গত এক দশকের মাঝে অনেক উত্থান-পতনের মাঝে দিয়ে গিয়েছে স্প্যানিশ ফুটবল। ফুটবল ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা প্রজন্মের হাত ধরে স্পেন জিতেছিল বিশ্বকাপ এবং ইউরো। পাশাপাশি দেখেছে মুদ্রার উল্টো পিঠও, সোনালি প্রজন্মের সেই দলের সবাই বিদায় নিতে শুরু করলে আস্তে আস্তে ডুবতে থাকে স্প্যানিশ সূর্য।
২০১৪ এবং ২০১৮ বিশ্বকাপে চরম ব্যর্থতার পর স্পেন ফুটবল ফেডারেশন তখন হন্যে হয়ে খুঁজছিল এমন কাউকে যিনি কিনা সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন দলকে। পেয়েও গেলো এমন একজনকে, যিনি কিনা বার্সাকে জিতিয়েছেন ট্রেবল, যার ব্যক্তিত্বের সামনে মেসি-নেইমাররাও ম্লান হয়ে যান। তিনি হলেন লুইস এনরিকে।
স্পেনের দায়িত্ব নেবার পর টানা জিতলেন সাত ম্যাচ। ২০১৯ জুনের জুন মাসে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করলো স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশন। সবাই ভেবেছিল হয়তো আসন্ন ইউরোর পরিকল্পনা জানাবেন কোচ এবং কর্তারা। কিন্তু বিধিবাম! দায়িত্ব নেবার এক বছরেরও কম সময়ের মাঝে হুট করে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে কোচের দায়িত্ব ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত জানান লুইস এনরিকে।
সবাইকে হতবাক করে অশ্রুসজল চোখে দ্রুত ত্যাগ করেন সম্মেলনকক্ষ। মাসদুয়েক পরেই জানা গেলো প্রকৃত সত্যিটা। এনরিকের একমাত্র কন্যা ৯ বছরের শানা মারা গেছেন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে। তাই একটু একাকী সময় কাটাতে চলে গেলেন সবার অন্তরালে। কন্যার মৃত্যু যে কিছুটা হলেও দুর্বল করে দিয়েছিল তার ইস্পাতকঠিন মানসিকতাকে। কিন্তু দ্রুতই এনরিকে বুঝতে পারলেন কাজের মাঝে থাকলেই কেবল কিছুটা লাঘব হবে কন্যা হারানোর বেদনা। স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনও প্রস্তুত হয়েই ছিল, তিনি আসা মাত্রই পুনরায় দলকে তার হাতেই সঁপে দিলো।
এবার কিছুটা পেছনে ফিরে তাকাই। কোচিং ক্যারিয়ার শুরুর আগে এনরিকের খেলোয়াড়ি জীবনের কথা স্মরণ করি। ১৯৭০ সালে জন্ম নেয়া লুইস এনরিকের ক্যারিয়ার শুরু স্পোর্টিং গিজনে, গিজনের ইয়ুথ একাডেমিতে থাকার সময় গিজনের মেক্সিকান খেলোয়াড় লুচো ফ্লোরেসের নাম থেকে ‘লুচো’ ডাকনাম পেয়ে যান। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে লড়াকু মানসিকতা এবং অসাধারণ স্ট্যামিনার জন্য প্রশংসা কুড়ান তিনি।
গিজনের মূল দলে অভিষেক মৌসুমেই দারুণ খেলেন। ফলস্বরূপ মৌসুম শেষেই দেড় মিলিয়ন ইউরোতে তাকে দলে ভেড়ায় স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদ। প্রথম দুই মৌসুমে তেমন ভালো খেলতে পারেননি সাদা জার্সিতে। কখনো মিডফিল্ড, কখনো ফুলব্যাক পজিশনে খেলতে হয়েছে। কখনোই দলে নিজের জায়গা পাকা করতে পারেননি। তবে ধীরে ধীরে মানিয়ে নেন এনরিকে, হয়ে যান দারুণ একজন ভার্সেটাইল খেলোয়াড়।
বার্সেলোনার বিপক্ষে ১৯৯৪/৯৫ মৌসুমে বিখ্যাত ৫-০ গোলে জয়ের ম্যাচে বক্সের বাইরে থেকে দৃষ্টিনন্দন একটি গোলও করেন তিনি। ১৯৯৫/৯৬ মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদ তাদের সবচেয়ে বাজে মৌসুমগুলোর একটি কাটায় এবং দর্শকদের মূল আক্রোশ গিয়ে পড়ে এনরিকের উপর। রাগে-অভিমানে রিয়াল ছাড়েন এনরিকে, ফ্রি ট্রান্সফারে যোগ দেন মাদ্রিদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনায়।
বার্সেলোনায় এসেই যেন নিজেকে ফিরে পান এনরিকে। নিজের প্রথম মৌসুমেই গোলস্কোরিং মিডফিল্ডার হিসেবে দারুণ নাম কামান, মোট ১৭ গোল করেন সে নৌসুমে। রিয়ালে নিজের পাঁচ মৌসুমেও এত গোল করেননি, এরপরের মৌসুমে ১৮ গোল করে জেতান লা লিগা, পরের বছরেও লিগ শিরোপা জেতে বার্সেলোনা। ২০০২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বার্সেলোনার ক্যাপ্টেন ছিলেন লুচো, এরপর ২০০৪ সালে এসে ৩৪ বছর বয়সে অবসর নেন।
অবসরের পরই ফুটবল কোচিং শুরু করেন এনরিকে। শুরুতে বার্সা বি দলে পেপ গার্দিওলার সহকারি হিসেবে ছিলেন তিন বছর। গার্দিওলা মূল দলের দায়িত্ব পেলে এনরিকে বার্সা বি দলের প্রধান কোচ হিসেব নিযুক্ত হন। ২০০৮ সালে বার্সেলোনা বি টিমের কোচ হন এনরিকে, সেখানে নিজের দ্বিতীয় মৌসুমে দলকে ১১ বছর পর সেগুন্দা ডিভিশনে প্রমোট করতে সক্ষম হন।
২০১১ সালে বার্সা বি ছেড়ে যোগ দেন ইতালিয়ান জায়ান্ট এএস রোমায়, সেখানে গিয়ে মাত্র এক মৌসুম টিকতে পেরেছিলেন। পরের বছরেই স্পেনে ফিরেন ২০১৩ সালে সেল্টা ভিগোর কোচ হয়ে, সেখানে মধ্যম সারির দল সেল্টাকে নিয়ে লিগে সম্মানজনক ৯ম স্থানে থেকে শেষ করেন।
২০১৪ সালে টাটা মার্টিনোকে বরখাস্ত করা হলে তার স্থলে বার্সার মূল দলের দায়িত্ব পান এনরিকে। এলচের বিপক্ষে ৩-০ গোলের জয় দিয়ে শুরু হলেও রিয়াল মাদ্রিদ টানা বিশ ম্যাচ অপরাজিত থাকায় মনে হচ্ছিল এই মৌসুমেও বোধহয় লিগ শিরোপা জেতা হবেনা, কিন্তু নিজের শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ের মানসিকতা খেলোয়াড়দের মাঝেও ছড়িয়ে দেন এনরিকে, শেষ ২১ ম্যাচের ২০টিতে জিতে লিগ শিরোপা ঘরে আনে বার্সেলোনা।
এর এক সপ্তাহ আগেই কোপা দেল রে নিশ্চিত করে তার দল। মৌসুমের শেষটা হয় জুভেন্তাসকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে ৩-১ গোলে হারিয়ে। ট্রফিলেস এক মৌসুম কাটাবার পরের বছরেই তার অধীনে ট্রেবল জিতে বার্সেলোনা। পরের মৌসুমেও লিগ শিরোপা এবং কোপা দেল রে ঘরে আনে বার্সেলোনা, তবে নিজের জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনার মুখোমুখি হন সেবছরই।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের দ্বিতীয় রাউন্ডে পিএসজির মাঠে ৪-০ গোলে হেরে যায় বার্সা। চারিদিকে তখন সমালোচনার ঝড়, মেসি-নেইমারদের নিয়ে হাসাহাসি করছে দর্শকরা। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে এসে এনরিকে বললেন, ‘ওরা যদি চার গোল দিতে পারে আমরা ছয়টা দেবো’।
নিজের হার না মানা মানসিকতা ছড়িয়ে দিলেন পুরো দলের মাঝে। গুণে গুণে ঠিক ছয় গোলই দিলো বার্সা, আর লুইস এনরিকে হয়ে গেলেন ইতিহাসের অংশ। লুইস এনরিকের বার্সা ছাড়া আর কোনো দলই যে এভাবে ফিরে আসতে পারেনি। পরের মৌসুম শেষেই বার্সার দায়িত্ব ছাড়ার ঘোষণা দেন। এরপর কিছুদিন বিরতি দিয়ে দায়িত্ব নেন স্পেন জাতীয় দলের।
এবারের ইউরো স্পেনের জন্য নিজেদের ফিরে পাওয়ার মঞ্চ, লুইস এনরিকের জন্য নিজেকে নতুন করে চেনানোর। যদিও তার প্রমাণ করার কিছু নেই, নিজের সক্ষমতা বহুবার দেখিয়েছেন বিশ্ববাসীকে। ইউরোর স্কোয়াড ঘোষণার পরই সমালোচনার মুখে পড়েন এনরিকে, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বড় কোনো টুর্নামেন্টে স্পেন খেলছ রিয়াল মাদ্রিদের কোনো ফুটবলার ছাড়াই।
প্রথম দুই ম্যাচে স্পেন হোঁচট খেলে সমালোচনার পালে হাওয়া লাগে, পরিণত হন সমর্থকদের চক্ষুশূলে। চারিদিক সমালোচনার মুখোমুখি হলেও এনরিকে আস্থা রাখলেন প্রিয় শিষ্যদের প্রতি। শিষ্যরাও প্রতিদান দিয়ে কার্পণ্য করেনি, দৃষ্টিনন্দন ফুটবল খেলে স্পেন এখন দ্বিতীয় রাউন্ড পেরিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে। প্রথম কোয়ার্টারে তারা মুখোমুখি হবে সুইজারল্যান্ডের। গত ইউরোর ব্যর্থতা ভুলে এনরিকে চাইবেন আবারো স্প্যানিশ ফুটবলের জাগরণ ঘটাতে।