একটা কুইজ দেই।
দুরত্বটা সাড়ে ২ হাজার কিলোমিটারের। এক জায়গায় দুই দল মিলে করলো ৩৯৭ রান। আরেকটা জায়গায় করলো ৪৩৩ রান। বলতে হবে, কোনটা কোন ফরম্যাটের ম্যাচ?
ক্রিকেটের একদম শেষ মুহূর্তের খবর না রাখলে – এই প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারবেন না। একটু হিন্ট দেই – প্রথম ঘটনাটা হারারেতে হয়েছে – দ্বিতীয়টা হয়েছে ট্রেন্টব্রিজে।
এবার মনে হয় প্রশ্নটা ‘কমন’ পড়েছে। উত্তরও বুঝে ফেলেছেন। প্রথমটা ওয়ানডে আর দ্বিতীয়টা টি-টোয়েন্টি। যদিও, টি-টোয়েন্টিতে আজকাল দু’দল মিলে চারশ করাটা বেশ নিত্যদিনের কাজ। এক আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে এর চেয়েও বেশি রান হয়েছে আরো ১১ বার। তারপরও, এটা আধুনিক ধুন্ধুমার ক্রিকেট যুগের এক রঙিন বিজ্ঞাপন।
ওয়ানডে সিরিজে ৩-০ তে হোয়াটওয়াশ। যে দলের মূল স্কোয়াডের সবাই কিনা ছিলেন আইসোলেশনে। সিরিজের দুইদিন আগে করোনার হানায় হঠাৎ করেই নতুন দল ঘোষণা করে ইংল্যান্ড এবং ওয়ালস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি)। যেখানে নয় জনই ছিলেন নতুন মুখ! তবু, এই নব্য দলের সাথে পূর্ণ শক্তির দল নিয়েও ওয়ানডে সিরিজে হতাশাজনক পারফরম্যান্স দেখায় পাকিস্তান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সহ বিভিন্ন মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড়! টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে বোর্ডের দিকেও উঠছিলো সমালোচনার তীর।
এরপর টি-টোয়েন্টি সিরিজ। ইংল্যান্ডের একাদশে থাকবেন দলের নিয়মিত খেলোয়াড়েরা। অনেকটা খর্ব শক্তির দলের সাথে নাকানিচুবানি খাওয়া পাকিস্তান ইংল্যান্ডের পূর্ণ শক্তির দলের সামনে কতটা পেরে উঠবে সেটা নিয়েই ছিলো বেশ সংশয়। এসব পাশ কাটিয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টিতে দুর্দান্ত জয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে সফরকারী পাকিস্তান। যেই পাকিস্তান দল ওয়ানডে সিরিজে দুইবার দলীয় রান ২০০ পেরোতে ব্যর্থ হয়েছে সেই পাকিস্তান কিনা প্রথম টি-টোয়েন্টিতেই তাদের ইতিহাসের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড গড়লো! তাও আবার ইংল্যান্ডের পূর্ণ শক্তির বিপক্ষে!
ন্যটিংহামের ট্রেন্টব্রিজে টসে হেরে প্রথমে ব্যাটিংয়ে নামে পাকিস্তান। শুরু থেকে ব্যাট হাতে ঝড় তুলেন দুই ওপেনার মোহাম্মদ রিজওয়ান ও বাবর আজম। ইংলিশ বোলারদের বেঁধরক মেরে ওপেনিং জুটিতেই দু’জনে মিলে করেন ১৫০ রান! মাত্র ১৪.৪ বলেই দলীয় রান ১৫০ পূর্ণ করে পাকিস্তান। এ যেনো এক অন্য পাকিস্তান!
বাবর আজম-রিজওয়ানদের সামনে পাত্তাই পাচ্ছিলেননা ইংলিশ বোলাররা। দু’জনেই তুলে নেন দুর্দান্ত ফিফটি। এরপর দলীয় ১৫০ রানে রিজওয়ান ফেরেন ৪১ বলে ৬৩ রানে। এরপর ব্যাটিংয়ে নেমেই ঝড় তুলেন শোয়েব মাকসুদ! ৭ বলে ১৯ রানের ছোট্ট ডায়নামিক ইনিংস খেলে বিদায় নেন তিনিও। মাকসুদের পর দ্রুত বিদায় নেন বাবরও। ৪৯ বলে ৮৩ রানের অসাধারণ এক ইনিংস খেলেন বাবর।
এরপর শেষদিকে ফখর জামানের ৮ বলে ২৪ আর মোহাম্মদ হাফিজের ১০ বলে ২৪ রানের ক্যামিওতে নির্ধারিত ২০ ওভারে ২৩২ রান করে সফরকারীরা। ইংলিশদের পক্ষে ৪ ওভারে ৩৯ রানে ১ উইকেট নেন ডেভিড উইলি।
২৩৩ রানের বিশাল লক্ষ্যমাত্রা! তবে উইকেট একদম ফ্লাট। বোলারদের জন্য বিশেষ কিছুই ছিলো না উইকেটে। ইংল্যান্ডের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপের জন্য এই টার্গেট খুব একটা কঠিন কিছু নয় বটে। তবে পাকিস্তান কি পারবে ইংলিশ ঘাটিতে নিজেদের সামর্থ্যের খুঁটি গেড়ে জয় তুলে নিতে?
পাহাড়সম লক্ষ্যমাত্রা তাঁড়া করতে নেমে ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই শাহীন শাহ আফ্রিদির দুর্দান্ত ক্যাচে বিদায় নেন ডেভিড মালান। জনি বেয়ারস্টো ও জেসন রয় উইকেটে কিছু সময় ঝড়ের আভাস দিলেও দলীয় ৪২ রানে আউট হয়ে ফেরেন বেয়ারস্টো! এরপর এক ওভারের মাথায় আউট মঈন আলিও। মাত্র ৪৮ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে তখন বিপাকে ইংলিশরা। একপ্রান্তে জেসন রয় দ্রুত রান তুলতে ব্যস্ত! আরেকপ্রান্তে শুরু থেকেই ব্যাটে ঝড় তুলেন লিয়াম লিভিংস্টোন। দলীয় ৮২ রানে ১৩ বলে ৩২ রানে রয় ফিরলে ব্যাকফুটে চলে যায় ইংলিশরা।
ম্যাচে তখন আধিপত্য বিস্তার করেছে পাকিস্তান। এমন অবস্থায় ট্রেন্ট ব্রিজে চার-ছক্কার তাণ্ডব চালান লিভিংস্টোন। মাত্র ১৭ বলেই তুলে নেন দুর্দান্ত ফিফটি। যা ইংল্যান্ডের টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুততম। আরেক প্রান্তে ইয়ন মরগ্যান ধীরগতিতে ব্যাট চালাচ্ছিলেন। লিভিংস্টোন ঝড়ে পাকিস্তানিদের কপালে তখন চিন্তার রেখা।
এরই মাঝে আউট ইয়ন মরগ্যানও! ১৫ বলে ১৬ রান করে বিদায় নেন মরগ্যান। দলীয় রান তখন ৫ উইকেটে ১৩৩। ৫০ বলে প্রয়োজন ১০০ রান, হাতে পাঁচ উইকেট। তবু লিভিংস্টোনের ব্যাটিং ঝড় যেনো থামার কোনো লক্ষ্মণই নেই। একপ্রান্তে দাপুটে ব্যাটিং করে ৪৩ বলেই তুলে নেন সেঞ্চুরি! ইংল্যান্ডের টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে দ্রুততম সেঞ্চুরির মালিক বনে যান লিভিংস্টোন।
স্কোরবোর্ডে দলের রান তখন ১৬ ওভারে ৫ উইকেটে ১৭৭। ইংল্যান্ডের জয়ের জন্য প্রয়োজন ২৪ বলে ৫৬ রান, হাতে সেই পাঁচ উইকেট। লিভিংস্টোনের ব্যাটিংয়ে তখন এই সমীকরণ বেশ সহজই মনে হচ্ছিলো। তবে এরপরই মূহুর্তের মধ্যে ম্যাচের পরিস্থিতি পালটে দেন পাকিস্তানি বোলাররা।
১৪ রানের ব্যবধানে আউট লিভিংস্টোন, লুইস গ্রেগরি এবং টম কারান! ৯ ছক্কা ও ৬ চারে ১০২ রান করে আউট হন লিভিংস্টোন। ম্যাচ তখন পুরোপুরি পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে। শেষ ১৫ বলে প্রয়োজন ৪২ রান! হাতে মাত্র দুই উইকেট। ডেভিড উইলির ১১ বলে ১৬ রানের পরও চার বল বাকি থাকতে ২০১ রানে গুড়িয়ে যায় স্বাগতিকরা।
শাহিন শাহ আফ্রিদি ও শাদাব খান তিনটি করে উইকেট নিলেও রান বন্যার ম্যাচে ৪ ওভারে ৮ ডট বলে মাত্র ২৮ রান দিয়ে ম্যাচের অদৃশ্য নায়ক কিন্তু তরুন পেসার মোহাম্মদ হাসনাইন। পাকিস্তানি বোলারদের সুনিপুণ দক্ষতায় ট্রেন ব্রিজে অসাধারণ এক জয় ছিনিয়ে নেন বাবর আজমরা। ওয়ানডেতে খর্ব শক্তির দলের সাথে খাবি খাওয়া পাকিস্তানিরা টি-টোয়েন্টি সিরিজে পূর্ণশক্তির দলের বিপক্ষে পেলো দাপুটে জয়! সত্যিই আনপ্রেডিক্টেবল পাকিস্তান।
ম্যাচে একাধিক অনবদ্য রেকর্ড দেখেছে দু’দলই। ১৭ বলে হাফ সেঞ্চুরি ছুঁয়েছেন লিয়াম লিভিংস্টোন। আগের দ্রুততম ইংলিশ হাফ সেঞ্চুরিয়ান ইয়ন মরগ্যানকে ছাড়িয়ে গেছেন। তিনি সেঞ্চুরি করেছেন ৪২ বলে। এটা ইংল্যান্ডের ইতিহাসের দ্রুততম সেঞ্চুরি। এর আগে ডেভিড মালান ৪৮ বলে সেঞ্চুরি করেছিলেন।
বাবর আজম রেকর্ড না করলেও লিভিংস্টোনের সাথে লড়াইয়ে জিতে গেছেন। মাত্র ৫৫ টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে তিনি বিশ বার ইনিংসটাকে ৫০-এর ওপর নিয়ে গেলেন। এখানে তাঁর চেয়ে ওপরে আছেন কেবল দুই ভারতীয় – বিরাট কোহলি (২৮) ও রোহিত শর্মা (২৬)। যদিও, রোহিত শর্মা ম্যাচ খেলেছেন বাবর আজমের দ্বিগুনের বেশি (১১১), কোহলি খেলেছেন প্রায় দ্বিগুণ (৯০)।