ডেভ হোয়াটমোর তখন এসেছেন কেবল। শ্রীলঙ্কার হয়ে বিশ্বকাপ জেতার ইতিহাসটা তখনও খুব বেশি পুরনো হয়নি। ওই সময়ে বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্বের অন্য যে কোনো দলেই হোয়াটমোর থাকার মানেই হল আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া।
এসেই নতুন এক কৌশলের ধারণা দিলেন অভিজ্ঞ এই কোচ – ‘মাল্টি স্কিলড ক্রিকেটার’। মানে হল সব কাজের কাজি। পরিচয় মূলত বোলার, কিন্তু প্রয়োজনে লোয়ার অর্ডারে চাহিদা মাফিক বাড়তি কিছু রান এনে দিতে পারেন – এমন ক্রিকেটারদের প্রাধান্য দিতেন হোয়াটমোর।
এমনই এক মাল্টি স্কিলড ক্রিকেটার ছিলেন মুশফিকুর রহমান বাবু। ডান হাতি মিডিয়াম পেসার। সাথে লোয়ার মিডল অর্ডারে ব্যাট চালানোর ক্ষমতা ছিল তাঁর। বলা যায়, টেস্ট ঘরানায় তিনিই বাংলাদেশের প্রথম পেস বোলিং অলরাউন্ডার।
বাবুর অভিষেক অবশ্য হয়েছিল হোয়াটমোরের বাংলাদেশে আসার আগেই। বয়স ভিত্তিক ক্রিকেট খেলে আসা রাজশাহীর বাবুকে ২০০১ সালের জিম্বাবুয়ে সফরের জন্য বাংলাদেশের টেস্ট দলে ডাকা হয়। সেবারই অভিষেক। তবে, অভিষেকটা নি:সন্দেহে ভুলে যেতে চাইবেন তিনি। দুই টেস্টে ১০ রান আর উইকেট শূণ্য থাকার পর তাঁকে বাদ পড়তে হয়।
ওয়ানডেতে তাঁর অভিষেকটা অবশ্য হয়েছিল আরও আগেই। ২০০০ সালের ৩০ মে ঢাকার মাটিতে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে রঙিন পোশাকের ক্রিকেটে অভিষেক হয়। সেখান থেকে জিম্বাবুয়ে সফরের ওয়ানডে দলেও ছিলেন।
সেই সময়ে একজন বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে পারফরম্যান্স খুব খারাপ ছিল না। প্রথম ওয়ানডেতে ১০ ওভার বল করে মাত্র ২০ রান দিয়ে নিয়েছিলেন এক উইকেট। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে কোনো উইকেট না পেলেও ১০ ওভারে গুণেছিলেন মাত্র ২৯ রান।
আধুনিক ক্রিকেটে এমন মিতব্যয়ী বোলিং আর দেখা যায় না বললেই চলে। ব্যাটিংয়ে প্রথম ম্যাচে করেছিলেন ৩১ রান, আর শেষ ম্যাচে ১৭ রান করে অপরাজিত ছিলেন। তবে, টেস্টে ব্যর্থতার জের ধরে তাঁর ফেরার লড়াই চললো পাক্কা আড়াই বছর। ক্যারিয়ারের ‘সেকেন্ড ইনিংস’ শুরু হল স্বয়ং হোয়াটমোরের হাত ধরে। ২০০৩ সালের নয় সেপ্টেম্বর ফিরলেন পাকিস্তানের বিপক্ষে। ৩৬ রানের অপরাজিত এক ইনিংস খেলে সেদিন তিনিই ছিলেন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক।
সেখান থেকে ২০০৪ সালের ডিসেম্বর অবধি টানা খেলেছেন। কম বেশি দুই ফরম্যাটেই কার্যকর ক্রিকেটার ছিলেন। ক্যারিয়ার শেষ করার সময় ১০ টেস্টে তিনি নিয়েছেন ১৩ উইকেট। ২৮ ওয়ানডেতে উইকেট সংখ্যা ১৯ টি। টেস্ট ও ওয়ানডেতে তাঁর রান যথাক্রমে ২৩২ ও ৩৬০।
এরপর তিনি আর ক্রিকেটাঙ্গনে নেই। নেই বলতে, একদমই তাঁর হদিস পাওয়া গেল না। প্রশ্ন আসতে পারে, হুট করে হারিয়ে যাওয়ার কারণ কি? স্রেফ ভূতুড়ে এক ইনজুরি!
স্পাইনাল ডিস্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একবার অস্ত্রোপচার করানোও হয়েছিল। কিন্তু, পুরনো ব্যাথা আবারও ফিরলে পুনরায় সার্জনের শরণাপন্ন হতে হয়। এবার ভারতীয় সার্জন জানিয়ে দিলেন, আর অস্ত্রপচার সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডেরও (বিসিবি) চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না।
কিন্তু, নিরুপায় ছিল সবাই। ২০০৮ সাল অবধি ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেছিলেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলতেন রাজশাহীর হয়ে। এরপর সব চুকেবুকে ফেললেন।
ক্রিকেট ছাড়ার পর পেশাদার জীবন শুরু করেন। এখনো তিনি বিমান বাংলাদেশের একজন কর্মকর্তা। তবে, এর মধ্যে ক্রিকেটেও ফিরেছেন। ম্যাচ রেফারি ছিলেন, কোচিংয়ে লেভেল-২ সেরে ফেলেছেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগে (বিসিএল) উত্তরাঞ্চলের ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন।
মাস্টার্স ক্রিকেট লিগ হলে এখনো তিনি ছুঁটে আসেন। দুরন্ত টেলিভিশন খুললে প্রায়ই তাঁকে বাচ্চাদের ক্রিকেট শেখানোর এক অনুষ্ঠানে দেখা যায়।
নিশ্চিত করে বলা যায়, অসময়ে বেহায়া এক ইনজুরি মাথা চাড়া দিয়ে না উঠলে হয়তো আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটা আরো লম্বা হত মুশফিক বাবুর। শেষ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ খেলার সময়ও তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৬। যে সময় থেকে একজন ক্রিকেটার আরোও বেশি অভিজ্ঞ হন, নিজের অস্ত্রগুলো আরোও বেশি শানিয়ে নেন, ঠিক তখনই ঝরে পড়েন তিনি।
হয়তো কালক্রমে তিনিই হয়ে উঠতেন, বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা এক পেস বোলিং অলরাউন্ডার, যে ‘পদ’-এর জন্য এখনো আক্ষেপ করে চলেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট।