তিন ফেব্রুয়ারি, ২০০২। মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়েতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ জিততে শেষ ওভারে ভারতের দরকার ১১ রান, হাতে দুই উইকেট। বোলিংয়ে অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ। প্রথম চার বল থেকে পাঁচ রান নিলেও এক উইকেট হারিয়ে বসে ভারত। শেষ দুই বলে দরকার ছয় রান, হাতে মাত্র এক উইকেট।
এক ইয়োর্কারে জাভাগাল শ্রীনাথকে বোল্ড করেই জার্সি খুলে দৌড় শুরু করেন ফ্লিনটফ! ভারতকে পাঁচ রানে হারিয়ে সিরিজ ৩-৩ সমতা। ডাগ আউটে ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির আক্ষেপভরা চেহারা ক্যামেরার নজর এড়ায়নি! হার সইতে না পেরে উঠে চলে গেলেন সোজা ড্রেসিং রুমে। তিনি দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৮০ রান করলেও, বাকিদের ব্যর্থতায় সেদিন জিততে পারেনি ভারত। এই কষ্টটা বুকে পাথর চেপে রেখে দিয়েছিলেন গাঙ্গুলি! অপেক্ষা প্রতিশোধের!
১৩ জুলাই, ২০০২। লর্ডসে ন্যাটওয়েস্ট সিরিজের ফাইনালে আবারো ইংল্যান্ডের মুখোমুখি ভারত। শেষ ওভারে ভারতের জয়ের জন্য প্রয়োজন মাত্র ২ রান! আগের ওভারের শেষ বলে চার মেরে জয় প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেছিলেন মোহাম্মদ কাইফ। শেষ ওভারে বোলিংয়ে ফ্লিনটফ, আর স্ট্রাইকে জহির খান। প্রথম দুই বল ডট দিলেন ফ্লিনটফ!
লর্ডসের ড্রেসিং রুমের ব্যালকনিতে বসে সৌরভ গাঙ্গুলির চোখে হয়তো ভাসছিলো কিছুদিন আগে ঘরের মাঠে সেই হারটা। পরের বলেই অফে ঠেলে দিয়েই এক রানের জন্য দৌড় দিলেন জহির। বল কুড়িয়ে ব্যাটিং প্রান্তে ডিরেক্ট থ্রো করতেই বল স্টাম্প মিস করে! ওভার থ্রো-তে দৌড়ে আরেক রান নিয়ে জয়ের উল্লাসে মেতে উঠে জহির-কাইফরা।
আরেকদিকে লর্ডসের ব্যালকনিতে জামা খুলে ঘুরাতে থাকেন সৌরভ। এ যেনো ফ্লিনটফের প্রতি প্রতিশোধের বার্তা। পাঁচ মাসের আগের ক্ষতটা মুছে দিয়ে প্রতিশোধের আগুনটাও নেভান সৌরভ। যেই ফ্লিনটফের বলে দেশের মাটিতে পরাজয়! সেই ফ্লিনটফের বলেই লর্ডসে জয় ছিনিয়ে নেয় ভারত। সৌরভের জামা ঘুরানোর সেই ঐতিহাসিক মূহুর্ত আজও ক্রিকেট ইতিহাসে অন্যতম সেরা মূহুর্ত হিসেবে পরিচিত।
১৯৮৩ সালে কপিল দেবের অধিনায়কত্বে প্রথমবার বিশ্বকাপ জয়ের পর টানা দশ ফাইনালে হারে ভারত! ভারতের ফাইনাল জুজুটা কাটলো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এক ঐতিহাসিক জয় দিয়েই। সৌরভ গাঙ্গুলি নিজেও মনে মনে ভেবে নিয়েছিলেন আরেকটি হার অপেক্ষা করছে! কিন্তু লর্ডসে সেদিন সব বাঁধা টপকে ভারত এক ইতিহাস সৃষ্টি করে।
সেদিন লর্ডসে রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়ায় টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় ইংলিশরা। তিন দলের সিরিজে আগেই বাদ পড়ে লঙ্কানরা। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ওপেনিং জুটিতেই আসে ৪২ রান। দলীয় ৪২ রানে নিক নাইট ফিরলে শুরু হয় মার্কাস ট্রেসকোথিক ও অধিনায়ক নাসের হুসেইনের ব্যাটিং দাপট। দ্বিতীয় উইকেটে দু’জনে মিলে দুই প্রান্তে সহজেই রান তুলতে লাগলেন।
অনিল কুম্বলে, জহির খানরা কেউই দমাতে পারছিলেন না তদের। একপ্রান্তে দারুণ ব্যাটিং করে মার্কাস ট্রেসকোথিক তুলে নিলেন দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি, আরেক প্রান্তে নাসেরের ফিফটি। দ্বিতীয় উইকেটে দু’জনে মিলে জুড়ে দিলেন ১৮৫ রানের এক দানবীয় জুটি! ১৭৫ বলে ১৮৫ রানের অনবদ্য সেই জুটির অবসান হয় কুম্বলের বলে ট্রেসকোথিক বোল্ড হয়ে ফিরলে। ১০০ বলে ১০৯ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলে বিদায় নেন ট্রেসকোথিক।
এরপর তৃতীয় উইকেটে অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের সাথে ৮০ রানের জুটির পথে অধিনায়ক নাসের হুসেইন তুলে নেন অসাধারণ আরেকটি সেঞ্চুরি। দলীয় ৩০৭ রানে ৩২ বলে ৪০ রানের অসাধারণ এক ইনিংস খেলে বিদায় নেন অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ।
এরপর ব্যক্তিগত ১১৫ রানের ইনিংস খেলে আউট হয়ে ফেরত যান নাসের হুসেইনও! শেষ দিকে দ্রুত উইকেট পড়লেও শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৫ উইকেটে ৩২৫ রান সংগ্রহ করে ইংলিশরা। ভারতের পক্ষে ১০ ওভারে ৬২ রানে সর্বোচ্চ ২ উইকেট শিকার করেন পেসার জহির খান।
একে তো বিগত দশ ফাইনালে হার! তার উপর লর্ডসের মাটিতে ৩২৬ রানের বিশাল লক্ষ্যমাত্রা। সব মিলিয়ে ভারত প্রথম ইনিংসের পরই কিছুটা ব্যাকফুটে। তবু এক বুক আশা নিয়ে ব্যাটিংয়ে নামলেন বীরেন্দ্র শেবাগ ও ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি। অন্যরা কে কি ভেবেছিলেন সেটা জানি না; তবে সৌরভ যে মাথায় জয়ের ভূত সাথে করেই নেমেছিলেন সেটা সন্দেহ নেই। শুরুটাও হয়েছিল একদম স্বপ্নের মতো! যেনো সবকিছুই একদম সাজানো!
শেবাগ-গাঙ্গুলির তান্ডবে ১৪ ওভারেই দলের রান বিনা উইকেটে ১০৩। শুরু থেকেই ইংলিশ বোলারদের উপর চড়াও হন এই দুই ওপেনার। তখন মনে হচ্ছিল ভারত সহজেই হয়তো জয় পাবে। এরপরই হঠাৎ লর্ডসের বুকে ইংলিশদের ভয়াল আক্রমণ! দলীয় ১০৬ রানে ৪৩ বলে ৬০ রান করে আউট হন গাঙ্গুলি। এরপর দলের সাথে ৪০ রান যোগ করতেই দলীয় ১৪৬ রানেই ভারতের পাঁচ ব্যাটসম্যান প্যাভিলিয়নে!
গাঙ্গুলির পর শেবাগ ৪৫ রানে ফিরলে দীনেশ মোঙ্গিয়া, শচিন, দ্রাবিড়রা ছিলেন আসা যাওয়ার মিছিলে! একটু আগেই জয়ের স্বপ্ন দেখা ভারত তখন বড় পরাজয় ঠেকাতে ব্যস্ত। অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি নিজেও ম্যাচে তখন কোনো আসা রাখেননি জয়ের। স্কোরবোর্ডে ১৪৬ রানে তখন ভারতের ৫ উইকেট নেই! উইকেটে তরুন যুবরাজ সিং ও মোহাম্মদ কাইফ।
সেখান থেকেই শুরু হয় রূপকথার এক গল্প, এক স্বপ্নগাঁথা, এ ঐতিহাসিক কাব্যের।
ধীরে ধীরে উইকেটে সেট হয়ে রান বের করতে লাগলেন যুবরাজ-কাইফ। জুটি যত বাড়তে লাগলো ভারতের আশার আলোটা আবারো বাড়তে লাগলো। সৌরভ তখন লর্ডসের ড্রেসিং রুমের ব্যালকনিতে বসা। নিজেও উঠবেন না, এমনকি সবাইকেও নড়তে নিষেধ করলেন।
তাঁর চোখে হয়তো ভেসে উঠেছিলো ভারতের জয়! যুবরাজ-কাইফের ব্যাটিং দৃঢ়তায় প্রথমে পঞ্চাশ তারপর সেঞ্চুরির জুটি! ম্যাচে বড় ব্যবধানে হারতে বসা ভারত তখন ম্যাচ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। দু’জনেই তুলে নেন অসাধারণ ফিফটি। মোহাম্মদ কাইফ আর যুবরাজ সিংয়ের কাউন্টার অ্যাটাকে ম্যাচে তখন আধিপত্য বিস্তার করে ভারত।
দলীয় ২৬৭ রানে ব্যক্তিগত ৬৩ বলে ৬৯ রানের ইনিংসের পর বিদায় নেন যুবরাজ সিং। এরপর যুবরাজকে তুলে নিয়ে ইংলিশদের ম্যাচে ফেরান পল কলিংউড। সপ্তম উইকেটে হরভজন সিংকে সাথে নিয়ে ৩৭ বলে ৪৭ রানের অনবদ্য এক জুটি গড়েন কাইফ! ম্যাচ তখন সম্পূর্ণ ভারতের দখলে। শেষ ৩ ওভারে প্রয়োজন মাত্র ১৪ রান, হাতে চার উইকেট। লর্ডসের গ্যালারিতে ভারত সমর্থকদের উল্লাস তখন চলছে।
নাটকের শেষ পর্বের শুরুটা এখানেই! ৪৮ তম ওভারে বোলিংয়ে ছিলেন ফ্লিনটফ। ওই ওভারে মাত্র তিন রান দিয়ে ২ উইকেট তুলে নিয়ে ম্যাচে উত্তেজনার সৃষ্টি করেন ফ্লিনটফ। শেষ ২ ওভারে ভারতের দরকার ১১ রান, ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ২ উইকেট। তখনো গাঙ্গুলির কপালে চিন্তার রেখা! এবার কি পারবে?
ইংলিশদের জন্য আতঙ্ক আর ভারতের জন্য ভরসা – মোহাম্মদ কাইফ তখনো ক্রিজে! ৪৯ তম ওভারে প্রথম পাঁচ বল থেকে আসে পাঁচ রান। সমীকরণ ৭ বলে ৬ রান। ম্যাচে টান টান উত্তেজনা। শেষ বলে স্ট্রাইকে কাইফ! অফ সাইডে সজোরে ব্যাট চালালেন কাইফ। কিন্তু মিস হিটে উইকেটের পেছন দিয়ে বাউন্ডারি! ব্যাস, এই বাউন্ডারিতেই যেনো ম্যাচ শেষ। এরপর শেষ ওভারে ফ্লিনটফের বলে ২ রান নিয়ে এক ঐতিহাসিক জয় ছিনিয়ে নেয় ভারত।
সবকিছুর পরেও যেই মানুষটার অবদান ঢাকা পড়ে ছিলো তিনি হলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। ঠিক আগের সিরিজেই ফ্লিনটফের কাছে যখন মাথা নত করে ভারত! সেই ম্যাচেও ৮০ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন সৌরভ। এরপর লর্ডসে ইংলিশ বধের কাব্য রচনার দিনেও ৬০ রানের অসাধারণ এক ইনিংস খেলেন তিনি। সেদিন সৌরভ-শেবাগের ব্যাটেই ভারত স্বপ্ন দেখেছিলো এ জয় অসম্ভব নয়।
লর্ডসের গ্যালারিতে ইংলিশ সমর্থকদের পিন পতন নিরবতা। ভারতীয়দের বাঁধ ভাঙা উল্লাস। না আজ ফ্লিনটফের জার্সি উড়েনি, আজ সৌরভের কপালে চিন্তার রেখে লেগে থাকেনি। সৌরভ আক্ষেপ নিয়ে উঠে চলেও যাননি। তিনি জয় করেছেন! তিনি জার্সি উঁচিয়ে ধরেছেন! এই জয় প্রতিশোধের। এই জয় সম্মান। সেদিন ট্রফি নিয়েই লর্ডস থেকে ভারত পাড়ি দেয় সৌরভ বাহিনী! ইতিহাসের অন্যতম সেরা ওয়ানডে হিসেবেই স্মৃতি হয়ে থাকবে চিরকাল।