অজানা অভিমানের আলিঙ্গনে

তাঁর বলে জহির খানের মত গতি ছিল না বলে ক্যারিয়ারটা বেশি লম্বা হয়নি। তবে ভারতের মাটিতে পেস বোলারদের যখন আকাল তখন তাঁর এই মিডিয়াম পেস দিয়েই ভারতের জন্য লড়ে গিয়েছেন। তাঁর স্লোয়ার কিংবা দুইদিকে স্যুইং করতে পারার ক্ষমতা তাঁকে ওই অল্প গতিতেও অনন্য করেছিল। তাই তো ব্রিটিশ গণমাধ্যম বলেছিল মোহাম্মদ নিসারের পর আরেকজন বোলার ইংল্যান্ডের মাটিতে তাঁদের ভুগিয়েছেন, তিনি ভেঙ্কটেশ প্রসাদ।

১৯৬৯ সালের ৫ আগস্ট বেঙ্গালুরু শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তবে পেশাদার ক্রিকেটের যাত্রাটা শুরু হয় আরো ২১ বছর পরে। ১৯৯০-৯১ সালে কেরালার বিপক্ষে অভিষিক্ত হন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে। নিজের প্রথম ম্যাচে ১১৩ রান দিয়ে নিয়েছিলেন ৪ উইকেট। পরের বছর নিজের প্রথম লিস্ট এ ম্যাচে ২৩ রানে চার উইকেট নিয়ে প্রথম আলোচনায় আসেন।

দুই বছর পর তাঁর দল সাউথ জোন মাত্র ৩৭.৫ ওভার ব্যাট করে ৮২ রানেই অল আউট হয়ে যায়। সেই ম্যাচে ২৩ রানে ৬ উইকেট নিয়ে দলকে ১৪ রানের অবিশ্বাস্য এক জয় এনে দিয়েছিলেন ভেঙ্কটেশ প্রসাদ। তাঁর এই বোলিং পারফর্মেন্স দিয়েই মূলত নির্বাচকদের নজরে এসেছিলেন তিনি। এরপর ওই মৌসুমেই নর্থ জোনের বিপক্ষে আবার ৩৮ রান দিয়ে নেন ৭ উইকেট। ওই বছর ১৮.৬০ গড়ে ৫০ টি উইকেট পেয়েছিলেন তিনি। ফলে জাতীয় দলে প্রবেশ করাটা তাঁর জন্য তখন শুধুই সময়ের অপেক্ষা।

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে দলে প্রথম ডাক পান তিনি। তবে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে একটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেলেও নিজেকে প্রমাণ করতে পারেননি। তবে এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৩৬ রানে ৩ উইকেট নিয়ে আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় নিজেকে প্রথম প্রমাণ করেন প্রসাদ। সেই ম্যাচের পর থেকে ওয়ানডে ক্রিকেটে ভারতের পেস আক্রমণের বড় ভরসা হয়ে ওঠেন তিনি।

এরপর ১৯৯৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন এই পেসার। সেই ম্যাচে মাত্র ২১৯ রানেই অল আউট হয়ে যায় ভারত। তবে টেস্ট অভিষেকে হতাশ করেননি প্রসাদ। সেই ইনিংসে ৭১ রান দিয়ে নিয়েছিলেন ৪ উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে নিয়েছিলেন আরো দুই উইকেট। এরপর লর্ডস টেস্টে ক্যারিয়ারের প্রথম ৫ উইকেট পান তিনি।

সবমিলিয়ে ওই পুরো সিরিজে প্রসাদের স্যুইং সামলাতে রীতিমত হিমসিম খেয়েছিল ইংল্যান্ড। ওই সিরিজে ২৫ বোলিং গড়ে তিনি নিয়েছিলেন ১৫ উইকেট। এছাড়া তাঁর বোলিং পার্টনার জাভাগাল শ্রীনাথ নিয়েছিলেন মোট ১১ উইকেট। এই বোলিং জুটিকে নিয়ে সেই সময় ব্রিটিশ গণমাধ্যমে রীতিমত তোলপাড় পড়ে গিয়েছিল।

এরপর কলকাতায় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেও ১০৪ রান দিয়ে নেন ৬ উইকেট। তবে ভেঙ্কাটেশ প্রসাদ তাঁর সেরাটা দেখান দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে। প্রোটিয়াদের বিপক্ষে সেই টেস্টে দুই ইনিংসেই নেন পাঁচ উইকেট। সেটি ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের প্রথম ও একমাত্র ১০ উইকেট নেয়ার রেকর্ড।

তবে ভারত কিংবা উপমহাদেশের মন্থর পিচে প্রসাদ কখনোই নিজের সেরাটা দেখাতে পারেননি। এছাড়া নতুন বলে খুব একটা সফল না হলেও সেই সময়ে ভারত দলে ভালো মানের কোন পেসার ছিল না। ফলে প্রসাদ ও শ্রীনাথকেই শুরু করতে হতো বোলিং আক্রমন। তবুও ভারতের পেস আক্রমণের দুঃসময়ে সবচেয়ে ভরসার নাম ছিলেন ভেঙ্কাটেশ প্রসাদ।

পেস বোলিং কন্ডিশনে তিনি কতটা ভয়ংকর ছিলেন তাঁর একটা প্রমাণ দিই। ইংল্যান্ডের মাটিতে ৩ টেস্ট খেলে তাঁর ঝুলিতে আছে ১৫ উইকেট। এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকাতে ৩ ম্যাচে ২৫ গড়ে নিয়েছেন ১৭ উইকেট। সব মিলিয়ে দেশের বাইরে ৬৯ টেস্ট উইকেটের বিপরীতে ঘরের মাঠে আছে মাত্র ২৭ উইকেট।

ভারতের হয়ে ৩৩ টেস্ট খেলা প্রসাদের ঝুলিতে আছে মোট ৯৬ উইকেট। তবে এর মাঝে ৭ বার পাঁচ উইকেট ও ১ বার দশ উইকেট নেয়ার কীর্তিও আছে এই পেসারের। ওদিকে ১৬১ টি ওয়ানডে ম্যাচে ৩২.৩০ গড়ে নিয়েছেন ১৯৬ উইকেট।

২০০৫ সালে ৩৫ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর পরই কোচ হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। তাঁর সময়েই ভারতের অনূর্ধব-১৯ দল ২০০৬ বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলে।। এরপর ভারতের বোলিং কোচ হিসেবেও কাজ করেন তিনি। এছাড়া তিনি আইপিএলের দল চেন্নাই সুপার কিংস ও রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর বোলিং কোচ হিসেবেও কাজ করেন।

মোদ্দাকথা তিনি কখনোই ভারতের সেরাদের কাতারে হয়তো থাকবেন না। তাঁকে নিয়ে সেভাবে তাই আলোচনাও হয় না। তবে তিনি যখন খেলেছেন তখন তাঁর মত আর কেউ ছিল না। তিনিই ছিলেন বল হাতে ভারতের আশার প্রদীপ। তাইতো জহির খানকে ভারত যখন খুঁজে বের করলো তখন প্রসাদ ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছিলেন নীরবে-নিভৃতে, কোন এক অজানা অভিমানের সুরে।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link