বিতর্কে হারানো ব্যাটিং আগ্রাসন

ঘরোয়া ক্রিকেটে ব্যাট হাতে দাপটে দেখালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারেননি আমির। ঘরোয়া ক্রিকেটে অজস্র রান করলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিতর্কিত কাণ্ডেই নষ্ট করেছেন ক্যারিয়ারের অনেকটা সময়। তিনি হতে পারতেন পাকিস্তান ক্রিকেটে সেরাদের একজন। আগ্রাসী ব্যাটিং দিয়ে একই সময়ে লঙ্কান গ্রেট সনাথ জয়াসুরিয়া ঠিকই নিজেকে বিশ্বসেরাদের কাতারে নিয়ে গিয়েছেন। তবে মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে অতর্কিত সব কাণ্ডে আমির সোহেল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দিতে পারেননি সামর্থ্যের সবটুকু।

১৯৯৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ। মুখোমুখি ভারত ও পাকিস্তান। এই দুই দলের খেলা মানেই টান টান উত্তেজনা। ব্যাটিংয়ে তখন পাকিস্তান। ১৫ তম ওভারে ভেঙ্কটেশ প্রসাদের বলে বাউন্ডারি হাঁকান আমির সোহেল। আর ভেঙ্কটেশকে যেদিকে বাউন্ডারি মেরেছেন সেদিকে ব্যাট দেখিয়ে কিছু একটা বলছিলেন তিনি।

পরবর্তীতে ভেঙ্কটেশ অবশ্য বলেছিলেন আমির তাকে ইশারা করে বলেন ‘তোকে আবার ওইখানেই মারবো।’ অবশ্য ভেঙ্কটেশের পরের বলেই বোল্ড হয়ে ফেরত যান তিনি! সেই বিশ্বকাপের ২৫ বছর পেরোলেও সেই বিতর্কিত কাণ্ড নিয়ে এখনো বিভিন্ন প্রোগ্রামে প্রশ্নের মুখোমুখি হন আমির সোহেল।

১৯৯২ বিশ্বকাপের ফাইনালে ইয়ান বোথাম বিতর্কিত আউটে শূন্য রানে বিদায়ের পর বলেছিলেন তিনি তাঁর শাশুড়িকেও কখনো পাকিস্তানে পাঠাবেন না। সেটির পাল্টা জবাবে আমির বলেছিলেন, ‘বোথামের উচিত ছিলো তার শাশুড়িকে ব্যাট করতে পাঠানো।’

অবশ্য এমন কাণ্ড তিনি একবার নয় মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে বেশ কয়েকবার জন্ম দিয়েছেন বিতর্কের। তবে এই বিতর্ক ছাপিয়ে তিনি ছিলেন পাকিস্তানের অন্যতম সেরা ওপেনার। বলা চলে সাঈদ আনোয়ারের পরম বন্ধুও। দুই বাঁ-হাতি ওপেনার মিলে প্রতিপক্ষের বোলারদের উপর বহুবার তাণ্ডব চালিয়েছেন। সাঈদ আনোয়ার নিজেকে অনেক উঁচুতে নিয়ে গেলেও আমির সোহেল থেকে গিয়েছেন মাঝ পথে।

প্রতিভা কিংবা সম্ভাবনা কোনোটির কমতি ছিলো না আমিরের। ক্রিজে শুধু অপেক্ষায় থাকতেন বোলার কখন বল করবেন আর তিনি সেটি বাউন্ডারির বাইরে নিয়ে ফেলবেন। কভার ড্রাইভ, অন ড্রাইভ, পুল কিংবা লেগ গ্লান্স সহজেই বলকে বাউন্ডারি ছাড়া করতেন আমির।

নব্বইয়ের দশকে সেরা ওপেনার জুটির একটি ছিলেন সাঈদ আনোয়ার ও আমির সোহেল। এমনকি তর্ক বিশেষে পাকিস্তানের ইতিহাসের সেরা ওপেনিং জুটিও মানা হয় সাঈদ-আমিরকে। ওয়ানডেতে দু’জনে মিলে ৭৩ ইনিংসে ৩৯ গড়ে করেছেন ২৮৫৭ রানের জুটি!

এই ওয়ানডে ক্রিকেট দিয়েই আন্তর্জাতিক আঙিনায় পা রাখেন আমির। আর অভিষেকে লো স্কোরিং ম্যাচে দলের পক্ষে ৩২ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেন তিনি। তবে টেস্ট অভিষেকটা ছিলো একদমই সাধারণ। তবে ১৯৯২ সালে ম্যানচেস্টারে টেস্ট ক্যারিয়ারের মাত্র চতুর্থ ইনিংসেই ডাবল সেঞ্চুরির দেখা পান আমির।

রমিজ রাজাকে সাথে নিয়ে ইংলিশ বোলার ডেভন ম্যালকম, ক্রিস লুইস এবং টিম মানটনের উপর তাণ্ডব চালান আমির। ইংলিশ কন্ডিশনে একের পর এক বল বাউন্ডারি ছাড়া করছিলেন তিনি। তিন ঘন্টার মাঝেই ১২৭ বলে সেঞ্চুরি তুলে নেন আমির। চা-বিরতির সময় ১৩১ রানে অপরাজিত থাকা আমির শেষ সেশনে তুলে নেন ডাবল সেঞ্চুরি। সেই ইনিংসে ৩২টি চার মারেন আমির! এই ফর্ম টেনে নেন ৯২’ এর বিশ্বকাপেও।

১৯৯২ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের শিরোপা জয়ী সেই টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখান আমির। আমিরের বয়স তখন ২৫ বছর। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেঞ্চুরির পর ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ফিফটি! সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে পাকিস্তানের ওপেনিংয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিলেন তিনি।

এরপরের দুই বছর অবশ্য কোনো ফরম্যাটেই সেঞ্চুরির দেখা পাননি তিনি। ১৯৯৪ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডেতে ক্যারিয়ার সেরা ১৩৪ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। সেই ম্যাচে দ্বিতীয় উইকেটে ২৬৩ রানের জুটি গড়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়েন।

পরবর্তীতে ১৯৯৬ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেঞ্চুরি আর নিউজিল্যান্ড এবং ভার‍তের বিপক্ষে ফিফটি। ব্যাটে অনবদ্য পারফরম্যান্সের পরেও পাকিস্তান কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের কাছে হেরে বাদ পড়ে। পরের বছর ঘরের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের টানা দুই সেঞ্চুরি করেন আমির।

তাঁর দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে ৩৯ বছরে প্রথমবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ জয় পায় পাকিস্তান। অধিনায়ক হিসেবেও বেশ সফল ছিলেন তিনি। ১৯৯৮ সালে ৬ টেস্টে অধিনায়কত্ব করেন! যেখানে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তাদের টেস্ট ইতিহাসে প্রথম জয় পায় পাকিস্তান। অবশ্য তাঁর অধিনায়কত্বেই একবার ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ ওঠে এবং এর জন্য তিনি শাস্তিও পান। এরপর ২০০১ সালে ক্রিকেটকে বিদায় জানান এই ওপেনার।

১৯৫টি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১২২১৩ রানই প্রমাণ করে তিনি কতটা প্রতিভাবান ছিলেন। তবে তার সিংহভাগই দেখাতে ব্যর্থ হন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। ১৫৬ ওয়ানডেতে ৩২ গড়ে করেছেন ৪৭৮০ রান। করেছেন ৩১ টি ফিফটি ও পাঁচ সেঞ্চুরি।

বল হাতে শিকার করেছেন ৮৫ উইকেট। ৪৭ টেস্টে করেন ২৮২৩ রান। আছে ১৩ ফিফটি ও পাঁচ সেঞ্চুরি। তিনি শুরুতে স্ট্রোক মেকার ছিলেন না, কিন্তু পরিশ্রম আর সাধনার মাধ্যমে সময়ের সাথে সাথে সেটিকে পুঁজি করে হয়েছেন ব্যাট হাতে আগ্রাসী এক ওপেনার।

ঘরোয়া ক্রিকেটে ব্যাট হাতে দাপটে দেখালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারেননি আমির। ঘরোয়া ক্রিকেটে অজস্র রান করলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিতর্কিত কান্ডেই নষ্ট করেছেন ক্যারিয়ারের অনেকটা সময়।

তিনি হতে পারতেন পাকিস্তান ক্রিকেটে সেরাদের একজন। আগ্রাসী ব্যাটিং দিয়ে একই সময়ে লঙ্কান গ্রেট সনাথ জয়াসুরিয়া ঠিকই নিজেকে বিশ্বসেরাদের কাতারে নিয়ে গিয়েছেন। তবে মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে অতর্কিত সব কাণ্ডে আমির সোহেল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দিতে পারেননি সামর্থ্যের সবটুকু।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...