মিডল স্টাম্প প্লিজ…

১৯৯৭ সালে বোর্ড সভাপতি একাদশের হয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলার জন্য ডাক পেল ১৭ বছরের ছেলেটা। বাবা চেয়েছিলেন দেশের জার্সি একদিন উঠুক তাঁর গায়ে। বাবার স্বপ্নকে সত্যি করতেই সুযোগটা হাতছাড়া করলো না সে।

পাঞ্জাবের হয়ে ফার্স্টক্লাস ক্যারিয়ারটা মন্দ ছিল না। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপেও খেলার অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু, তরুণ আর অনভিজ্ঞ হরভজন সিং বুঝে উঠতে পারেননি জাতীয় দলের জার্সি পরলে পায়ের তলায় এভাবে চোরাবালি সরে যেতে থাকে।

পাঞ্জাবের হয়ে দুরন্ত বোলিং করা ভাজ্জি একেবারে ব্যর্থ হলেন ১৯৯৭ সালের সেই ম্যাচে। প্রথম দুই টেস্টে বাদ ৷ তৃতীয় টেস্টে জাতীয় দলে অভিষেক হলেও মাত্র এক উইকেট। টেস্টে বোলিং ইকোনমিও ভালো নয়। সিলেকশন কমিটির খাতা থেকে ক্রমশ ফিকে হয়ে গেল জালান্দারের ছেলেটা।

২০০১ সালে একটা টেলিফোন। গত রাতেই বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফির টিম সিলেকশন মিটিংয়ে ধুন্ধুমার হয়ে গেছে। তরুণ বেহালার তরুণ তখন চমকে দিয়েছেন গোঁড়া বোর্ড নির্বাচকদের। নির্বাচকদের প্রাথমিক তালিকাতেই ছিল না ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকা হরভজনের নাম।

রুদ্ধদ্বার সেই বৈঠকে সৌরভ একটাই প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এখানে হরভজনের নাম নেই কেন?’

বোর্ড প্যানেলের সকলে বিষয়টা হেসে উড়িয়ে দিলেও সৌরভের পরের ছক্কাটা পিঠ দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নামিয়ে দিল নির্বাচকদের, ‘লিস্টে হরভজনের নাম না দেখে আমি এই ঘর ছাড়বো না।’

পরদিন সকালেই এল টেলিফোনটা, ‘হাই ভাজ্জি, দাদা স্পিকিং। বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফিতে তুমি আমার দলে থাকছো।’

জহুরির চোখ সেদিন চিনে নিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেটের এক খাঁটি রত্নকে যার আঙুলের ভেলকির ঔজ্বল্যে একদশকেরও বেশি সময় ধরে স্পর্ধার পায়ে দাঁড়িয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট। সেই সিরিজে নিজের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলা ভাজ্জি নিলেন ৩২ টি উইকেট।

দুর্ধর্ষ অজিদের বিরুদ্ধে সৌরভ ২১ বছরের ভাজ্জির হাতে তুলে দিলেন স্পিন আক্রমণের যাদুদণ্ড। কথা রাখলেন ‘পাঞ্জাব কা পুত্তার’৷ শুরু হল ভাজ্জির সোনালি দৌড় ৷ ১০৩ টেস্টে ৪১৭ উইকেট, মুরাালির পর অফ স্পিনের সুপারস্টার।

ভারতের স্পিন মায়েস্ট্রো কুম্বলের পাশে যেন নিজের ডানা মেললেন ভাজ্জি, কুম্বলের গুগলি আর ভাজ্জির দুসরায় আসমুদ্র হিমাচলে দোলা লাগলো, দোলা লাগল বিদেশের মাঠে ভারতের আধিপত্যের মাহেন্দ্রক্ষণে, টেস্টে ২৫ বার ৫ উইকেট নিয়ে ভেঙে দিলেন বহু তাবড় স্পিনারদের রেকর্ড।

 

২০০৩ সাল। আঙুলে চোট। সৌরভের কপালে চিন্তার ভাঁজ। ভাজ্জির আঙুলের অপারেশন। আফ্রিকা নিয়ে যাওয়ার ব্যপারে একটা প্রশ্নচিহ্ন বড় রকমের।

ইতিহাস হয়ত ফিরে আসে। দাদার একটা ফোন পাল্টে দিয়েছিল যে ২১ বছরের ছেলেটার জীবন আজ সেই ছেলেটাই জোড় গলায় বললো, ‘ম্যায় খেলনা চাহতা হু দাদা!’

আঙুলে স্ট্র‍্যাপ বেঁধেই ভাজ্জি নেমে পড়লেন ওয়ান্ডারার্স থেকে জোহানেসবার্গ। হাতের চোট বেড়ে গেলেও থামলেন না। টুর্নামেন্ট শেষে ২০০৩ এর মাঝামাঝি আর পারলেন না ভাজ্জি। চোট লুকিয়ে খেলায় আঙুলের চোট অনেকটাই থাবা বসাল চড়চড় করে বাড়তে থাকা ক্যারিয়ার গ্রাফে।

সৌরভ অধ্যায় শেষে ভারতীয় ক্রিকেটের অন্ধকারতম চ্যাপেল জমানা পেরিয়ে ভাজ্জি খেলে চললেন মাহি সাম্রাজ্য পর্যন্ত। ভারতীয় ক্রিকেটের উত্থান পতনের শিলালিপিতে লেগে থাকল হরভজন সিংয়ের নাম। একদিনের ক্রিকেটে স্থায়ী জায়গা করতে পারলেন না হয়ত বারবার চোটের জন্য।

হয়তো সাদাবলের ক্রিকেটে অফ স্পিনারদের উত্থান একটু পিছিয়ে দিল ভাজ্জিকে। তবু বিশ্বকাপের মঞ্চ এলেই যেন সৌরভের অদৃশ্য ভরসার হাতটা কাঁধে পেতেন হরভজন। ২০০৩, ২০০৭ কিংবা ২০১১- ভারতীয় ক্রিকেটের তিন মাইলফলকেই খোদাই হল ভাজ্জির দুসরা আর বিষাক্ত অফ স্পিন।

একটা টেলিফোন যে রূপকথার জন্ম দিয়েছিল তাঁর পরিসমাপ্তি হয়ত রাজকীয় হল না। ভাজ্জিরা তার পরোয়াও করেন না, অজি স্লেজিংয়ের মুখে সপাটে থাপ্পড় কিংবা বিদেশের মাটিতে ব্রিটিশ ঔদ্ধত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে মাঠে নামতেন ভাজ্জি। শিরায় শিরায় বয়ে চলা পাঞ্জাবি আগ্রাসন আকাশে খুলে দিত তেরঙা পতাকাটা।

আমাদের ছেলেবেলা পেরিয়ে যৌবনে এসে যায় জীবন। ভাজ্জি তিন আঙুলে শক্ত করে পাক দেন বলের সিমটার ওপর। জীবনের বয়ে যাওয়ার জটিল অংকের পাশ দিয়ে দুটো হাত ডানার মতো মেলে দেন ভাজ্জি। তারপর সেই চেনা অ্যাকশন আর পিচে ড্রপ খেয়ে বলটা ঢুকে যায় ভেতরের দিকে।

মিডল স্টাম্পের আশায় সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এখনো ভাজ্জি যেন জোড় গলায় আপিল করেন, ‘হাউজ্জ্যাট!’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link