ভাই-ভাই যেখানে…

দুই ভাই একসঙ্গে মাঠে নেমেছেন, ক্রিকেটবিশ্ব এমন ঘটনা দেখেছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু দুজনেই ভালো খেলছেন এমন রেকর্ড কিছুটা বিরল। ইয়ান চ্যাপেল এবং গ্রেগ চ্যাপেল এদিক থেকে ব্যতিক্রম, নিজেদের সময়ে দুজনেই নেতৃত্ব দিয়েছেন অজি ব্যাটিং লাইনআপের। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুই ভাই মিলে যে কীর্তি গড়েছিলেন সেটা একপ্রকার ধরাছোঁয়ার বাইরে। ক্রিকেট ম্যাচের দুই ইনিংসেই দুই সহোদরের সেঞ্চুরির সেই ঘটনা ছিল ইতিহাসের প্রথম এবং এখনো পর্যন্ত একমাত্র।

ব্যক্তিগত জীবনে তার কয়েক মাস আগে থেকেই বাজে সময় কাটাচ্ছিলেন গ্রেগ চ্যাপেল। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অ্যাডিলেডে টেস্ট ম্যাচ খেলে যখন বাড়ি ফেরেন তখন দেখেন বন্যায় লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে তাঁর বাড়ি। তার মাত্র এক বছর আগেই স্ত্রীর সাথে মিলে বাড়িটি কিনেছিলেন, সাজিয়েছিলেন নিজেদের পছন্দ অনুসারে মনের মাধুরী মিশিয়ে। বন্যায় সেই বাড়ির বেহাল অবস্থা দেখে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন চ্যাপেল ভাইদের মেজ জন।

পরের কয়েকদিন সময় দিলেন বাড়িকে পূর্বের চেহারায় ফিরিয়ে আনতে। এরপর উড়ে গেলেন সিডনিতে নিউ সাউথ ওয়েলসের বিপক্ষে কুইন্সল্যান্ডকে নেতৃত্ব দিতে। ব্যক্তিগত জীবনে চ্যাপেল তখন বাবা হতে চলেছেন। চার মাসের সন্তানসম্ভবা জুডি তখন ছিলেন বাবার বাড়ি সিডনিতে।

প্রথম দিনে মাঠেও এসেছিলেন স্বামীর খেলা দেখতে। যদিও ম্যাচে কুইন্সল্যান্ড দাঁড়াতে পারেনি গ্যারি গিলমোর, লেন প্যাসকো, কেরি ও’কিফিদের সামনে। তথাপি চ্যাপেল একাই চেষ্টা করে গেছেন, খেলেন ৪৮ এবং ৭১ রানের দুটি ইনিংস। কিন্তু ট্রাজেডি অপেক্ষা করছিল মাঠের বাইরে। ঘটনার দিন চ্যাপেল ছিলেন দলের সাথে হোটেলেই। সন্ধ্যায় জানতে পারলেন তার স্ত্রীর মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। চ্যাপেলের জন্য এটা ছিল মানসিকভাবে বিশাল ধাক্কা।

ঘটনার দু:সহ স্মৃতি ভুলে যেতেই ক্রিকেটে আরো বেশি করে মনোনিবেশ করেন গ্রেগ। দলের সাথে উড়ে যান নিউজিল্যান্ডে। বেসিন রিজার্ভের প্রথম ম্যাচ থেকেই তিনি চাইছিলেন সবকিছু পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে। কিন্তু শুরুতেই পিছিয়ে পড়ে অজিরা। বেসিন রিজার্ভে টস হেরে শুরুতে ব্যাট করতে নামতে হয় তাদের।

বেসিন রিজার্ভের উইকেট এমনিতে পেসারদের জন্য স্বর্গ। তার উপর সেদিন ছিল ঝড়ো বাতাস। ফলস্বরূপ ম্যাচের প্রথম ঘন্টায় অজিদের দুই ওপেনারের বিদায়। ফলে ব্যাট করতে নামেন চ্যাপেল ভাইদের দুইজন। তবে গ্রেগ মাঠে নামার সময়ই বোঝা যাচ্ছিল তিনি অসাধারণ কিছু করে ফিরবেন। তার শরীরি ভাষাতে সেটা ফুটে উঠছিল। উইজডেন ঘটনার বর্ণনা করে এভাবে, ‘গ্রেগ চ্যাপেল ব্যাট-প্যাড পরে নামছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে স্বয়ং রে লিন্ডওয়াল এবং হ্যারল্ড লারউড থাকলেও আজ পাত্তা পাবেন না।’

শুরুটাও করেছিলেন রাজকীয়ভাবে, চোখ ধাঁধানো এক কাভার ড্রাইভ দিয়ে। সেঞ্চুরিতে পৌঁছান দুই ঘন্টা পাঁচ মিনিটে,১৬০ ডেলিভারিতে। অন্যদিকে, চুপ ছিলেন না বড় ভাই ইয়ান চ্যাপেলও, সেঞ্চুরিতে পৌঁছে যান তিনিও। কিন্তু দিনের শেষভাগে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে তার, ১৪৫ রানে আউট হয়ে যান উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে। দুই ভাইয়ের পার্টনারশিপ ভাঙে ২৬৪ রান যোগ করার পর। দিনশেষে গ্রেগ চ্যাপেল অপরাজিত রইলেন ১৬২ রানে।

দ্বিতীয় দিনে আরো বিধ্বংসী রূপে দেখা দিলেন চ্যাপেল ভাইদের ছোটজন। লাঞ্চের আগেই পেয়ে গেলেন দ্বি-শতকের দেখা। ২৪৭ রানে অপরাজিত থাকা অবস্থায় দলীয় ৫১১ রানে ইনিংস ঘোষণা করেন। জবাব দিতে নেমে নিউজিল্যান্ডও পায় ভালো সংগ্রহ। ব্রায়ান হ্যাস্টিংস এবং বেভান কনডনের সেঞ্চুরিতে কিউইদের ইনিংস থামে ৪৮৪ রানে।

দ্বিতীয় ইনিংসেও অব্যাহত ছিল চ্যাপেল ব্রাদার্স শো। ম্যাচে ফলাফল আসা সম্ভব নয় ভেবেই প্রাণখুলে ব্যাটিং করে দুজনে। ফলস্বরূপ দ্বিতীয় ইনিংসেও সেঞ্চুরির দেখা পান দুজনে। বড় ভাই ইয়ান চ্যাপেল খেলেন ১২১ রানের দারুণ ক্ল্যাসিক এক ইনিংস। অন্যদিকে, স্বভাবসুলভ আক্রমণাত্নক ছিলেন গ্রেগ। মাত্র দুই ঘন্টায় পৌঁছে যান সেঞ্চুরিতে। শেষপর্যন্ত আউট হন ১৩৩ রান করে। ম্যাচটি শেষপর্যন্ত ড্র হয়।

ম্যাচে গ্রেগ চ্যাপেল করেছিলেন মোট ৩৮০ রান, ১৯৯০ সালে গ্রাহাম গুচ ৩৩৩ এবং ১২৬ রান করার আগে যা ছিল এক ম্যাচে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। পাঁচ দিনের সেই ম্যাচে রানের পাহাড়ে চড়ার পর গ্রেগ চ্যাপেলের পারিবারিক জীবনের দু:খ বোধহয় কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link