আর্জেন্টিনার পথে পথে কয়েক পেসোর জন্য যে ছেলেগুলো খালি পায়ে ড্রিবল দেখানোর মরিয়া প্রচেষ্টা চালায়, ওইখানে ম্যারাডোনা লুকিয়ে রয়েছে।
আর্জেন্টিনার ফুটবলটাই এমন। অ্যামপ্লিচিউড মড্যুলেশনের গ্রাফ। কখনও সবচেয়ে উঁচুতে ওঠে, কখনও সবচেয়ে নিচে নামে। মাঝে বিস্তর ওঠাপড়া রয়েছে। একই অঙ্গে ভিলেন এবং ঈশ্বর। একই সঙ্গে হাসি, কান্না। মারাদোনা নাকি সেখানেই বাস করেন।
অনেকদিন গৃহবন্দী জীবন কাটানোর পর সেদিন পাড়ায় বেরিয়ে দেখি মোড়ের মাথায় চেনা জটলা। বুঝতে বাকি নেই, আলোচনা চলছে ইউরো আর কোপা নিয়েই। কাছে গিয়ে বুঝলাম, আন্দাজটা কান ঘেঁষে ফায়ার চলে গেছে। আসলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল কোপা। বস্তুত অবাকই হয়ে যোগদানের পর বোঝা গেল, তর্ক চলছে কোপার জনপ্রিয়তা নিয়ে।
নেইমারের ব্যাকহিল না মেসির বাঁ পায়ের নিখুঁত প্লেসমেন্ট – কোনটা বেশি অ্যাপিলিং। কথায় কথায় জয়দা উঠে এসে বলল, ‘কোপা তোমরা বাল বুঝছ। দেখতে রিকুয়েলমেকে, দেখতে ম্যারাডোনাকে। আমার ছ’বয়সে আমি ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ জেতা দেখেছি। ’৯০ এর কান্না দেখেছি। আজ বয়স ৪০ এর ওপরে এসে ঠেকেছে, গট ইট?’
বিস্ফোরণ। অত গাড়িঘোড়ার শব্দকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে আমাদের আড্ডার নিস্তব্ধতা। তবু কোথাও মনে হল এটাই মারাদোনা। চলে গিয়েও পাতি চায়ের দোকানের আড্ডাকেও চুপ করিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখা একটা ঈশ্বর।
আসলে আর্জেন্টিনার ফুটবল মানে একরাশ দীর্ঘশ্বাস। অনেক না পাওয়ার উপাখ্যানে ভরা। অনেক বঞ্চনা, অনেক হেরে যাওয়া। বিয়েলসা পারেননি, পেকারম্যান পারেননি, রিকুয়েলমে পারেনি, তেভেজ-মাসচেরানো-দেমিচেলিস-হার্নান ক্রেসপো, পারেনি কেউই। মেসিরও কান্না বিশ্ববাসী দেখে নিয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের মাঠে। বুয়েনার্স আয়ার্সের রাস্তায় সার দিয়ে শুধু ছবি আঁকা আছে, একদল ব্যর্থ লোকগুলোর। যারা দিয়েছে অনেক কিছু, বিনিময়ে পেয়েছে মুঠো মুঠো হেরে যাওয়ার যন্ত্রণা।
তখন আরও বেশি করে মনে পড়ে ম্যারাডোনাকে। ছিয়াশির বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার শাপমোচনের কারিগর নিজের দেশের প্রতি সদা নতমস্তক। বরাবর আইডল মেনে এসেছেন কাস্ত্রো, চে গেভেরাকে। ঐ দশজনকে কাটিয়ে গোল আসলে ফকল্যাণ্ড যুদ্ধে শত শত নিহত আর্জেন্টাইন অভিশাপকে এক নিমেষে বাস্তবায়িত করা। দেশের কর্তব্য পালনে ফুটবলকে আঁকড়ে ধরলেও, নিজের জীবনের বইটা ফেলে রেখে বুঝিয়েছে মারাদোনা একটাই হয়। একটাই হবে।
আসলে ম্যারাডোনা মানেই তো অনেক অসম্ভবের ছবি হঠাৎ সামনে চলে আসা। যেটা হবে না কোনওদিন, দুম করে সেটাই হয়ে যাওয়া। না হলে নাপোলির মতো ক্লাব আজ কোথা থেকে কোথায়! সেদিনই একটা পোস্ট চোখে পড়েছিল যে ম্যারাডোনা নাপোলির জন্য কী করেছে।
অ্যাকচুয়ালি প্রশ্নটা হওয়া উচিত ছিল যে ম্যারাডোনা নাপোলির জন্য কী করেনি! স্কুদেত্তো, সিরি এ – সেই প্রথম জুভেন্তাসকে হারিয়ে কাপ জেতা। তার আগে তুরিনে নাপোলি কখনও জুভেন্তাসকে হারাতে পারেনি। নাপোলির ম্যারাডোনা আর আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা এক নয়, আবার একই। একটা সময় বুরুচাগা, বাতিস্তা থাকলেও টিমকে টেনেছেন একা। নাপোলিতেও তাই। ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড কারেকা’কে সাইন করানোর নেপথ্যে ঐ লোকটাই।
আবার সেই ম্যারাডোনা পায়ে কাস্ত্রোর, হাতে চে’র ট্যাটু করাচ্ছেন। প্রাইভেট বোটে দাঁড়িয়ে হাভানা চুরুট ধরিয়েছেন। লাইফ ইস ফুল অফ এনজয়, অর নাথিং এলস – একটা সার সত্যকে বারেবারে পড়িয়ে গেছেন। অন্যদিকে এই মারাদোনা ডোপ কেলেঙ্কারিতে নিজেকে জড়িয়ে নিজের গায়ে ফেলেছেন কলঙ্কের দাগ।
ইতালিতে থাকাকালীন ইতালিয়ান মাফিয়া দলে জড়িয়ে পড়ার কুৎসা রটেছে তাঁর নামে। এই গোলকধাঁধার মধ্যে ঢুকে পড়ে জানতে ইচ্ছে হয় যে কোনটা আসল ম্যারাডোনা? গ্রিসের বিরুদ্ধে দূরপাল্লার শটে গোলটা ম্যারাডোনা নাকি ‘৯০ এর রাউন্ড অফ সিক্সটিনে জলে ট্র্যাঙ্কুলাইজার মিশিয়ে দেওয়াটাকে সমর্থন করা ম্যারাডোনা!
এই বহু কেন’র উত্তর আজ চাপা পড়ে আছে বেলা ভিস্তার কবরখানায়। কোথাও গিয়ে মনে হয় এটাই ম্যারাডোনা ম্যানারিজম। প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে ডিস্কোতে নেচে আসাটাই ম্যানারিজম। এভরিথিং ইস ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার। এল বিসেলেস্তের সূর্য ম্যারাডোনা, ডোপ টেস্টে পজিটিভ ম্যারাডোনা, হ্যান্ড অফ গড ম্যারাডোনা, টেরি বুচার-শিল্টনকে কাটিয়ে দৌড়নো ম্যারাডোনা – এক একটা চ্যাপ্টারই শুধু উপন্যাসের উপজীব্য।
সামান্য ফুটবলপ্রেমীও বলবে ম্যারাডোনা ভাল কোচ ছিল না। থাকলে প্রথম চান্সেই কখনও রিকুয়েলমেকে বাদ দিতেন না আর বুড়ো সেবাস্তিয়ান ভেরনকে দলে নিতেন না। অথচ ম্যারাডোনার সবচেয়ে বড় রাইভ্যালও ম্যারাডোনার ভক্ত। এটাই ম্যানারিজম। এই ধাঁধার উত্তর দেওয়া এক জন্মে সম্ভব নয়।