চতুর্থ দিনের শেষেও লর্ডস টেস্টের চাবিটা ইংলিশদের হাতেই ছিলো। একদিনের ব্যবধানেই সেই চিত্র পাল্টে গেলো। আর সেই পালটে যাওয়া চিত্রের নায়ক মোহাম্মদ শামি ও জাসপ্রিত বুমরাহ। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ২০৯ রানেই ৮ উইকেট হারায় ভারত। স্কোরবোর্ডে টার্গেট তখন মাত্র ১৮২!
লর্ডসের বেলকনিতে বসে ভারতীয় কাপ্তান বিরাট কোহলি এবং কোচ রবি শাস্ত্রী হয়তো তখনো চিন্তা করছিলেন কোনোমতে ২০০ রানের টার্গেট ছুঁড়তে পারবেন কিনা ইংলিশদের সামনে। ক্রিজে তখন মোহাম্মদ শামি ও জাসপ্রিত বুমরাহ। ম্যাচের মোড় পাল্টে দিয়ে অ্যান্ডারসন-উডদের সামনে বুক চিতিয়ে লড়াই করে যান দু’জনে। ইংলিশ অধিনায়ক জো রুটের কোনো অস্ত্রই যেনো দমাতে পারছিলেননা তাদের। দু’জনে মিলে জুড়ে দেন পঞ্চাশোর্ধ জুটি!
লর্ডসের উইকেটে অ্যান্ডারসন, উড, রবিনসনদের সামনে ভারতের একাদশে লেজের দুই ব্যাটসম্যান চিন্তার রেখা কাটছিলেন ইংলিশদের কপালে। একপ্রান্তে দুর্দান্ত ব্যাটিং করে শামি তুলে নেন অনবদ্য এক ফিফটি। ২০১৮ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে পাঁচ টেস্টে ভারতের ৯, ১০ ও ১১ তম ব্যাটম্যান মিলে করেছিলেন মোটে ৭৪ রান। আর সেখানে শামি এবং বুমরাহ মিলে কিনা লর্ডস টেস্টে জুড়ে দিলেন হার না মানা ৮৯ রান! চা-বিরতির পর ৮ উইকেটে ২৯৮ রানেই ইনিংস ঘোষণা করে ভারত। ইংল্যান্ডের সামনে লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ২৭২ রানের!
মোহাম্মদ শামি-বুমরাহদের ব্যাটেই ম্যাচ বাঁচায় ভারত। তখনো লর্ডস টেস্টের ফলাফল সহজ ড্র’য়েই শেষ হবে মনে হচ্ছিলো। কিন্তু শেষ দুই সেশনে যে থ্রিলার অপেক্ষা করছিলো সেটা হয়তো ভাবেনি কেউই।
জবাবে ব্যাট করতে নেমে ব্যাট হাতে ম্যাচ বাঁচানো বুমরাহ-শামিদের তোপে ব্যক্তিগত শূন্য রানেই বিদায় নেন দুই ওপেনার ডমিনিক সিবলি ও ররি বার্নস। এরপর অধিনায়ক জো রুটের সাথে হাসিব হামিদের জুটি ভীত গড়ার চেষ্টা করে। রোহিত শর্মার ক্যাচ মিসে একবার জীবন পেলেও ইশান্ত শর্মার কাছে কাটা পড়েন হামিদ।
৪৪ রানে ৩ উইকেটের পর চা-বিরতির আগে শেষ বলে ইশান্ত শর্মার কাছে ধরা পড়েন জনি বেয়ারস্টো। চা-বিরতির পর প্রথম ওভারেই বুমরাহর বলে বিদায় নেন জো রুটও! ৬৭ রানে পাঁচ উইকেট হারিয়ে লর্ডসে ধুঁকছিলো ইংলিশরা।
জস বাটলার ও মঈন আলী ম্যাচ বাঁচানোর চেষ্টা করলেও দলীয় ৯০ রানে মোহাম্মদ সিরাজের পর পর দুই বলে মঈন আলী ও স্যাম কুরান ফিরলে ম্যাচে ইংলিশদের আশা শেষ হয়ে যায়। পর পর দুই ইনিংসেই গোল্ডেন ডাকের শিকার হন স্যাম! দিনের বাকি ১৫ ওভার! ভারতের দরকার তিন উইকেট। আর ইংলিশদের প্রয়োজন ৯০ বল ডিফেন্স করা। জস বাটলার-ওলি রবিনসনরা মাটি কাঁমড়ে পড়েছিলেন। ওভার যতোই কমছিলো দুই ব্যাটসম্যানকে ততোই ঘিরে ধরছিলেন ভারতীয় ফিল্ডাররা।
শেষ দশ ওভার! লর্ডসে দর্শকদের উৎকন্ঠা যেনো আরো বাড়ছিলো। কিন্ত ইংলিশ সমর্থকদের হতাশ করে ওলি রবিনসনকে ফেরান বুমরাহ। ভারতের জিততে প্রয়োজন মাত্র ২ উইকেট। তখনো একপ্রান্তে থিতু জস বাটলার। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি! পরের ওভারেই বাটলারকে ফিরিয়ে ম্যাচ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেন মোহাম্মদ সিরাজ।
ভারতের জয়ের জন্য ব্যবধান মাত্র এক উইকেট! ইংল্যান্ডের সামনে ৫১ বল! কিন্তু ওই ওভারের পঞ্চম বলেই অ্যান্ডারসনকে বোল্ড করে ম্যাচে ১৫১ রানের বিশাল জয় তুলে নেয় ভারত! শ্বাসরুদ্ধকর শেষ মূহুর্তে দুর্দান্ত জয় পায় ভারত।
এর আগে প্রথমে ব্যাট করে লোকেশ রাহুলের সেঞ্চুরিতে ৩৬৪ রানে গুড়িয়ে যায় ভারত। জেমস অ্যান্ডারসন শিকার করেন পাঁচ উইকেট। জবাবে ব্যাট করতে নেমে জো রুটের দুর্দান্ত সেঞ্চুরিতে ৩৯১ রানে থামে ইংলিশদের ইনিংস। ২৭ রানে পিছিয়ে থেকে নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে রাহানের ফিফটির পর নবম উইকেটে মোহাম্মদ শামি ও বুমরাহর ৮৯ রানের হার না মানা জুটিতে ২৯৮ রানে ইনিংস ঘোষণা করে ভারত। ২৭২ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে শেষ পর্যন্ত ১২১ রানেই গুড়িয়ে যায় ইংল্যান্ড।
অসাধারণ রোমাঞ্চকর এক টেস্টের সাক্ষী হলো লর্ডস। একদিন আগেই লর্ডস টেস্টে ড্রাইভিং সিটে থাকা ইংলিশরা শেষ দিনে মুথ থুবড়ে পড়লো ভারতের টেইলএন্ডারদের কাছে। পর পর দুই দিনে দু’টি রোমাঞ্চকর টেস্টের সাক্ষী হলো ক্রিকেট বিশ্ব।
আগের দিন কেমার রোচের অনবদ্য ব্যাটিংয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১ উইকেটের শ্বাসরুদ্ধকর এক জয় পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। লর্ডসের এই রোমাঞ্চকর মুহূর্ত যেন ছাড়িয়ে গেল আগেরদিনকেও! মুহূর্তে মুহূর্তে ম্যাচের মোড় পাল্টানো। টেস্ট ক্রিকেট এজন্যই অনিন্দ্য সুন্দর! না, টেস্টের চেয়ে রোমাঞ্চকর কোনো ফরম্যাট ক্রিকেটে নেই।