গত কয়েকদিন সোশ্যাল মিডিয়া সয়লাব হয়েছে কোপা আমেরিকা আর ইউরোর তুলনা নিয়ে। দুই মহাদেশের দুই মহাজাগতিক টুর্নামেন্ট, তুলনা হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তারপরও ইউরো আর কোপা আমেরিকার তুলনাটা ঠিক চলে না।
ইউরোতে যেখানে মেলা বসে হেভিওয়েট দলদের, সেখানে কোপা আমেরিকার অনেকটাই আইসোলেটেড টুর্নামেন্ট। খেলেই মাত্র ১০ দল, সেখানে চাইলেও যেন টান টান উত্তেজনা পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সে কথা ভুল প্রমাণ করতে যেন উঠেপড়ে লেগেছিল দক্ষিণ আমেরিকার দলগুলো।
কোপা আমেরিকার আসল আনন্দই শুরু হয় কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে। আর কোয়ার্টার ফাইনাল শুরু হতে না হতেই রঙ লাগতে শুরু হয়েছে শিরোপায়। কামব্যাক, লাল কার্ড, টাই-ব্রেকার সবকিছুই একদিন দেখে ফেলেছে বিশ্ব। আজ কোপা আমেরিকা যেন আদা-জল খেয়ে নেমেছিল ফুটবল বিশ্বকে জানান দিতে, আমাদের টুর্নামেন্টেও ভালো কিছু হয়।
কোপায় সকলের চোখ ছিল ব্রাজিল-চিলি ম্যাচের দিকেই। ইউরো আর ব্রাজিল ম্যাচের মাঝে পেরু-প্যারাগুয়ে ম্যাচের কথা হয়তো অনেকে ভুলেই গিয়েছিলেন। কিন্তু এই কোপা আমেরিকার সবচেয়ে উত্তেজনাকর ম্যাচটা হয়েছে সেটাই। গোল, আত্মঘাতী গোল, লাল কার্ড, কামব্যাক আর সবশেষে আইসিং অফ দ্যা কেক উপর চেরি হিসেবে ছিল টাই-ব্রেকার।
কোপা আমেরিকার নিয়মে কোনো এক্সট্রা টাইম নেই, খেলা ৯০ মিনিট শেষে সরাসরি গড়ায় পেনাল্টিতে। তাই পেরু-প্যারাগুয়ে দুই দলেরই ইচ্ছা ছিল ম্যাচটা ৯০ মিনিটেই শেষ করে দেওয়ার। কিন্তু তা আর হলো কোথায়? ম্যাচের ১১ মিনিটে প্যারাগুয়ের হিরো বনে যাওয়া গুস্তাভো গোমেজ ভাবতেও পারেননি বাকি ম্যাচটায় তার জন্য কী অপেক্ষা করতে চলেছে?
এক ম্যাচে হিরো থেকে ভিলেন বনে যাওয়ার গল্প যেন এটা। গোল করার ১০ মিনিটের মাথাতেই হয়েছেন ভিলেন। নিজের দল, প্রতিপক্ষ দল; দুই দলের হয়েই গোল করেছেন তিনি। শুধু তাই নয় ম্যাচের প্রথমার্ধ যেতে না যেতেই লাল কার্ড দেখে দলকে দশজনে পরিণত করেও গিয়েছেন তিনি। তার আগেই অবশ্য দল ২-১ গোলে পিছিয়ে পরেছে।
নাটকীয়টার চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছিল শেষ ১০ মিনিটে এসে। ৮০ মিনিটে এগিয়ে যাওয়া পেরু বাকি সময়টা চাচ্ছিল নিজেদের ডিফেন্স শক্ত করে রাখতে। কিন্তু সে সময়েই আন্দ্রে কোরিলোর লাল কার্ড দুইদলের খেলোয়াড় সংখ্যায় আবার এনে দেয় সমতা। আর সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে শেষে মিনিটে কামব্যাক দেয় প্যারাগুয়ে। আর ম্যাচের ভাগ্য গিয়ে পরে পেনাল্টিতে।
দুই গোলরক্ষকও হতাশ করেননি। সিমোন-সোমারের আরেকটা হাইলাইটস যেন দেখা গেল গ্যালাস-সিলভার রূপে। পেনাল্টি মিসের হিড়িক পড়েছিল এখানেও। প্যারাগুয়ের দুই খেলোয়াড় বল পাঠিয়েছেন বারের উপর দিয়ে। অন্যদিকে প্যারাগুয়ের অ্যান্থনি সিলভা দুই সেভ করেও দলকে বাঁচাতে পারেননি। তবে শেষ হাসি হেসেছেন পেদ্রো গ্যালাস। সাডেন ডেথের একমাত্র পেনাল্টি থামিয়ে হিরো বনে গিয়েছেন তিনি।
পেরু-প্যারাগুয়ে ম্যাচের একদম ১৮০ ডিগ্রি উল্টো যদি কিছু থাকে, তবে তার দেখা মিলেছে ব্রাজিল-চিলি ম্যাচে। অথচ দুই হেভিওয়েট দলের ম্যাচকেই ভাবা হচ্ছিল হাইভোল্টেজ হিসেবে। কিন্তু বাকি সব কোপা আমেরিকার ম্যাচের মতন এটাও হতাশ করেছে দর্শকদের।
কিন্তু ব্রাজিল সমর্থকদের হতাশ করেনি, দিনশেষে তাদের মুখে হাসি ফুটেছে ম্যাচের রেজাল্টে। পুরো ম্যাচের হাইলাইটস হিসেবে দ্বিতীয়ার্ধের তিন মিনিটকে তুলে দিলেও বিন্দুমাত্র ভুল হবে না। পুরো ম্যাচে যা ঘটনা ঘটেছে, তা ঐ তিন মিনিটেই।
গোলশূন্য প্রথমার্ধ শেষে রবার্তো ফিরমিনোকে তুলে লুকাস পাকেতাকে মাঠে নামান ব্রাজিল কোচ তিতে। তাতেই যেন ব্রাজিলের গোলভাগ্য খোলে। নামার এক মিনিটের মাথাতেই দলকে এগিয়ে নেন পাকেতা। ক্যাসেমিরো ইন্টারেপশন থেকে নেইমার, সেখান থেকে পাকেতা; অসাধারণভাবে একমাত্র গোল আদায় করে নেন পাকেতা।
কিন্তু এর এক মিনিট পরেই ব্রাজিলের জন্য লজ্জা বয়ে আনেন গাব্রিয়েল জেসুস। মাঝমাঠে বল দখল করতে গিয়ে হঠাৎই লাফিয়ে উঠেন জেসুস। আর তা করতে জ্ঞিয়ে সরাসরি লাথি মেরে বসেন প্রতিপক্ষ খেলোয়াড় ইউজেনিও মেনার মুখে। সরাসরি লাল কার্ড দেখানো ছাড়া কোনো উপায় বাকি ছিল না রেফারির। লজ্জায় মাথা হেঁট করে কাঁদতে কাঁদতে মাঠে ছেড়েছেন তিনি।
জেসুস মাঠ ছাড়ার পর খেলার ভোলই পাল্টে ফেলেন তিতে। দলকে পুরোপুরি ডিফেন্সিভ করে ফেলেন। বাকি সময়টা চিলি চালিয়ে খেললেও কিছু করে দেখাতে পারেনি। এতে করে অবশ্য দশজনের ব্রাজিলের ডিফেন্সিভ পরীক্ষাটাও হয়ে গেল। অনেকদিন পর ম্যানচেস্টার সিটি গোলরক্ষক এডারসনের উপর ভরসা রেখেছিলেন তিতে।
তার ভরসার পাত্র হয়েই ম্যাচ শেষ করতে পেরেছেন তিনি। তিতের অধীনে অপরাজিত থাকার রেকর্ডটা আরেকটু বাড়িয়ে নিলো ব্রাজিল। সে দৌড় কোপা জিতেই হবে কীনা সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে শীঘ্রই। তার আগে ৬ জুলাই পেরু বাঁধা কাটাতে হবে তাদের।