়ান্ত ভাবে সফল। তার যদি আরও আগে যাই অর্থাৎ ১৯৮৬, যেবারে ষোল বছর পরে ভারত টেস্ট সিরিজ যেতে ওই দেশে সেবারেও ব্যাটিংটা বেশ সফল ছিল।
দিলীপ ভেঙসরকার একা দুটি শতরান করেন। পরের সফরে শাস্ত্রী-আজহারের দুটি করে, শচীন-কপিলের একটি করে শতরান। ১৯৯৬ এ শচীন-সৌরভ দুজনেরই দুটি করে শতরান। ২০০২ এ তো শচীন-সৌরভ-দ্রাবিড় স্বপ্নের ছন্দে, সঙ্গে শেহবাগ। ২০০৭এও ব্যাটিং ইউনিটের অসাধারন পারফর্মেন্স। এই সময়কালে ভারতীয় বোলাররা যদি একটু ধারাবাহিক হতে পারতেন, ইংল্যান্ডের মাটিতে ভারতের আরও অনেক বেশি টেষ্ট জয় থাকতো।
২০১১ সালেও দ্রাবিড় চারটে শতরান করে এসেছেন। অর্থাৎ প্রায় তিরিশ বছর ধরে ইংল্যান্ডের মাটিতে ভারতীয়রা ব্যাট হাতে প্রায় রাজত্ব করে গেছেন। কোন ধরনের স্যুইং বোলিং দিয়েই তাদের কাবু করা যায়নি। এঁরা প্রত্যেকেই যে টেকনিক্যালি একশ শতাংশ সঠিক ভাবে স্যুইং এবং সিম বোলিং সামলাতেন তা নয়, কিন্তু প্রয়োগ ক্ষমতা বা বিশেষ একটা প্রয়োগ দক্ষতা ছিল যা তাঁদের এখানে ব্যর্থ হতে দেয়নি।
এই সুদীর্ঘ তিরিশ বছরে ভারতীয়রা এখানে ইনিংস প্রতি ৩৩৭.৬৭ রান করেছেন, ২০১১ এর চূড়ান্ত ব্যর্থ সফর ধরে। আর ২০১১’র সফর বাদ দিলে এই রানটা হয় ইনিংস প্রতি প্রায় ৩৮০। যেটা শেষ দুটি সফরে (প্লাস সাউদাম্পটন) কমে ২৭৩ এ এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ইংল্যান্ডের মাটিতে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের স্বর্ণযুগের তুলনায় বর্তমান দল ইনিংস প্রতি ১০০র বেশি রান কম করছে আর তাই তুলনায় অনেক ভাল বোলিং আক্রমণ থাকা সত্বেও এই দলটা ম্যাচ জিততে পারছে না।
লক্ষ্যনীয় গত সফরে অন্তত: দুটো টেস্ট ভারত হেরেছে যেখানে ব্যবধান ৫০রানের আশেপাশে। অর্থাৎ এই ইনিংস প্রতি ১০০ বা টেস্ট প্রতি ২০০ রানটা কতটা গুরত্বপূর্ন সেটা সহজেই অনুমেয়। গত সিরিজের ফল উল্টে যেত। ব্যক্তিগত স্তরে এই হিসেবটা করলে দেখা যাচ্ছে ওই সময়ে অর্থাৎ ১৯৯০ থেকে ২০১১, প্রতিটা টেস্ট যিনি খেলেছেন সেই শচীনের গড় ইংল্যান্ডের মাটিতে ৫১-এর কিছু উপরে।
সৌরভ (৬৫) – রাহুলের (৬৮) কথা তো ছেড়েই দিলাম, এঁরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সেখানে এই দলের প্রধান তিন ব্যাটসম্যান অর্থাৎ কোহলি, পূজারা, রাহানের গড় যথাক্রমে ৩৫.৬৪, ২৭.৫৩ এবং ২৯.৫২। এখনও অবধি এদেশে তিনজনের সম্মিলিত শতরান চার, যেটা রাহুল দ্রাবিড় একা শুধুমাত্র ২০১১র সফরেই করেছিলেন।
আর একটা উল্যেখযোগ্য বিষয়, শচীন-সৌরভরা ১৪/১৫ বছর বয়সেই প্রথম ক্রিকেট খেলার জন্য কৈলাশ ঘাটানির হয়ে ইংল্যান্ডে পা রাখেন। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে কাউন্টি খেলে নিজেদের ইংল্যান্ডের পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। এখন অবশ্য কাউন্টি না খেলে ওই সময়টায় আইপিএল খেলা অনেক বেশি প্রয়োজনীয় বলেই সবাই মনে করে থাকেন।
অর্থাৎ একটা বিষয় জলের মতো পরিষ্কার, যখন বিষয়টা সিম বা স্যুইং খেলা তখন এখনকার ব্যাটসম্যানরা ধারে এবং ভারে পূর্বসূরীদের কাছাকাছি আসেন না, কারণ সিম বা স্যুইং খেলার সর্বোচ্চ পরীক্ষাটা ইংল্যান্ডের মতো আর কোথাও হয় না (নিউজিল্যান্ড ব্যতীত) । আপনি তাঁদের যত বড় ফ্যানই হন না কেন, এটা মেনে নেওয়া উচিত যে তাঁরা সর্বোচ্চ পর্যায়ের স্যুইং খেলতে পারেন না এবং এটা জানা সত্ত্বেও অতিরিক্ত প্রচেষ্টাও নেই নিজেদের সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়ার।
আর তাই যদি বোলিং বিভাগ স্বপ্নের ফর্মে না থাকে আগামী পাঁচটা টেস্টও দু:স্বপ্নের হতে চলেছে, হয়তো ব্যক্তিগত দক্ষতার উপর ভর করে এক আধটা টেস্ট উতরে যাবে। তার বেশি কিছুতেই নয়। কারণ স্পিন খেলার মতো স্যুইং খেলাও একটা শিল্প যেটা রাতারাতি আয়ত্ব করা যায়না।