আসলে বয়স হয়ে গেছে তো, তাই ওই ‘রক্তে আমার ব্রাজিল’ টাইপের বক্তব্য রাখি না। তবে দক্ষিণ আমেরিকার শৈল্পিক ফুটবলেও যে দুটো দেশ দলগত ফ্রি ফ্লোইং ফুটবল খেলে তাদের মধ্যে সবার আগে চোখ পরে ব্রাজিলের উপরেই। বারবার বলে লাভ নেই, ওই ৮২-তে, ফুটবল চোখ ফোটার দিনে, জিকো ভাই, সক্রেটিস, জুনিয়র, এডার, ফালকাওরা বুকের ভিতর ক্যানারি হলুদ রঙ লিখে রেখে দিয়েছিল।
ব্যক্তিগত নৈপুণ্য অবশ্যই ছিল, কিন্তু তার সঙ্গে ছিল চোখের আরাম। জেতেনি কারণ জেতার জন্য ডিফেন্সের দরকার ছিল এটাই ভাবেনি। আর গোলকিপারটাকে তো মনে হয় স্পেনের ফ্লাইটে ওঠার আগে রিও এয়ারপোর্ট থেকে তুলে নিয়ে এসেছিল। সত্যি বলতে কি ব্রাজিলের সোনার সময় শুরু হয় ১৯৮৮-তে। ৯০-এর দুর্ঘটনা সত্ত্বেও।
যদিও ২০০২ পরবর্তী ব্রাজিল বারবার সম্ভাবনা জাগিয়েও গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে জিততে না পারার জন্য বিশ্বস্তরের সাফল্য পায়নি। ৯৪, ৯৮ বা ২০০২ যদি দেখি তাহলে নকআউটে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ জিতেছে তারা। ৯৪-তে কোয়ার্টারফাইনালে নেদারল্যান্ডস। ৯৮-তে কোয়ার্টার ফাইনালে ডেনমার্ক সেমিতে নেদারল্যান্ডস আর ২০০২ সালে কোয়ার্টারে ইংল্যান্ড। ফাইনাল ওভাবে দেখি না, কারণ ফাইনালে যা কিছুই হতে পারে।
সে যাক, ২০০২-এর পরে ব্রাজিল বিশ্বকাপের নকআউটে কোনও ইউরোপীয় দলের বিরুদ্ধে জেতেনি। এবং ঐ গুরুত্বপূর্ণ দ্বৈরথ ২০০৬ সালে ফ্রান্স, ২০১০-এ নেদারল্যান্ডস বা ২০১৮ সালে বেলজিয়ামের কাছে হারে। ২০১৪রটা ধরি না। কারণ যে মুহূর্তে সিলভাহীন ব্রাজিল দুইজন বামপ্রান্তিক স্টপার এবং নেইমারের ছবি নিয়ে সেমিফাইনাল খেলতে নামে, সে মুহূর্তেই তারা হেরে গেছে। ৭-১ কে অত্যুক্তি বলাটা ভুল নয়, তবে ২ গোলে হলেও ম্যাচ হারত তারা।
২০০৬ সালে সিসিনহো জিলবার্তো ফর্মে থাকতেও অভিজ্ঞতার জন্য শ্লথ হয়ে যাওয়া কাফু রবার্তো কার্লোসের উপর ভরসা রাখায় গড়বড়টা হল। তার উপর বিশ্বের সেরা ফুটবলার রোনালদিনহো ক্লান্ত হয়ে পড়া, আদ্রিয়ানোর বাবা মারা যাবার পর ফর্ম পড়ে যাওয়া, রোনালদোর থাইরয়েডজনিত অসুখে মোটা হয়ে যাওয়া এগুলো তো ছিলই।
২০১০-এর একটা পনেরো মিনিটের স্পেল। ব্রাজিলের বাঁদিকে মিশেল বাস্তোস বলে এক অখ্যাত সাইড ব্যাক থাকা এবং রবেন দিক বদলে ডানপ্রান্তে আসা। ম্যাচ খতম করে দেয়।
২০১৮ সালে আবার ক্যাসিমেরোর না থাকাটা ম্যাটার করে যায়। ফার্নান্দিনহো লুকাকুর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছিল না। আর লুকাকুকে বেলজিয়াম কোচ মার্তিনেজ ডানদিকে ঠেলে দিয়ে ফলস নাইনে ডি ব্রুইনাকে নিয়ে আসাটাই বাজিমাত করে। তবে তা প্রথম ৪৫ মিনিটে। তিতে যতক্ষণে চাল বোঝেন ততক্ষণে সর্বনাশ হয়ে গেছে।
এমনিতেও ফর্মে থাকা ফেলিপে লুইসের জায়গায় নামের ভারে মার্সেলোকে খেলানোটাও কাল হয়। তবে ফিরে এসে সেকেন্ড হাফে চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি ব্রাজিল। লুকাকুকে ধরার জন্য মিরান্ডা এগিয়ে আসে, নিজেদের হাফে ম্যান মার্কিং-এ আটকে দেয়। ফার্নান্দিনহোকে লুকাকু জমি ধরালেও ফার্নান্দিনহো দ্বিতীয়ার্ধে ডি ব্রুইনাকে নড়তে দেয়নি।
যদিও হ্যাজার্ড স্বপ্নের ফর্মে ছিল, কিন্তু বেলজিয়াম যে মাত্র এক গোল খায় তার কারণ তাদের ডিফেন্সে স্ক্রিন হিসাবে ফেলিইনির উপস্থিতি আর কুর্তোয়ার অমানবিক ফর্ম। নেইমারের সম্পূর্ণ ফিট না থাকাটাও কাজ হয়েছে। বিশেষত শেষ মুহূর্তে যে ডান দিকের বারের কাছ দিয়ে ঢোকাবার যে শটটা কর্তোয়া আঙুলের ডগায় বার করে দেয় সেটা ফিট এবং ম্যাচের মধ্যে থাকা নেইমার একদম কোণ দিয়ে ঢোকাতো।
বেলজিয়াম ম্যাচটাই ততপরবর্তী ব্রাজিলের ছক তৈরি করে দেয়। তিতে উইং ব্যাকদের নিয়ে যথেষ্ট সাবধানী হয়ে পড়েন। গত কোপাতেই ড্যানিলো এবং অ্যালেক্স সান্দ্রোর জায়গা বেঁধে দেওয়া ছিল। সান্দ্রো উঠতে পারছিল তখনই যখন বাঁদিকে ডগলাজ লুইজ খালি জায়গাটা পাহারা দিচ্ছিল। আর নেইমার না থাকায় কুটিনহো দশ নম্বরে খেলে এবং হেসুস, ববি ফারমিনহো ও সর্বোপরি ফ্ল্যামিঙ্গোর বাচ্চা এভার্টন সোয়ারেজের ফর্মে থাকাটা কাজের হয়ে দাঁড়ায়।
এবারে আসি এবারের কোপায়। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা লাতিন আমেরিকার দুটি দলকেই মনে হচ্ছে যে তারা ইউরোপের মৌরসিপাট্টায় হাত বসাতে পারে। বিশেষ করে ব্রাজিল।
তবে ব্রাজিলের কি সমস্যা নেই? ভয়ানক সমস্যা আছে। এক নম্বর সমস্যা ২০১৮’র ভুত তিতেকে এখনও তাড়া করছে ফলত এমার্সন রয়াল এবং রেনান লোডিকে তৈরি না করে অনেক বেশি ডিফেন্সিভ মাইন্ডেড ড্যানিলো এবং অ্যালেক্স সান্দ্রোকেই খেলাচ্ছেন। যদিও রেনান লোডি কিছুটা প্লেয়িং টাইম পাচ্ছেন আজকাল তবুও সাইডব্যাকদের উপরে উঠে আক্রমণের থেকে নিচে নেমে ডিফেন্সের দিকেই বেশি নজর দেওয়া।
গার্দিওলার ম্যান সিটিতে খেলতে খেলতে জেসুস যেন গোলে বল মারতেই ভুলে গেছে। এবং সাধারণ উইঙ্গার হিসাবে খেলছে। যাকে রোনালদোর উত্তরসূরি হিসাবে ২০১৭ সালে দেখা হয়েছিল তার এই পরিণতি চোখে দেখা যায় না। তবু ডানদিকে একটা ছটফটানি ধরে রাখে এবং দশ নম্বর রোলে নেইমারের সঙ্গে ভালোই সঙ্গত করছে। তবে সবথেকে ভোগাচ্ছে বোধহয় সত্যিকারের নাম্বার ৯ না থাকা। ববি ফার্মিনহো ক্লাব দলের মতোই জাতীয় দলেও নেতিয়ে পড়েই খেলছে।
ফলে ফক্স ইন দ্য বক্সের উপস্থিতি মিস করছে ব্রাজিল। আর রিচার্লিসন বিশ্বমানের এখনও হয়ে ওঠেনি। বারবোসা বা গ্যাবিগোলও ছটফট করছে বটে, কিন্তু ঠিক সময়ে বলের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। ফল স্বরূপ দুই পিভটে খেলতে গিয়েও তিন স্ট্রাইকারকে একদম উপরে ছড়িয়ে রাখতে হচ্ছে। এবং নেইমারকে একই সঙ্গে ১০ নম্বর এবং ফলস নাইন খেলতে হচ্ছে। তিতে যদি সত্যিই সিদ্ধান্তে আসেন যে তিনি স্ট্রাইকার নিয়ে খেলবেন না এবং কুটিনহো ফিট হলে নেয়মারের সঙ্গে কুটিনহোকে ফলস নাইনে ও ১০ নম্বরে খেলিয়ে দেবেন তাহলে হয়তো কিছুটা অন্যকিছু হতে পারে। নচেৎ নহে।
এবার কথা হল কোপা। হ্যাঁ, আমি ব্রাজিল সমর্থক হলেও চাই ফাইনাল আর্জেন্টিনা পড়ুক। কারণ একমাত্র ওরাই ব্রাজিলকে কিছুটা হলেও চ্যালেঞ্জ জানাতে সক্ষম। এই কোপা যদি ব্রাজিল আর্জেন্টিনার কাছে হেরেও যায় তাতে কিছু নয়। একটা বিশ্বজয়ী সিস্টেম তৈরি করতে গেলে ওরকম একটা দুটো দুর্ঘটনা, অঘটন মেনে নেওয়াই যায়। আর্জেন্টিনার সমস্যা ডিফেন্স।
আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্ক্যালোনি সামর্থ অনুযায়ী দল সাজাচ্ছেন। ডিফেন্সিভ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে পাপু গোমেজকে একটা উইং-এ রেখে নয় নম্বরে লাউতারো বা আগুয়েরো। আর মেসিকে দশ নম্বরে খালি জায়গায়। মিডফিল্ডে রড্রিগো ডি পল, জিওভানি লে সোলসো এবং লিয়ান্দ্রো পারাদেস। তিনজনেই ইতালীয় বংশোদ্ভূত এবং তিনজনেই ভালো টেকনিকের অধিকারী এবং পাসিং গেম খেলতে অভ্যস্ত।
কিন্তু, তিনজনের খেলার ধরণই প্রায় এক। ফলে ডিফেন্সিভ পিভট বা অ্যাটাকিং পিভট না থেকে তিনটে নাম্বার ৭ নিয়ে খেলছে আর্জেন্টিনা। আর ডিফেন্স? ওটামেন্ডি শ্লথ হয়েছে। তাগ্লেফিকো, মলিনা, আকুনাদের বলে দেওয়া রয়েছে যে উইং দিয়ে এগোবে না কারণ ওই ফাঁকা জায়গায় যদি বিপক্ষের উইং দিয়ে আক্রমণ শানানো হয় তাহলে কিছু করনের থাকব না।
মেসি মোটামুটি এই সিস্টেমে মানিয়ে নিয়েছেন। ডি মারিয়া নামলে এক কথা না হলে মাঠের মাঝখান দিয়ে আক্রমণ এবং বাঁদিকে ভারি রাখার একটা প্রবণতা লক্ষণীয়। ব্রাজিল এটা ভাঙতেই পারে। কারণ নেয়মারের ফর্ম এবং রিচার্লিসন বাঁ-দিক দিয়ে লোডির সঙ্গে দুর্দান্ত বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে। কিন্তু ডান দিক? সেখানে তো আবার কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো জেসুস লাল কার্ড দেখে বসে।
ফলে এভারটন সোয়ারেস বা ভিনিসিয়াসকে অনভ্যস্ত জায়গায় খেলাতে হবে। লিডসের রাফিনহাকে কেন যে তিতে নিলেন না উনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে ও থাকলে ব্যাকআপ রাইট উইঙ্গারের জায়গাটা নিয়ে চিন্তা থাকত না। আর স্বাভাবিকভাবেই ববি ফারমিনহোকে দেখে মনে হচ্ছে আর খেলার ইচ্ছে নেই। এই অবস্থায় ব্রাজিলের নিজের শক্তি বুঝে নিতেই লিও মেসির মুখোমুখি হতে হয়। আর ১৯৯৩-এর কোপার পর আর্জেন্টিনার কোনও ট্রফি নেই। এই জায়গাটা থেকে মেসিরা ঝাঁপাবে আশা করা যায়।
ব্রাজিলের এই কোপা নয়, বরং ২০২১-এর যে সামান্য সম্ভাবনা আছে সেটার জন্যই ঝাঁপানোর দরকার আর সেই কারণেই ফাইনালের মত ম্যাচে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনাকে দরকার। কে বলতে পারে, ইউরোপের এই হেঁচকে হেঁচকে ছকের খেলার বাইরে গিয়ে একটা দুর্দান্ত ফ্রি-ফ্লোইং ফুটবল ম্যাচের সাক্ষী আমরা হব না এগারো তারিখ? যদিও দক্ষিণ আমেরিকার হিসাবে তখনও ১০ জুলাইই থাকবে।
কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্র্যাপবুক