এক মৌসুম আগে দল পাল্টানোর অনেক চেষ্টা করেও যখন বার্সেলোনা ছাড়তে পারেননি লিওনেল মেসি, তখন অনেকেরই বিশ্বাস জন্মেছিল এই ক্লাবেই ক্যারিয়ার শেষ করবেন তিনি। ক্লাবের হয়ে খুব বাজে একটা মৌসুম কাটানোর পর আগামী মৌসুমের জন্য স্বদেশী সার্জিও আগুয়েরোকে নিয়ে এসেছিলেন ম্যানচেষ্টার সিটি থেকে।
চেয়েছিলেন কোপা আমেরিকা কাপ জয়ী আরেক আর্জেন্টাইন রোমেরোকে নিয়ে আসতে। কিন্তু উল্টো নিজেকেই চলে যেতে হয়েছে। আর মেসির স্পেন থেকে চলে যাওয়াটা খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যেই হয়েছে। যে প্রক্রিয়ায় হয়েছে সেটি নিয়ে অনেকেরই আপত্তি থাকতে পারে। কারণ একজন খেলোয়াড় একটি ক্লাবে ২১ বছর কাটানোর পর তার বিদায়ের প্রক্রিয়াটা এমন হওয়ার তো কথা ছিলনা।
এমনিতে বার্সার সাথে চুক্তি শেষ হওয়ার পর গত ৩০ জুনের পর থেকেই ফ্রি খেলোয়াড় হয়ে পড়েন মেসি। কিন্তু কোপা আমেরিকা কাপ খেলতে ব্রাজিলে থাকার কারণে তার দলবদল নিয়ে এতবেশি আলোচনা হয়নি। উল্টো বার্সেলোনা থেকে বারবারই বলা হয়েছে, মেসির সাথে নতুন চুক্তির খুব কাছাকাছি চলে এসেছেন তারা। কিন্তু দৃশ্যপট পাল্টাতে খুব বেশি সময় লাগেনি।
ফরাসী ক্লাব পিএসজির সাথে তার চুক্তিটাও হয়েছে অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে হয়েছে। পাঠকদের হয়তো জানতে ইচ্ছে করছে কিভাবে আর কোন প্রক্রিয়ায় এত দ্রুততম সময়ের মধ্যে চুক্তিটা সম্পন্ন হয়েছে। অথচ নতুন ক্লাবের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার এক সপ্তাহ আগেও পিএসজির সঙ্গে মেসির চুক্তি সই হওয়ার কোনো সম্ভবনাই ছিল না।
গত বৃহস্পতিবার রাতে ঘড়ির কাটা যখন ঠিক দশটায় পৌঁছে, ঠিক তখনই প্যারিস সেইন্ট জার্মেই (পিএসজি) মেসির প্রতি তাদের প্রথম পদক্ষেপটি নিয়েছিল। এর দুই ঘন্টা পূর্বেই পাকাপাকিভাবে জানা যায়, মেসি আর ক্যাম্প ন্যু’তে থাকছেন না। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরই পিএসজি আর্জেন্টাইন অধিনায়ককে পাওয়ার জন্য দৃঢ় মনোবলের সঙ্গে যেভাবে আলোচনাটি পরিচালনা করেছে তা সত্যিই চমক জাগানিয়া।
ফুটবল বিশ্বে সাধারণত খেলোয়াড়দের এক ক্লাব থেকে অন্য ক্লাবে যাওয়ার প্রস্তাবগুলো মধ্যস্থতাকারী কিংবা এজেন্টদের মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। বিগত দিনে বার্সেলোনা থেকে মেসিকে অন্য ক্লাবের প্রতি প্রলুব্ধ করার প্রচেষ্টাগুলোও একই পন্থায় হয়ে আসছিল। কিন্তু বিগত বছরগুলো এই প্রক্রিয়ায় মেসিকে নিয়ে কোন ক্লাব এক চুলও এগুতে পারেনি। আর সে কারণে পিএসজি ভালোভাবেই বুঝেছিল এই পন্থায় এগোলে তাকে পাওয়া যাবে না।
তাই কোন এজেন্টের উপর ভরসা করে মেসির সাথে যোগাযোগ করা হয়নি। সেরা খেলোয়াড় দলে ভেড়ানোয় পটু পিএসজি কর্মকর্তারা এখানে এক ভিন্নধর্মী চমৎকার কৌশল অবলম্বন করে। ভিন্ন কৌশলে ক্রীড়া পরিচালক লিওনার্দো মেসির বাবা জর্জ মেসির আইনজীবীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে প্রস্তাবনা দেন।
যা পরবর্তীতে ক্লাবের প্রেসিডেন্ট নাসের আল খেলাইফিও তাদের সঙ্গে আলোচনায় যোগদান করেন। এমন আলোচনায় খেলাইফির অংশগ্রহণকে বিরল ঘটনাই বলতে হবে। সাধারনত ক্লাব প্রেসিডেন্ট খেলোয়াড় কেনাবেচায় থাকেন না, তিনি হয়তো তার মাতামতটাই ব্যখÍ করে থাকেন। তবে চার বছর পূর্বে নেইমারের বার্সেলোনা ত্যাগ করে পিএসজিতে আসার সময়ও তিনি একইভাবে আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন।
তাঁর উপস্থিতি থেকেই বোঝা যায়, মেসির ব্যাপারে পিএসজি কতটা আগ্রহী ছিলেন। নেইমার পিএসজিতে আসার পর থেকেই মেসিকে ফরাসী ক্লাবটিতে নিয়ে আসতে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বার্সেলোনার প্রতি মেসি ভালবাসা এতটাই ছিল যে, কোন ক্লাবই তাকে দলবদলের প্রস্তাব দিতে সাহস করেনি।
মেসি নিজে থেকে এক মৌসুম আগে দল ছেড়ে দেবার ব্যপারে বেশ সিরিয়াস ছিলেন। কিন্তু ক্লাবের সাথে চুক্তি তাকে স্পেন ছাড়তে দেয়নি। তবে হঠাৎ করে মেসিতে পেতে ঝাপিয়ে পড়লেও তাকে যে এতটা সহজে পাওয়া যাবে, সেটি প্রায় অসম্ভবই মনে হয়েছিল। কিন্তু অনেকটা হঠাৎ করেই ন্যু ক্যাম্পে অবস্থান করার পাঁচ বছরের এই চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য মেসি এবং তার বাবা আবারও ইবিজা থেকে বার্সেলোনায় ফিরে আসেন।
সন্ধ্যায় এ ব্যাপারে একটি ঘোষণার পরিকল্পনা করা হয় তাতে বলা হয়, আর্থিকভাবে দুর্বল ক্লাবটিকে সহায়তার জন্য পাঁচ বছরের চুক্তিতে মেসি মাত্র দুই বছরের বেতন নিবেন। খেলাইফি, লিওনার্দো, জর্জ মেসি এবং খেলোয়াড়ের আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা চলে গভীর রাত পর্যন্ত। সেই আলোচনা চলতে থাকে পরদিন শুক্রবার পর্যন্ত।
একটা অনিশ্চিত অবস্থা থেকে পরবর্তী মৌসুমে খেলার সুযোগ, সেই সঙ্গে দুই বছরের বেতন বোনাস মিলিয়ে ৩৫ মিলিয়ন ইউরোর চুক্তিতে মেসির পক্ষের সবাই বেশ উচ্ছ্বাসিত ছিলেন। এছাড়া কর এবং স্পন্সরের মতো ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনায় অনেকটা সময় কেটে গিয়েছিল। আর্থিকভাবে ফেয়ার প্লে’র বিষয়গুলোও আলোচনায় উঠে এসেছিলো, আর এসব ক্ষেত্রে পিএসজি সর্বদাই বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিল।
এখন পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততে পারেননি পিএসজি। তাই খেলোয়াড়দের উপর কিছুটা নাখোশ ছিলেন টিম ম্যানেজমেন্ট। এবার মেসিকে নিয়ে আসার আরও একটি কারণ ছিল এটি। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতলে নেইমারের মতো মেসিকেও একটি বিশেষ বোনাস দেওয়া হবে এমন একটি ধারাও যুক্ত করা হয় চুক্তিতে। পরদিন শনিবারে মৌখিকভাবে চুক্তি হওয়ার পর পিএসজি চুক্তির লিখিত কাগজাদি রোববার সকাল ১০টায় বার্সেলোনায় মেসির কান্নাজড়িত বিদায় সম্মেলনের কিছুক্ষণ আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিল।
তখনো বোঝা যায়নি এরপর কি হতে চলেছে। যদিও সে সময়ে মেসি পিএসজির সঙ্গে চুক্তির ব্যাপারে ভক্তদের কোনকিছু জানায়নি। কারণ মেসির আইনজীবীরা দুই দিন সময় চেয়েছিলো চুক্তির খুঁটিনাটি সকল বিষয় যাচাই বাছাই করতে। এরপর গত সোমবার রাতের মধ্যে, সবকিছু দেখে চুক্তি প্রস্তুত করা হয়। যা পরদিন মঙ্গলবার সকাল ১০টায় চুক্তিটি চূড়ান্ত রুপ লাভ করে।
সবকিছু নিশ্চি হওয়ার পরপরই মেসি ও তার পরিবারের সদস্যরা বার্সেলোনা বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। যদিও এর আগে পিএসজির ড্রেসিং রুমে মেসির সম্ভাব্য আগমনের বার্তা শুনে খেলোয়াড়দের মধ্যে উল্লাস করা শুরু হয়ে যায়। কারণ, নেইমার আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই তার দলকে জানিয়েছিলেন তার সাবেক বার্সেলোনা সতীর্থ মেসি অবশ্যই তাদের সঙ্গে পিএসজিতে যোগ দেবেন। ক্রীড়া পরিচালক লিওনার্দোর মতো করে নেইমার পিএসজি বোর্ডের একজন সদস্যের মতোই মেসিকে নিয়ে কাজ করছিলেন।
কিছুক্ষণ পরপর ফোন করে, মেসেজ দিয়ে পিএসজিতে যোগদানের ব্যাপারে তাকে যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছিলেন এই ব্রাজিলিয়ান পোষ্টারবয়। মাত্র এক সপ্তাহ আগেও পিএসজির সঙ্গে মেসির চুক্তি সই হওয়ার যেখানে কোনো সম্ভবনাই ছিল না, সেটিই কত দ্রুত বদলে যেতে থাকে। কিন্তু সময়টা উপযুক্ত হলে সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত কিংবা অসম্ভব চমৎকার ঘটনাগুলো কত দ্রুত ঘটে যায়। ঠিক যেভাবে মেসির যোগদানে পিএসজির ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো, পূর্ণ হলো অপূর্ণ সাধেরও।