ক্রিকেটের সবচেয়ে দুর্লভ গুণের অধিকারী হলেন অলরাউন্ডাররা। ব্যাটিং কিংবা বোলিং দুই দিকেই রয়েছে তাদের সমান পারদর্শীতা। যে কোনো এক বিভাগে খারাপ করলেও অলরাউন্ডারদের সামনে সুযোগ থাকে অন্য বিভাগে ভালো করে দলকে ম্যাচ জেতানোর।
দলে অলরাউন্ডারদের উপস্থিতি বাড়িয়ে দেয় বৈচিত্র্য এবং ম্যাচ জয়ের সম্ভাবনা। আশির দশকের চার কিংবদন্তি ইমরান খান, ইয়ান বোথাম, রিচার্ড হ্যাডলি, কপিল দেব থেকে শুরু করে হালের সাকিব আল হাসান, রবীন্দ্র জাদেজা, বেন স্টোকসরা নিজেদের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে বিমোহিত করেছেন বিশ্বজুড়ে থাকা ক্রিকেট ভক্তদের। তবে এই শতাব্দীর শুরুর দিকে পুরো বিশ্ব দেখেছে দুই অলরাউন্ডারের দাপট; তারা হলেন জ্যাক ক্যালিস এবং অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ।
সাবেক প্রোটিয়া অলরাউন্ডার জ্যাক ক্যালিসের অভিষেক ঘটে ১৯৯৫ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। অন্যদিকে, ফ্লিনটফের অভিষেক ক্যালিসের তিন বছর পরে, ১৯৯৮ সালে। ক্যালিস ছিলেন মূলত ব্যাটিং অলরাউন্ডার, তবে বল হাতেও তার দক্ষতা প্রশ্নাতীত। অন্যদিকে, ইয়ান বোথামের পর অলরাউন্ডারের জন্য হাপিত্যেশ করা ইংরেজদের শীতল পরশ বুলিয়ে আগমন ঘটে অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের যাকে ভক্তরা আদর করে ডাকে ফ্রেডি নামে।
ফ্রেডি ছিলেন মূলত পেস বোলিং অলরাউন্ডার যিনি কিনা লোয়ার অর্ডার নেমেও ব্যাট হাতে দলকে নির্ভরতা দতে সক্ষম। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই একে অন্যের সাথে সমানতালে পাল্লা দিয়েছেন দুজনে। রানসংখ্যায় ক্যালিস এগিয়ে থাকলেও উইকেটসংখ্যায় আবার এগিয়ে ছিলেন ফ্লিনটফ। র্যাংকিংয়েও চলেছে তাদের মধ্যকার ইঁদুর-বেড়াল লড়াই, এক সিরিজে ক্যালিস এগিয়েছেন তো পরের সিরিজেই আবার পেছনে ফেলছেন ফ্লিনটফ।
মাঝে শেন ওয়াটসন, আবদুর রাজ্জাক, শন পোলক, শহিদ আফ্রিদি, ক্রিস কেয়ার্ন্সদের আগমন ঘটলেও এই দুজনের মতো ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করে যেতে পারেননি। পুরো দশকজুড়ে তাই এদের দুজনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা উপভোগ করেছে ক্রিকেট বিশ্ব।
ফ্লিনটফের সাথে ক্যালিসের প্রথম মুখোমুখি ১৯৯৮ সালে। কিন্তু তখনো দুজনেরই ক্যারিয়ার মাত্র শুরুর পথে হওয়াতে কেউই তেমন পাদপ্রদীপের আলোয় ছিলেন না। প্রথমবার মুখোমুখি হবার দশ বছর পর পুনরায় এজবাস্টনে মুখোমুখি হন দুজনে। ততদিনে দুইজনেই জায়গা করে নিয়েছেন ইতিহাসের সেরা অলরাউন্ডারদের ছোট তালিকায়। ফ্লিনটফ তো এজবাস্টনেই অজিদের হারিয়েছেন ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স করে।
আগের ১৪ দেখায় ক্যালিসকে আউটও করেছেন চার বার। সে কারণে ক্যালিস নিজেও তেতে ছিলেন ফ্লিনটফকে ফিরিয়ে দেবার জন্য। সব মিলিয়ে খেলা শুরুর আগে ম্যাচের চেয়ে দুজনের একে অন্যকে ছাড়িয়ে যাবার লড়াই যেন বেশি আলোচনার খোরাক জমিয়েছিল দর্শকদের মাঝে।
এজবাস্টনে টস জিতে ব্যাট করতে নেমে ইংল্যান্ড অলআউট হয় ২৩১ রানে। ক্যালিস ফেরান ইংলিশ ব্যাটিংয়ের দুই স্তম্ভ কেভিন পিটারসেন এবং পল কলিংউডকে। যদিও ফ্লিনটফ ছিলেন অবিচল, তাকে আউট করতে পারেননি প্রোটিয়া বোলাররা। একপ্রান্ত আগলে অপরাজিত ছিলেন ৩৬ রানে। জবাব দিতে নেমে বোলার ফ্লিনটফের তোপে পড়ে প্রোটিয়ারা, শুরুতেই ফিরিয়ে দেন অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথকে।
১৩৫ রানে চার উইকেট পড়ার পর ব্যাটিংয়ে নামেন ক্যালিস। উইকেটের চারপাশে দারুন সব শট খেলে, মনোমুগ্ধকর ব্যাটিং করে ফিফটি তুলে নেন তিনি। অ্যাশওয়েল প্রিন্সকে নিয়ে প্রোটিয়াদের তখন দেখাচ্ছেন বড় লিডের স্বপ্ন। চিন্তিত ইংরেজ কাপ্তান মাইকেল ভন ৬৮ তম ওভারে বল তুলে দিলেন বিশ্বস্ত সৈনিক ফ্লিনটফের হাতে। ক্যালিস তখন অপরাজিত ৬৪ রানে।
ফ্লিনটফের হাতে বল যেতেই যেন প্রাণ ফিরে পেলেন গ্যালারিতে থাকা দর্শকেরা, দুজনের লড়াই দেখার অপেক্ষার অবসানে তারা তখন উল্লসিত। অন্যদিকে, ফ্রেডির চোখে মুখে তখন দৃঢ়প্রতিজ্ঞার ছাপ। প্রথম বলটাই করলেন ইয়র্কার, স্ট্যাম্পে যেন হাওয়া লাগিয়ে বল চলে গেল কিপারের গ্লাভসে। দ্বিতীয় বলটা করলেন দারুণ এক আউটসুইং ডেলিভারি। ছেড়ে দিয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন ক্যালিস। তৃতীয় বলে দারুণ এক ইয়র্কারে পরাস্ত ক্যালিস, সরাসরি বুটের সামনের অংশে আঘাত হানে বল।
আউটের আবেদনে ফেটে পড়ে পুরো ইংল্যান্ড দল কিন্তু সবাইকে অবাক করে নট আউটের সিদ্ধান্ত জানান আম্পায়ার আলিম দার। একদিকে হতাশায়-ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন ফ্লিনটফ অন্যদিকে, মুচকি হেসে ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানানো ক্যালিস ভাবছেন এ যাত্রা বোধহয় বেঁচে গেলাম। পরের দুই বলও কাটিয়ে দিলেন নির্বিঘ্নেই। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না তাতেও, ওভারের শেষ বলে আর আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের প্রয়োজন পড়লো না।
অনবদ্য এক ইয়র্কারে ক্যালিসের অফস্ট্যাম্প উড়িয়ে দিলেন ফ্রেডি। উইকেট পাবার পর চিৎকারে যেন জানিয়ে দিচ্ছিলেন এজবাস্টনের রাজা আমিই। যদিও শেষ হাসিটা হেসেছিলেন ক্যালিসই। গ্রায়েম স্মিথের অপরাজিত ১৫৪ রানের সুবাদে পাঁচ উইকেটে ম্যাচ জিতে নিয়েছিল প্রোটিয়ারা। যদিও স্মিথের নাম কেউ মনে রাখেনি, এজবাস্টন টেস্ট স্মরণীয় হয়ে থাকবে ফ্লিনটফ-ক্যালিসের দ্বৈরথের জন্য; ফ্লিনটফের অনবদ্য সেই ওভারের জন্য।
ম্যাচশেষে ক্যালিস দাবি করেছিলেন সাইডস্ক্রিনের উপরের জানালা ঢাকা না থাকায় বল দেখতে সমস্যা হচ্ছিল তাঁর। বারবার জানানোর পরও জানালা ঢেকে দেয়নি স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে, ফ্লিনটফ ছিলেন একমাত্র দীর্ঘকায় ইংরেজ বোলার। সে কারণে একমাত্র তিনিই জানালা ঢাকা না থাকার পূর্ণ ফায়দা নিতে পেরেছিলেন।
যদিও এরকম অজুহাতের পরও ফ্লিনটফের সেই স্পেলের আবেদন একটুও কমবে না। ম্যালকম মার্শাল-জোয়েল গার্নারদের সময়ের হারিয়ে যাওয়া সেই ভীতিকর পেস বোলিং আর আগ্রাসনের স্বাদ যে এই স্পেলের মাধ্যমেই ফিরিয়ে এনেছিলেন সবার প্রিয় ফ্রেডি।