সেদিনের ইকবাল, আজকের প্রবীন তাম্বে!

বছর পনেরো আগেকার ইকবাল, কিংবা আজকের প্রবীণ তাম্বে — এরা ক্রিকেটের শরনার্থীর মতো ঘুরে বেড়ায় এক দ্বার থেকে অন্য দ্বারে। একদিন সব দ্বার বন্ধ হয়ে যায় তাদের। তখন আর তাদেরকে শুধু দ্বার খুললেই হয় না, তাঁকে ভেঙে ফেলতে হয়, কারার ঐ লৌহ কপাটের মতো করে, প্রাচীর ভেদির মতো করে। ঠিক সেইদিন ইকবালের কাছে কেউ হাতবাড়িয়ে দেয় অটোগ্রাফ চেয়ে, প্রবীণের কাছে কেউ পাঠিয়ে দেয় রাজস্থান রয়্যালসের চুক্তিপত্র, আর ইকবালের ভবঘুরে কোচের মতো আমরাও বলে চলি — ‘ক্রিকেটার কোই কিষাণ সে কম মেহনত নেহি কারতা’!

সেদিনের ইকবাল আজকের প্রবীণ তাম্বে। ইকবাল কানে খাটো, কথাও বলতে পারে না। তবু সে স্বপ্ন দেখে ভারতের হয়ে খেলবে, ‘ইন্ডিয়া খেলবে’। ইকবাল রান আপ প্র‍্যাকটিস করে খড়ের গাদার উপর দিয়ে। সন্ধ্যা নামে, গ্রামের দিগন্তে সূর্য অস্ত যায়। গাছের আঁকাবাঁকা ডালগুলো দিয়ে ইকবাল স্টাম্প গেড়ে নেয়।

বল কিছুতেই ঠিকঠাক জায়গায় পিচিং হয় না। যাকে সে কোচ বলে মনে করে, সেও নিতান্তই ভবঘুরে, মাতাল। কোচ মাঝেমাঝেই জিজ্ঞেস করে ইকবালকে, কি হবে বোলিং শিখে। কানে খাটো ইকবাল শুনতে পায় কি কথাগুলো? —জানিনা। ইকবাল শুধু স্বপ্ন দেখে ভারতের হয়ে খেলার, ‘ইন্ডিয়া খেলা’র। অস্তমিত সূর্য আর তিনটে আঁকাবাঁকা ডালের স্টাম্পকে সাক্ষী রেখে ইকবাল তাই ক্রিকেটের অর্চনা করে যায়, একমনে, একযোগে।

ইকবালের অধ্যাবসায়ে ঘুম ভাঙে একদিন তার কোচের। ইকবাল আস্তে আস্তে বুঝিয়ে দেয় তার দুর্নিবার সংকল্পখানি — সে ইন্ডিয়া খেলতে চায়। তারপর একদিন আসে, মাতাল কোচ পিচে কয়েন রেখে দেয় আর ইকবালকে বলে — ওই যে কয়েনটা, ওটাই তোমার সংকল্প, ওটাই তোমার লক্ষ্য, ওটাই তোমার ইন্ডিয়া, বল ফেলো ঠিক ওই কয়েনের উপরটায় আর এমনভাবে ফেলো যেন বলের আঘাতে কয়েনটা ছিটকে উপরে টস আপ করে।

ইকবাল লম্বা রান আপ নেয়। দু আঙুলের ফাঁক থেকে শক্ত করে ধরা লালবলের সিমটা ছিটকে বেরিয়ে ছুঁয়ে যায় পিচে রাখা কয়েনের প্রান্তটা। পারফেক্ট লেন্থে পরা বলখানি ছিটকে দেয় মিডল স্ট্যাম্প, কয়েনটাও পিচ থেকে ছিটকে উপরে পাক খেতে খেতে ঘুরতে থাকে ঠিক ইকবালের ভাগ্যের মতো। ইকবালের বলের গতিতে ভাগ্যের টেলটা ঘুরে আসে হেড হয়ে,কয়েনের মতোই।

বোবা ইকবালের সবাক মনখানা অযাচিত স্বরে চিৎকার করে ওঠে — ‘হাওওওওইজজজ দ্যাট!’

সেদিনের ইকবাল আজকের প্রবীণ তাম্বে। বয়স বেড়েছে। কিন্তু একই রয়ে গেছে সংকল্পের সরলরেখাটা — ইন্ডিয়া খেলতে হবে। অফিসের ভ্রুকুটি তাচ্ছিল্য করে প্রবীণ, ক্রিকেট খেলে বেড়ায়। সবাই ভুরু কোঁচকায় তার বয়স দেখে। কোচের স্ট্র‍্যাটেজিতে সে পেসার থেকে স্পিনারও হয়ে যায়। দুর্ঘটনায় চোট পায়। কটুক্তিও শুনে নেয়। কিন্তু সংকল্পের অক্ষয় লক্ষ্যটা চিরস্থায়ী হয়ে এঁটে থাকে তার মনে — ইন্ডিয়া খেলতে হবে।

বছর পনেরো আগেকার ইকবাল, কিংবা আজকের প্রবীণ তাম্বে — এরা ক্রিকেটের শরনার্থীর মতো ঘুরে বেড়ায় এক দ্বার থেকে অন্য দ্বারে। একদিন সব দ্বার বন্ধ হয়ে যায় তাদের। তখন আর তাদেরকে শুধু দ্বার খুললেই হয় না, তাঁকে ভেঙে ফেলতে হয়, কারার ঐ লৌহ কপাটের মতো করে, প্রাচীর ভেদির মতো করে। ঠিক সেইদিন ইকবালের কাছে কেউ হাতবাড়িয়ে দেয় অটোগ্রাফ চেয়ে, প্রবীণের কাছে কেউ পাঠিয়ে দেয় রাজস্থান রয়্যালসের চুক্তিপত্র, আর ইকবালের ভবঘুরে কোচের মতো আমরাও বলে চলি — ‘ক্রিকেটার কোই কিষাণ সে কম মেহনত নেহি কারতা’!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...