বলের লেংথ বুঝতে দেরি হয়েছিল ভগ্নাংশের কম। ডান পা সামনে এগিয়ে এসেছিল একটু। ফুল লেংথের আশায়।
মাইকেল হাসি ভাবেনইনি। মনের কোণে কোথাও, হঠাৎ বৃষ্টির মতো উঁকি মারেনি আশঙ্কা। পর পর দুটো বাউন্সার হেলায় সামলানোর পর, কোন বোলার আবার মাঝ পিছে বল রাখবে। বাউন্সারে হাসি দুর্বল, এই বদনামও তো সেভাবে শোনা যায় না। তা হলে! শিকারির ধনুকের ছিলা থেকে বেরোনো অব্যর্থ বান যে ভাবে অসহায় শিকার খুঁজে নেয়, বোলারের হাত থেকে বেরোনো ধূমকেতুর মতো লাল গোলাটাও, সে দিন খুঁজে নিয়েছিল হাসির হেলমেট।
স্পিড গানে গতি, ঘন্টায় ১৪৩ কিমি। ইনিংসের বয়স, ৯৯ ওভার। অস্ট্রেলিয়ার রান তিনশোর কোটা পেরিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। ওভার পিছু রান প্রায় সাড়ে তিন। দলের এমন প্রতিকূল অবস্থায় বোলারের এই গতি, এই আগ্রাসনই বা আসে কথা থেকে!
এখানেই বাকি গড়পড়তাদের থেকে আলাদা ডেল স্টেইন। তিনি তো আর যে সে বলার নন। ‘ওয়ানস ইন আ লাইফ টাইম’ বলতে যা বোঝায়, ঠিক তাই। চলমান এক কিংবদন্তি।
গৃহ যুদ্ধ আর আর বর্ণবিদ্বেষের দীর্ঘ জাঁতাকলে পেষা দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তর-পূর্ব প্রান্তে ছোট্ট টাউন ফালাবোরা। শহরের প্রান্তদেশ থেকেই শুরু হয়েছে ক্রুগার ন্যাশনাল পার্কের সীমানা। ছোট ছোট পাহাড়, সাবানা ঘাসের জঙ্গল, গুল্মের ঝাঁক নিয়ে এক মনোরম জগৎ। সিংহ, চিতা, হরিণ, জিরাফ- কী নেই সেখানে! ফালাবোরা অনেকটা আমাদের ডুয়ার্সের আলিপুরদুয়ারের মতো। ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির তীর’।
সেই আদিম কাল থেকেই মানুষের মনে প্রভাব বিস্তার করে আসছে প্রকৃতি। দার্শনিকরা বলেন যে মানুষ যত বেশি প্রকৃতির কোলে মাথা রাখে, সে তত ধনী। কোলে মাথা রাখায় বিভিন্ন সময়ে, ভিন্ন ভিন্ন রূপে ধরা দেয় প্রকৃতি। কখনও সে কোমল। শান্ত শীতল নদীর ন্যায়। কখনও আবার আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত। ফালাবোরায় জন্মানো স্টেনের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা ঠিক তাই।
না হলে, মাঠের বাইরে যে লোকটা হরিণ, জিরাফ বা বয়ে চলা নদীর মতো শান্ত, ভদ্র, হাতে বল নিলেই সে সিংহের মতো দাঁত, নখ বের করে ছুটে আসবে কেন! কেনই বা হয়ে যাবে চিতার ন্যায় ক্ষিপ্র! ক্রুগার ন্যাশনাল পার্ক যেমন করে প্রকৃতি প্রেমীদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে, স্টেনও তেমন ভাবে আমাদের মোহিত করে রেখেছিলেন। দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময় ধরে।
কোনও এক সময়ে ক্রিকেটের নন্দন তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নেভিল কার্ডাস স্কোরবোর্ডকে গাধা বলছিলেন। স্টেইনকে দেখলে বরেণ্য কার্ডাস নিশ্চয় সে মন্তব্যে কোনও ফুটনোট যোগ করতেন। বা স্কোরবোর্ড সম্পর্কে তাঁর ধারণাটাই বদলে যেত। শুধু পরিসংখ্যান দিয়েই তো স্টেনকে সুন্দর ভাবে বোঝানো যায়। ৯৩ টেস্ট, ৪৩৯ উইকেট, গড় ২২.৯৫। স্ট্রাইক রেট ৪২.৩।
২০০ বেশি টেস্ট উইকেট পাওয়া বোলারদের তালিকায় স্ট্রাইক রেটের বিচারে স্টেইনের আগে কেউ নেই। উইকেট প্রতি গড় যদি দেখা যায়, সেখানেও হাডাহাড্ডি লড়াইয়ে ফেলবেন ম্যাকগ্রা, মার্শাল, ওয়াসিম আকরামদের। আরও আশ্চর্যের, ২০০৮ থেকে ১৪, ছিলেন আই সি সি তালিকায় পয়লা নম্বর। ২৬৩ সপ্তাহ, ২৩৫৬ দিন। কী মনে এখনও মনে হচ্ছে না সর্বকালের সেরা?
অথচ স্টেনের শুরুটা হয়েছিল অদ্ভুত সাদামাটা ভাবে। ২০০৪-০৫ মরসুমে প্রথম ডাক পান ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। এমন বল করলেন যে দল থেকেই বাদ পড়তে হল। ঘরোয়া ক্রিকেটেও তখন অনভিজ্ঞ স্টেন। পাড়ি দিলেন ইংল্যান্ড। এসেক্সের হয়ে কাউন্টি খেলতে। পারফর্মেন্স সাদামাটা। কিন্তু জীবন বদলে গেল। দেখা হয়ে গেল কোচ ইয়ান পন্টের সঙ্গে। স্টেনকে তিনি শেখালেন জোরে বোলিংয়ের পাটিগণিত।
২০০৫-০৬ মৌসুমের নিউজিল্যান্ড সিরিজে দক্ষিণ আফ্রিকা দলে সারা জাগিয়ে স্টেইন ফিরলেন। এর পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। শুধু একের পর এক শৃঙ্গ আরোহন করেছেন। সামনে থাকা ব্যাটসম্যান বদলেছে, মাঠ বদলেছে, বিপক্ষ বদলেছে, এমনকি বদলে গিয়েছে হাতে থাকা ‘লাল চেরি’। কখনও ডিউক, কখনও কোকাবুরা, কখনও আবার এস জি। বদলায়নি শুধু ব্যাটসম্যানকে প্যাভিলিয়নের রাস্তা ধরানো ‘স্টেইন গান’।
কী ছিল স্টেইনের? কেন তাঁকে বল হাতে ছুটে আসতে দেখলে ধুকপুকানি বাড়তো তাবড় বাটসম্যানদের? ক্রিকেট বোদ্ধা আমি নই। মাঠে নেমে ব্যাট, প্যাড নিয়ে কখনও দাঁড়াইনি সেভাবে। তাই গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজো! নানা জায়গায় নানা ভাবে নিজের বোলিং বিশ্লেষণ করেছেন স্টেন। সেটাই একটু সাজিয়ে গুছিয়ে তুলে ধরা যাক।
যে নিউজিল্যান্ড সিরিজের হাত ধরে স্টেনের উত্থান, তাতে বেশিরভাগ উইকেটই এসেছিলো আউট সুইংয়ে ভর করে। দোসর আগুনে গতি। যা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গ ছাড়েনি। ২০০৮-০৯ অবধি ইনসুইং সেভাবে ব্যবহার করেননি। ভয় ছিল, যদি বল ভেতরে আনতে গিয়ে আউটসুইং হারিয়ে যায়। মিডল লেগ স্ট্যাম্প পড়ে অফের বেল ছুঁয়ে বেরিয়ে যাওয়া আউটসুইং করতেন কব্জির ব্যবহারে।
বলের সিম থাকতো ফাস্ট স্লিপের দিকে আপ রাইট। এমনভাবে বলটা ছাড়তেন, ব্যাটসম্যান যেন কনিষ্ঠার নিচে তালুর সাদা অংশটা আগে দেখতে পায়। একই সঙ্গে ছিল ক্রিজের ব্যবহার। কখনও সরে এসে একেবারে আম্পায়ারের গায়ের উপর উঠে। মাঝে মাঝে সরে গিয়ে ওয়াইড অফ দ্য ক্রিজ। ব্যাটসম্যান ধন্দে থাকতেন। কোন বল বাঁক খেয়ে বেরোবে। কোনটা ‘উইথ দ্য অ্যাঙ্গেল’ সোজা ভেতরে ঢুকে আসবে কে জানে।
ইনসুইং রপ্ত করার করার পর স্টেন হয়ে গেলেন আরও ভয়ংকর। ভেতরে আনার সময় বলের সিম লেগ স্লিপের দিকে তাকিয়ে থাকতো। এবার ব্যাটসম্যানের প্রথমে চোখে পড়তো বুড়ো আঙুলের তোলার সাদা জায়গা। বাউন্সার করতেন ক্রস সিমে। যাতে কোনটা সিমে পড়ে, আবার কোনটা অপেক্ষাকৃত মসৃণ দিকে। সিমে পড়লে বল হয়তো একটু বেশি লাফাবে। অপেক্ষাকৃত মসৃণ দিকে পড়লে স্কিড করে ছুটে আসবে ব্যাটসম্যানের দিকে। আরও পরে এর সঙ্গে যোগ হয়েছিলো স্লোয়ার বল, রিভার্স সুইং।
ক্রিকেটে সবচেয়ে কঠিন কাজ কী? যাকে খুশি প্রশ্ন করুন। ফাস্ট বোলিং, উত্তর আসবে কোরাস-এ। দিনের পর দিন, ম্যাচের পর ম্যাচ, ঘন্টায় ১৪৫ কিমি বা তার বেশি জোরে বল করে যাওয়া, যে কোনও আট হাজার মিটার পর্বত শৃঙ্গ জয় করার মতোই কঠিন। ডেথ জোন। সবোর্চ্চ মানের ফিটনেস, কমিটমেন্ট, আর কিছুটা পাগলামো না থাকলে হয় না। এই কঠিন কাজটাই আগ্রাসন আর ধারাবাহিকতার রঙিন মোড়কে দৃষ্টিসুখের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন স্টেন।
কিশোর বয়সে ক্রিকেটের প্রাথমিক পাঠ নেওয়ার সময় চেয়েছিলেন ব্রেট লির আগ্রাসন, শন পোলকের ধারাবাহিকতা আর শোয়েব আখতারের গতি। প্রতিটাই ছিল তাঁর। এবং সেটাও বাকিদের থেকে অনেক বেশি সময় ধরে।
টেস্ট ক্রিকেটকে জীবনের পাঠশালা বলেন অনেকে। ঠিকই বলেন। টেস্টের এক একটা সেশন যেন জীবন খাতার এক একটা পাতা। যেখানে ধোনি, থুড়ি সুশান্ত, হলে চলবে না। কঠিন সময়ে লড়তে হবে ‘খিলাড়ি’ কুমারের মতো। বিপক্ষ যখন গলা ধাক্কা দিয়ে দরজার বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে, তখনও লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। ‘ফাইট কোনি ফাইট’। গ্রিন টপ বা স্পিন সহায়ক ২২ গজে পরীক্ষা হয় ব্যাটসম্যানদের। শরীর থেকে দূরের বল খেলা যায় না, অনেক বেশি নজর দিতে হয় ফুটওয়ার্কে।
ফ্ল্যাট উইকেটে তেমনই বোলারকে এক জায়গায় বল রাখাটাকে নিয়ে যেতে হয় শিল্পের পর্যায়ে। করতে হয় গতির পরিবর্তন। ক্রিজের ব্যবহার। আর তৈরী থাকতে হয় সামান্য সুযোগের অপেক্ষায়। যদি কোনোভাবে একটা উইকেট পাওয়া যায়, সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এক ধাক্কায় ফেরাতে হবে দুই তিন ব্যাটসম্যানকে। জীবনে পথ চলার মতো, সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে। চুটিয়ে উপভোগ করতে হবে ভাল সময়। কে বলতে পারে পরের সেশনে ব্যাটিং দল আবার মাথায় চড়ে বসবে না।
উইকেট না পাওয়া স্পেলগুলোয় জীবনের এই জলছবিই চিত্রায়িত করে গিয়েছেন স্টেন। একবার, দুবার, বার বার। ২০১৩-১৪ ইন্ডিয়া সিরিজে টানা ৬৯ ওভার উইকেট বিহীন ছিলেন। সুযোগ এল, বল রিভার্স হতে শুরু করার পর। পরের ১২ ওভারে তাঁর ঝুলিতে ছয় উইকেট। এটাই তো জীবন। একটাই তো স্টেইন!
কলম রাখবো একটা ছোট্ট গল্প বলে। সালটা ৯৫ কী ৯৬। স্কুলে পড়ি। ছুটির সকালে পাশে বন্ধুর বাড়ি গিয়েছি। ক্রিকেট দেখার লোভে। টিভির সামনের সোফায় বসে আমি, বন্ধু ও তার দাদু। পর পর দুই ভারতীয় ব্যাটসম্যান আউট হওয়ার পর হটাৎ চিৎকার করে উঠলেন সেই বয়স্ক মানুষটা।
এটা ক্রিকেট! ব্যাটম্যানগুলো বলের লাইন লেংথই ঠিক করে পড়তে জানে না। তোরা খেলাটার আসল সৌন্দর্য্যই তো বুঝলি না। সুনীল গাভাস্কারকে তো দেখিসনি। দেখলে বুঝতিস ক্রিকেট খেলাটা একটা শিল্প। এখন এই কথাটার মানে ভালো করে বুঝতে পারি। আর কিছুটা আফসোস হয়। আমরা যেমন গাভাস্কারকে ব্যাট করতে দেখিনি, সেই দাদুও তো তেমন ডেল স্টেইনকে বল করতে দেখেননি!