তুমি আমার পাশে বন্ধু হে

‘আমি যখন ব্যাটিংয়ে আসি তখনও সাঙ্গা উইকেটের সাথে মানিয়ে নিতে পারেনি পুরোপুরি। আমি আসার পর, দু’জন পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যাটিং শুরু করি। সাঙ্গার অর্ধশতকের পর আমি ইংলিশ স্পিনারদের উপর চড়াও হতে শুরু করি। একদিকে, স্কোরবোর্ড সচল রাখা, অন্যদিকে; ইংল্যান্ডকে বাড়তি চাপে রাখাই ছিল মূল লক্ষ্য ‘

কথাগুলো বলছিলেন মাহেলা জয়াবর্ধনে, লর্ডসে কুমার সাঙ্গাকারার শতকের ইনিংস নিয়ে। ইন্টারনেট দুনিয়া ঘাঁটলে সহজেই পেয়ে যাবেন। বাড়তি কোনো গোয়েন্দা নিয়োগ করতে হয়নি আমার তাই মাহেলার মন্তব্য খুঁজে বের করতে।

ক্রিকেটের তীর্থ লর্ডসে টেস্ট শতক অনেক বড় বড় ব্যাটসম্যানদের জন্যেও আরাধ্য বস্তু। বহু সাধনার পর এই বস্তুর দেখা মিলে। সাঙ্গাও পেয়েছেন তবে, সাঙ্গার বেলায় আরাধ্য বস্তুর দেখা পাওয়ার পেছনে বন্ধু মাহেলার অবদানে কোনো ঘাটতি ছিলনা।

সাঙ্গার শতকের দিন — একপ্রান্ত আগলে রেখে সমর্থন যুগিয়ে চাপমুক্ত রাখার কাজটা সফলভাবে সেরে সাঙ্গাকে নির্ভার করে দেন মাহেলা। ইংলিশ উইকেটে উপমহাদেশের ব্যাটসম্যানরা হিমশিম খেয়ে যান! পাকিয়ে ফেলেন তাল-গোল। সাঙ্গা-মাহেলা কিংবদন্তী ব্যাটসম্যান হয়েও তাই অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছিল। ইংলিশ বোলারদের অনেক ডেলিভারির জবাব ছিলনা তাদের কাছেও।

সাঙ্গার শতকের বন্ধুর পথ মসৃণ করে দিতে মাহেলার সঙ্গ ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করে প্রমাণ করে — সাঙ্গার বন্ধুর মাহেলার অবদান কোনো অংশেই কম ছিলনা সেদিন। তাই কাভার ড্রাইভ করে সাঙ্গার শতক উদযাপনে সাঙ্গার চেয়েও অধিক উল্লাস সেদিন মাহেলাকে করতে দেখা যায়।

এভাবেই তো বন্ধুর পথ বন্ধু বাতলে দেয়। এক বন্ধুর সাফল্যে, অন্য বন্ধুর তৃপ্তির চিত্রেই আসল বন্ধুত্বের চিত্র ফুটে উঠে। ক্রিকেটের নতুন দর্শকরা সাঙ্গা আর মাহেলার বন্ধুত্বকে লর্ডসে সূত্রপাত ভাবলে বিরাট ভুল হবে। স্কুল ক্রিকেট কিংবা ঘরোয়া লিগে একই দলে কোনো ম্যাচ না খেলেও জাতীয় দলে শুরু হয় বন্ধুত্বের ইনিংস।

সাঙ্গার লঙ্কান জাতীয় দলে যাত্রা শুরু মাহেলার প্রায় তিন বছর পর। সাঙ্গার অভিষেকে মাহেলা একজন বন্ধু পাওয়ার আশা শুরু করেন। অন্যদিকে, সাঙ্গার প্রস্তুতি সহ-অধিনায়ক মাহেলার দিকনির্দেশনা মেনে চলা। সহ-অধিনায়ক হয়েও দলের অন্যান্য বড় নামের ভীড়ে একা ছিলেন মাহেলা। তাই সাঙ্গাই ছিল মাহেলার একমাত্র অবলম্বন।

সম্পর্ক পুরোনো হওয়ার সাথে সাথে জন্ম নেয় এক গভীর বন্ধুত্ব ও দায়িত্ব। মাঠের ভেতরে-বাইরে দুজনের ক্রিকেটীয় চরিত্রে এই বন্ধুত্ব রেখেছে বিরাট ভূমিকা। অধিনায়ক মাহেলার পরিকল্পনা সহজেই ধরতে পারতেন সাঙ্গা আর অধিনায়ক সাঙ্গার পরিকল্পনা অনায়াসেই রপ্ত করতে পারতেন মাহেলা।

কালের পরিক্রমায় দুজনই লঙ্কান ক্রিকেটের অপরিহার্য সদস্য তথা ‘গ্রেট’-এ পরিচিতি লাভ করে। তাদের তৈরি করা সংস্কৃতিতে লঙ্কান ক্রিকেটে সফলতার গল্পও আছে ভুরিভুরি। তরুণ ক্রিকেটারদের আপন রঙে রাঙিয়ে তুলতে সাঙ্গা-মাহেলা জুটি জুড়ি ছিলনা লঙ্কান ক্রিকেটে। ক্রিকেটবিশ্বেও তাদের আধিপত্য সর্বোচ্চ চূঁড়ায় অবস্থান করে। তাই, ক্রিকেটবিশ্বের তরুণদের কাছে মাহেলা-সাঙ্গা এক অনন্য অনুপ্রেরণার নাম।

ম্যাথিউস, চান্দিমাল, কুশল পেরেরা, থিরিমান্নের মত ব্যাটসম্যানদের পথ সুগম হওয়ার পেছনে মাথার উপর বটবৃক্ষ ছায়া হয়েছিলেন সাঙ্গা-মাহেলা জুটি। নিজেদের ব্যাটিং পজিশনের অদল-বদল করে কিংবা তরুণদের জন্য সাইড বেঞ্চে বসে হলেও সেরা পারফর্মার বের করে এনেছেন তারা। উইকেটের পেছনে গ্লাভস হাতে দাঁড়িয়ে, বোলারের লেন্থ আর মাঠের ফিল্ডিং ঠিক করে, খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যেতো সাঙ্গাকে।

একবার ব্রেন্ডন ম্যাককালাম এ দুজন সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ওরা অসাধারণ, নিজেদের কাঁধে দেশের ক্রিকেটের স্বপ্ন বহন করেছে। দায়িত্ব নিয়ে অসংখ্য ম্যাচ জেতানো। পরিসংখ্যান বলে ওরা শুধু রান করেনি, পুরো দলকে একসূত্রে গেঁথেছে।’

পারফর্ম করার তাড়না যে দু’জনের মধ্যেই ছিল তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই কারো মাঝেই। সাঙ্গা নিজেই বলেন, ‘নিয়মিত ভালো করার চাপ আমাদের মাঝে ছিল, দলের জন্য কিছু করার তাড়নায় আমরা ছুটেছি। তাছাড়া মানুষ আমাদের উপর আশা করতো অনেক।’

সাঙ্গার সাথে দ্বিমত পোষণ না করে মাহেলাও বলেন, ‘উপমহাদেশে সমর্থকদের প্রত্যাশার অনেক চাপ, সবকিছু উৎরে পারফর্ম করা কঠিন কাজ হলেও সাঙ্গার মত বন্ধু থাকায় মাঠে নিয়মিত পারফর্ম করার কঠিন পথটা সহজ হয়ে যায়।’

২০০৬ কলম্বো টেস্টে সাঙ্গা আর মাহেলার ঐতিহাসিক জুটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তাদের বন্ধুত্বের স্মৃতি সামনে নিয়ে আসবে। নিজেদের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেদিন দূর্দান্ত বোলিংয়ের পরেও ব্যাটিং নেমে ১৪ রানে দুই উইকেট হারিয়ে ঘটে ছন্দপতন। তবে, পরের চাপ সামলে সাঙ্গা আর মাহেলার সেই জুটিকে বলে মহাকাব্যিক জুটি।

মাখায়া এনটিনি, আন্দ্রে নেইল, ডেল স্টেইনের মত বিধ্বংসী বোলারদের উপর চড়াও হয়ে তাদের ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেন। প্রোটিয়াদের সকল পরিকল্পনাকে ধুলোয় মিশিয়ে ৬২৪ রানের জুটি গড়েন দুই লঙ্কান গ্রেট। সাঙ্গা ট্রিপল ও মাহেলা চারশোর কাছাকাছি গিয়ে আউট হয়ে যান। শ্রীলঙ্কা ঐ টেস্ট জয়লাভ করে ইনিংস ও ১৫৩ রানে। সম্পূর্ণ কৃতিত্ব তো তাদের প্রাপ্য। ঐতিহাসিক এই জুটি লঙ্কান ক্রিকেটকে বাড়তি পরিপূর্ণতা দান করেছে।

৬২৪ রানের জুটি কোনো সহজ বিষয় নয়! দুজনের অধ্যাবসায়, বোঝাপড়া ও বন্ধুত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই জুটি। বন্ধুত্বের আদর্শ উদাহরণ। সুন্দর বোঝাপড়াতেই ভুল-ভ্রান্তিকে পেছনে ফেলে বাইশ গজে তাদের পরিকল্পনা সফল হয় সেদিন।

একসাথে কাটাতে পেরেছে বাইশ গজে ৬২৪ রানের জুটিতে ১৫৭ ওভার। দিনের হিসাবে একটানা আড়াই দিন। দুই বন্ধুর বন্ধুত্বের স্মৃতিতে অন্যতম সেরা দিন।

মাহেলাকে ক্রিকেটের অন্যতম সেরা স্লিপ ফিল্ডার হিসেবে গণ্য করা হয়। একইভাবে তার বন্ধু সাঙ্গাকারা অন্যতম সেরা উইকেটকিপার। ফিল্ডিংয়ের পজিশনেও তাই দুজনের অবস্থান ছিল পাশাপাশি। ব্যাটিংয়ে বাইশ গজে জড়িত থাকার পর ফিল্ডিংয়েও তাদের বন্ধুত্ব লেগে আছে। একে অপরের প্রেরণাতেই তো একজন হয়েছেন স্লিপের সেরা ফিল্ডার আরেকজন সেরা উইকেটকিপার। কেবল, ব্যাটিং আর বন্ধুত্বের গণ্ডি পেরিয়ে ফিল্ডিংয়েও শীর্ষস্থানে দুই বন্ধু।

দু:খের বিষয় — দুই বন্ধু পঞ্চাশ ওভার বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেও দলকে শেষ হাসি হাসাতে পারেনি। দুবারই অধিনায়কত্বের ভার তাদের উপর ছিল। ২০০৯ ও ২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপও হারতে হয় তাদের। একটা হাসির জন্য অপেক্ষা করতে হয় ২০১৪ পর্যন্ত।

২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতে টি-টোয়েন্টি থেকে একসাথে অবসরে যান এই দুই লঙ্কান গ্রেট। মিরপুরের মাঠে ভারতকে হারিয়ে অবশেষে বিশ্বকাপ জয়ের সাদ আস্বাদন করে সাঙ্গা-মাহেলা। পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপ জিততে ব্যর্থ হলেও তরুণদের সুযোগ করে দিতে ২০১৫ বিশ্বকাপের পর অবসর নিয়ে দলের জায়গা ছাড়েন দুজন একসাথেই। পরিচয় দেন পেশাদারিত্বের।

লর্ডসের মাঠে সাঙ্গার ঘাড়ে পেছন থেকে হাত দিয়ে মাহেলা বার্তা দেন — সাঙ্গার প্রতি তার জমে থাকা তার অগাধ বিশ্বাসের। মিরপুরের মাঠে সাঙ্গাকে পেছন থেকে আলিঙ্গন করে আবেগের বর্হি:প্রকাশ ঘটান আবারও মাহেলা। ৬২৪ রানের জুটিতে তো একে অপরের প্রতি চূড়ান্ত নির্ভরতা ও আস্থা প্রমাণ করেছিলেন এই সাঙ্গা আর মাহেলা।

মাঠের বাইরে মাহেলা একজন দূর্দান্ত ফুটবলার ও ম্যান ইউ ফ্যান। প্র‍্যাকটিসে ফুটবল নিয়ে সবার তুলনায় সিরিয়াস এবং দাপুটে মাহেলা। অপরদিকে ফুটবলের দক্ষতায় সাঙ্গাকারা ছিল একেবারেই শিশু। তাই খেলা চলাকালীন রেফারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হতো তাকে। একদিন মাহেলার বিপক্ষে ফাউলের ঘোষণা দিলে সাঙ্গাকারার উপর কিছুটা রেগে যান মাহেলা। সাঙ্গা বলে উঠলেন — ‘আমার চোখে তুমি ফাউল করেছো।’

বন্ধুত্ব পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পর্কের একটা। পেশাগত জীবনে বন্ধুত্বের নজির নেই বা বন্ধুত্ব হয়না বলা লোকদের বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করতে সফল সাঙ্গাকারা আর মাহেলা। ক্রিকেট মাঠে এগারোজনকেই হতে হয় বন্ধু, যে অফিসে দলগত প্রচেষ্টাই মুখ্য সেখানে বন্ধুত্বটাও জন্ম নেয় গভীরভাবে। প্রতিটা কথা, স্মৃতি, মুহূর্ত, সিঙ্গেলস, ডাবলস, উইকেট কিংবা রানে সেখানে সুঘ্র‍্যাণ ছড়িয়ে পড়ে বন্ধুত্বের।

দুজনের বন্ধুত্বে ব্যক্তিগত সফলতার পাশাপাশি দলগত সাফল্যও ধরা দিয়েছে। তাই বন্ধুত্বগুলো হোক কুমার সাঙ্গাকারা ও মাহেলা জয়াবর্ধনের মত। বন্ধুত্ব নিয়ে জন্ম নেয় কতশত গান, গল্প আর সিনেমা আর ক্রিকেট মাঠের ইনিংস। সবকিছুই মিলিত হয় এক বন্ধুত্ব নামক বিন্দুতে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link