প্রায় দেড় বছর পর ফিরে ১৫০ রানের অসাধারণ ইনিংস, তার টেস্ট ক্যারিয়ারের পুনর্জন্ম হওয়ার কথা এই টেস্ট দিয়ে। অথচ তিনি লিখে ফেললেন এপিটাফ!
একটু অবশ্য থমকে যেতে যেতে হচ্ছে এখানে। এখনও তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেননি। পঞ্চম দিনের খেলা শুরুর আগে দল থেকে তাকে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়া হয়েও দিন শেষে অধিনায়ক মুমিনুল বললেন বিভ্রান্তিকর নানা কথা। কী কারণে এই লুকোচুরি-রাখঢাক কিংবা পর্দা, সময়ে উত্তর মিলতে পারে। তবে বাংলাদেশের ৫৫তম টেস্ট ক্রিকেটার আর টেস্ট খেলবেন না, এটা মোটামুটি নিশ্চিত।
অভিষেক টেস্টে ৮ উইকেট ছিল তার, অভিষেকে দেশের বাইরে এখনও বাংলাদেশের সেরা বোলিং। এক ইনিংসে ছিল ৫ উইকেট। অভিষেক টেস্টে ইনিংসে ৫ উইকেট আর শেষ টেস্টে সেঞ্চুরি – শুরু-শেষের এমন যুগলবন্দী টেস্ট ক্রিকেটের ১৪৪ বছরের ইতিহাসে আর নেই একজনেরও।
মনে রাখার মতো পারফরম্যান্স আরও কিছু আছে। তার প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি, হ্যামিল্টনে আটে নেমে ১১৫। ৯ বছর পর হ্যামিল্টনেই আবার ১৪৬।
২০১০ সালে হ্যামিল্টনে সেঞ্চুরির ঠিক আগের টেস্টেই মিরপুরে আটে নেমে এক দুর্দান্ত ইনিংস খেলেও একটুর জন্য সেঞ্চুরি পাননি। হরভজনের বলে রুবেল হোসেন বোল্ড হয়ে যান ব্যাট-প্যাডের ফাঁক গলে। মাহমুদউল্লাহ অপরাজিত থেকে যান ৯৬ রানে।
ভারতের বিপক্ষে ওই সিরিজের প্রথম টেস্টেও আটে নেমে খেলেন ৬৯ রানের ইনিংস। দুই টেস্টে তাকে দেখে সুনিল গাভাস্কার বলে দিলেন, ‘বিশ্বের সেরা ৮ নম্বর ব্যাটসম্যান।’ গাভাস্কার তো জানতেন না, মাহমুদউল্লাহ আটের ব্যাটসম্যান নন!
হ্যামিল্টনে মার্টিন-সাউদি-টাফি-ভেটোরিদের খেলে ১১৫ ও ৪২ রানের দুটি ইনিংসের পর দেশে ফিরে প্রমোশন পেলেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে পাঁচ নম্বরে। প্রথম ইনিংসেই ফিফটি। পরের টেস্টে আরেকটি। বাকি দুই ইনিংসে ব্যর্থ। খুব ভালো নয়। তবে বলছি ২০১০ সালের কথা। দুই টেস্টে দুই ফিফটিও তখন বাংলাদেশের জন্য কম নয়।
কিন্তু ক’দিন পর ইংল্যান্ড সফরেই আবার অবনমন। হ্যামিল্টনে সেঞ্চুরি করে এলেও ইংলিশ কন্ডিশনে মিডল অর্ডারের ভরসা রাখা হলো না। আবার আটে-নয়ে। সিরিজে ব্যর্থ।
বাংলাদশ আবার টেস্ট খেলল ১৪ মাস পর, জিম্বাবুয়েতে। মাহমুদউল্লাহ এবার ফিরলেন পাচেঁ-ছয়ে। ব্যর্থ দুটিতেই…
দেশে ফিরে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে এক টেস্টে সাত-আটে, আরেক টেস্টে চারে খেলানো হলো। পরের সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আবার আটে।
চলতে থাকল টানাহেঁচড়া। তিনি কখনও ফিফটি করেন। কখনও ২০-৩০ করে আউট হন। ব্যাটিং অর্ডারে থিতু জায়গা পান না। ধারাবাহিক পারফরম্যান্সও হয় না।
অবশেষে তার প্রতি কাঁধে নির্ভরতার হাত রাখা হলো ২০১৪ সালে। সেবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে দুই টেস্টে পাঁচ-ছয়ে নেমে দুটি ফিফটির পর ২০১৭ সালের ভারত সফর পর্যন্ত টানা খেলানো হলো চার নম্বরে।
ওই সময়টা তিনি কাজে লাগাতে ব্যর্থ হলেন। রান তিনি করেছেন, কিন্তু বড় রান নয়। টেস্টে অনেক সময় রান করতে না পারা যতটা ব্যর্থতা, থিথু হয়ে আউট হওয়া আরও বড় ব্যর্থতা।
ওই সময়টায় ২২ ইনিংসে তার ৫ ফিফটি। কিন্তু সর্বোচ্চ ৭১। আরও ১০ বার তিনি ২৫ পেরিয়েও আটকে যান ফিফটির আগে। নিজের টেস্ট ক্যারিয়ারটাকে দারুণ রূপ দেওয়ার, পোক্ত করার, নিজের মতো করে গড়ার বড় সুযোগ তিনি তখন হারিয়েছেন।
এরপরও মিডল অর্ডারে সুযোগ পেয়েছেন। কখনও পাঁচ, কখনও ছয়। একটি দুটি ফিফটি করেছেন, বাকিগুলোয় ব্যর্থ। টেস্ট দলে জায়গা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, বার দুয়েক বাদ পড়ার দুয়ারে গেছেন, তখনই ভালো কোনো ইনিংস খেলেছেন।
২০১৮ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেঞ্চুরিটি যেমন। ১১ ইনিংস ফিফটিবিহীন থাকার পর বলা যায় শেষ সুযোগ সেঞ্চুরি। দীর্ঘ ৮ বছর পর তার টেস্ট সেঞ্চুরি।
সেই টেস্ট থেকে চার টেস্টের মধ্যে তিন সেঞ্চুরি। মনে হলো, অনেক দেরিতে হলেও বুঝি হয়ে উঠছেন টেস্ট রানের রথে। কিন্তু আবারও হয়ে গেলেন উল্টো রথের যাত্রী। টানা ৮ ইনিংসে ফিফটি নেই। যার শেষটি রাওয়ালপিন্ডিতে সেই হ্যাটট্রিক ডেলিভারির ব্যাখ্যাতীত শট।
এরপর বাদ পড়া। কোচের সঙ্গে মানসিক দূরত্বের গুঞ্জন। কোচ তখন তাঁকে সরাসরি বা নির্বাচকদের কি বলেছিলেন, জানি না। তবে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘কোনো ক্রিকেটারকে খেলা ছাড়তে বলা আমার কাজ নয়। খুব দ্রুতই হয়তো সে ফিরছে না। কিন্তু তার মতো একজন ক্রিকেটার, যে কিনা এত বছর ধরে খেলেছে, এটা ঠিক করার অধিকার তার প্রাপ্য যে কখন দেশের হয়ে খেলা থামাতে চায়। সেই বেনিফিট অব ডাউট আমি তাকে দিচ্ছি।’
মাহমুদউল্লাহ এত বছর টপ লেভেলে খেলেছেন। চ্যালেঞ্জটা তিনি নিয়েছেন। অপেক্ষা করেছেন সুযোগের। প্রায় দেড় বছর পর সেই সুযোগ এলো নাটকীয়ভাবে। তিনি কাজে লাগালেন দারুণভাবে। এরপর আরও নাটকীয় এই অবসর।
জানি না, তার ভেতরে কী চলছে। বাংলাদেশের পরের টেস্ট নভেম্বরে, পাকিস্তান আসবে এখানে। যে দলের বিপক্ষে বাদ পড়েছিলেন, সেই দলের বিপক্ষে দারুণ কিছু করে বিদায় নিতে পারলে আরও উপযুক্ত হতো কিনা, এটা মনে হতে পারে। আবার, এটাও মাথায় রাখতে হবে, তিনি আমাদের টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক। সামনে অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড, ইংল্যান্ডের সঙ্গে একগাদা টি-টোয়েন্টি ও এরপর বিশ্বকাপ। আগামী বছর আরেকটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ – কে জানে, তিনি এসব ব্যস্ততা ভাবছেন কিনা।
অনেক প্রশ্ন-কৌতূহল আছে। জানি না, সেসব মিটবে কতটা। তবে তার নিজের হয়তো বড় একটা স্বস্তি আছে। নিজের চাওয়ায়, মাঠ থেকে বিদায় নিয়েছেন মাথা উঁচু করে। টেস্টে তার রেকর্ড, পরিসংখ্যান, পারফরম্যান্স। এসব শেষ পর্যন্ত অপূর্ণতার গল্পই হয়ে রইল। তবে রঙিন পোশাকের গল্প তো এখনও বাকি। সেসব নাহয় আরও রঙিন হবে!
– ফেসবুক থেকে