বয়স ১৬, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক, টেস্ট ম্যাচ!
এই সংকেতগুলোর ভিত্তিতে একটি অর্থপূর্ণ বাক্য তৈরি করলে বাক্যের যে ভাব দাঁড়ায় তা অনেকেরই বিশ্বাস করতে বেগ পেতে হবে। ১৬ বছর বয়সী একজন তরুণের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক তাও আবার টেস্ট ম্যাচের মধ্য দিয়ে- এটা তো অবিশ্বাস হওয়ারই কথা!
ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য হলেও ছিল সত্যি। আর যদি বিশ্বাস হয়েই যায় তাহলে খেলোয়াড়টির সামর্থ্য নিয়ে আপনাকে আলাদা করে কিছু বলার প্রয়োজন হবে না। মাত্র ১৬ বছর বয়সে টেস্ট ক্রিকেটের মত কুলিন সংস্করণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একজন তরুণের অভিষেক তো আর এমনি এমনিই হতে পারে না!
বয়স মাত্র ১৬ অথচ বলে সে কী গতি! অভিষেক ম্যাচেই কলম্বোর পি সারা ওভালের মরা উইকেটে নতুন বলে রীতিমত গতির ঝড় তুলে বসেন এই আনকোরা পেসার। তাঁর গতির ঝলকে উইকেটে ঠিকমত থিতুই হতে পারছিলেন না লঙ্কান ব্যাটসম্যানরা। প্রথম সাফল্য পেতে তাই খুব বেশি সময়ও লাগেনি তাঁর।
ইনিংসের অষ্টম ওভারেই ঘন্টায় ১৪০ কি.মি গতির একটি ইনসুইঙ্গারে তিনি উপড়ে ফেলেন অভিজ্ঞ মারভান আতাপাত্তুর মিডল স্ট্যাম্প। এর কয়েক মিনিট পর একই কায়দায় শুণ্য রানে প্যাভিলিয়নে ফিরতে বাধ্য করেন শ্রীলঙ্কার আরেক নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান মাহেলা জয়াবর্ধনেকে। ঠিক এভাবেই ২০০২ সালে সবাইকে তাক লাগিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের যাত্রা শুরু করেন বাংলাদেশের তরুণ পেসার তালহা জুবায়ের।
২০০২-০৪, এই সময়টাতে বাংলাদেশের খাঁটি পেসার হিসেবে মাশরাফি বিন মুর্তজার পর সবার আগে যে নামটি উচ্চারিত হতো সেটি তালহা জুবায়ের। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব ১৭ দলে মাশরাফির বোলিং পার্টনার ছিলেন তালহা। সেখানে নিজের বোলিং প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেই জাতীয় দলে ঢুকার পথ মসৃণ করেন তিনি। তারপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্টে অভিষেক।
তালহা দলে সুযোগ পান অনূর্ধ্ব ১৭ দলের তাঁরই সতীর্থ মাশরাফির জায়গায়। ইনজুরির কারণে পুরো শ্রীলঙ্কা সফর থেকে ছিটকে যান মাশরাফি। তাঁর জায়গায় প্রথমবারের মত জাতীয় দলে খেলার সুযোগটা ভালোভাবেই কাজে লাগান তালহা জুবায়ের। অভিষেক সিরিজে খেলতে নেমে ২ ম্যাচে তিনি সংগ্রহ করেন ৫ উইকেট।
টেস্ট সিরিজে ভালো করলেও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের দলে ডাক পাননি তিনি। অবশ্য ওয়ানডে অভিষেকের জন্য খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি তাকে। অভিষেক টেস্ট খেলার ৪ মাস পরেই আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক ঘটে তালহার। এখানেও ইনজুরিগ্রস্থ মাশরাফির রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে দলে সুযোগ পান তিনি।
ওয়ানডে অভিষেকের দিন বল হাতে বলার মত কিছুই করতে পারেননি তালহা। ওই ম্যাচে উইকেটশূণ্য থাকলেও পরের ম্যাচেই তিনি স্বরূপে হাজির হন। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলতে গিয়ে প্রথম ম্যাচেই তিনি তাঁর ক্যারিয়ারসেরা বোলিংটি করে ফেলেন। সেই ম্যাচে তালহা একাই তুলে নেন ৪ উইকেট যেখানে তাঁর শিকার গ্রায়েম স্মিথ, বোয়েটা ডিপেনার, শন পোলক ও ল্যান্স ক্রুজনারের মত নামিদামি ব্যাটসম্যানরা। ম্যাচে তাঁর বোলিং ফিগার ১০-১-৬৫-৪! তাছাড়া সিরিজের বাকি ২ ম্যাচে ২ উইকেট নিজের ঝুলিতে তুলে নেন তিনি।
অভিষেকের পর থেকেই প্রতিশ্রুতিশীল বোলার হিসেবে সবার মনে দাগ কাটতে থাকেন তালহা জুবায়ের। সুন্দর অ্যাকশন, ভয়ানক গতি, বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং দুর্দান্ত সুইংয়ের কারণে তাকে বাংলাদেশের পেস আক্রমণের ভবিষ্যত কান্ডারি হিসেবে বিবেচনা করা শুরু হয় সেসময়। অনেকের মতে তিনি তখন মাশরাফির চেয়েও বেশি গতিতে বল করতে পারতেন। উইন্ডিজের কিংবদন্তী পেসার স্যার অ্যান্ডি রবার্টস পর্যন্ত তাঁর বোলিংয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং সেটি তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরুর আগেই।
২০০১ সালে বিকেএসপিতে দুই সপ্তাহের ক্যাম্প করানোর জন্য ঢাকায় পা রাখেন একসময় স্লো আর ফাস্ট বাউন্সে ২২ গজে ব্যাটসম্যানদের নাভিশ্বাস তোলা উইন্ডিজ পেসার অ্যান্ডি রবার্টস। বাংলাদেশের তরুণ পেসারদেরকে পেস বোলিংয়ের মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারনা দেয়ার জন্য সুদূর অ্যান্টিগা থেকে তাকে উড়িয়ে আনে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) তিনি যাদের নিয়ে কাজ করেন তাদের মধ্যেই ছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা ও তালহা জুবায়ের। সেসময় তাঁরা দুজনই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলা জেনুইন পেসারদের গতিতে বল করতে পারতেন।
ভয়ঙ্কর গতির সাথে বলের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ দেখেই রবার্টস ঘোষণা করে দেন যে খাঁটি ফাস্ট বোলার হিসেবে মাশরাফি ও তালহার অসাধারণ ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে। তাছাড়া বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীর ঠিক থাকলে তালহা একসময় ঘন্টায় ৯০ মাইল বেগে বল করবেন বলেও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই শরীরই পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় তালহার সামনে।
বারবার ইনজুরির কবলে পড়ায় মাত্র ৭ টেস্ট এবং ৬ ওয়ানডে খেলে থেমে যায় তাঁর ক্যারিয়ারের চাকা। এমনকি ২০০৩ বিশ্বকাপে ইনজুরির কারণে মাত্র ২ ম্যাচ খেলেই দেশে ফিরে আসতে হয় তাকে। একের পর এক ইঞ্জুরির কারণে তাঁর ফিটনেসে দেখা দেয় ঘাটতি এবং পারফরম্যান্সে পড়ে এর প্রভাব। সেজন্য ক্যারিয়ার শুরুর দিকের বলের সেই গতি ও ধার পরবর্তীতে আর ধরে রাখতে পারেননি তিনি। ফলশ্রুতিতে মাত্র ১৮ বছর বয়সেই ডুবে যায় তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সূর্য।
২০০৪ সালের ডিসেম্বরে চট্টগ্রামে ভারতের বিপক্ষে জাতীয় দলের হয়ে নিজের সর্বশেষ ম্যাচটি খেলেন তালহা জুবায়ের এবং সেটিই ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট ম্যাচ। ওই ম্যাচে ১৯ ওভার বল করে ৯৫ রানের বিনিময়ে উইকেটশূণ্য ছিলেন তিনি। আর ওয়ানডেতে ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচটি খেলেন ২০০৩ বিশ্বকাপে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। সেই ম্যাচেও তিনি উইকেটবিহীন ছিলেন ২ ওভার বল করে ২৪ রান খরচায়।
১৩ ম্যাচের একটি সংক্ষিপ্ত ক্রিকেট ক্যারিয়ারে একাধিক রেকর্ড রয়েছে তালহার দখলে। ২০০২ সালে ১৬ বছর বয়সী তালহা জুবায়ের সবচেয়ে কম বয়সী ক্রিকেটার হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে অংশ নেয়ার রেকর্ড গড়েন। তারপর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের শেষ ম্যাচে এক বিরল রেকর্ডের মালিক বনে যান তিনি। ১১ নাম্বার ব্যাটসম্যান হিসেবে কোন টেস্টের তৃতীয় ইনিংসে দলের হয়ে সর্বোচ্চ রান করার সে রেকর্ড তিনি করেন ৩১ রানের একটি ইনিংস খেলার মাধ্যমে। তালহা জুবায়েরের এই রেকর্ডগুলো এখনও অক্ষুণ্ণ অবস্থায় রয়েছে।
তালহা জুবায়েরের মত একজন সম্ভাবনাময় ক্রিকেটারের অপমৃত্যুর পেছনে দায়ী তখনকার ক্রিকেট বোর্ডের প্রক্রিয়াগত ত্রুটি। সেসময় বয়সভিত্তিক দলগুলোতে কেউ একটু ভালো করলেই জাতীয় দলে ঢুকিয়ে দেয়া হতো। তালহার জুবায়েরের ক্ষেত্রেও এমনটিই হয়েছে। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব ১৭ দল থেকে মাত্র ১৬ বছর বয়সে যখন তাকে টেস্টে অভিষেক করানো হয় তখন তিনি ভালো করে ক্রিকেট খেলাটাই বুঝতেন না।
পেস বোলিং সম্পর্কেও ন্যূনতম ধারনা ছিল না তাঁর। শুধু জোরে বল করতে পারতেন এবং পেসার হিসেবে জোরে বল করা লাগে এটুকুই বুঝতেন। কিন্তু ম্যাচের কোন পরিস্থিতিতে কিভাবে বল করবেন, ব্যাটসম্যানের দুর্বলতা কোথায় তা বুঝে বল করার বিষয়গুলো তাঁর মস্তিষ্কে ছিল না।
অথচ বিকেএসপিতে ২ সপ্তাহ ক্যাম্প করার পর দেশ ছাড়ার আগে অ্যান্ডি রবার্টস সাবধান করে গেছেন যেন মাশরাফি, তালহাদের মত তরুণ পেসারদের ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট না খেলিয়ে অল্প বয়সেই টেস্টে নামিয়ে দেয়া না হয়। এতে করে তাদের ইনজুরিতে পড়ার ঝুঁকি বেড়ে যাবে। তালহার ক্ষেত্রে ঠিক তাই হয়েছে।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হওয়ায় ক্যারিয়ার শুরুর দিকে কয়েকবার ইনজুরিতে পড়তে হয় তাকে এবং বয়স কম থাকায় ইনজুরির সেই ধকলগুলো তাঁর শরীর ঠিকমত নিতে পারেনি। তখন বাংলাদেশ দলে ভালো মানের কোন ফিজিও ছিলেন না। কোনো খেলোয়াড় ইনজুরিতে পড়লে ক্রিকেট বোর্ডও যথাযথ উদ্যোগ নিতে পারত না। এসব কারণেই মূলত খেলা শুরু করার মাত্র ২ বছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অধ্যায় থেকে মুছে যায় তালহা জুবায়ের নাম।
জাতীয় দলে যেমন একটু আগেভাগেই অন্তর্ভুক্ত করা হয় তালহাকে তেমনি আগেভাগেই দল থেকে ছুড়ে ফেলা হয়। ইঞ্জুরির কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২ বছরের বেশি খেলতে না পারলেও ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি খেলা চালিয়ে গেছেন দীর্ঘদিন। ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর পারফরম্যান্সও ছিলো চোখে পড়ার মত এবং পরিসংখ্যান খুব ঈর্ষণীয়
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৭৩ ম্যাচে ২২২ উইকেট এবং লিস্ট ‘এ’ ক্যারিয়ারে ২৯ ম্যাচে ৩০ উইকেট রয়েছে তালহার ঝুলিতে। জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার পর ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিতই পারফর্ম করতেন তিনি। কিন্তু সেখানে ভালো করলেও কোন এক অজানা কারণে তাকে আর জাতীয় দলে ফেরত আনা হয়নি। তালহা জুবায়ের সর্বশেষ লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ খেলেছেন ২০১৩ সালে।
২০১৪ সালের পর ঘরোয়া ক্রিকেটে আর খেলতে দেখা যায়নি বাংলাদেশের এই গতিতারকাকে। এখন নিজের ব্যবসা-বানিজ্য করেন। বয়স মোটে ৩৬ কী ৩৭ – এখনো তার তরুণদের সাথে জুটি বেঁধে বল করার কথা। অন্তত ঘরোয়া লিগে তো থাকতেই পারতেন। অথচ, তিনি এখন ‘বুড়ো’দের সাথে মাস্টার্স ক্রিকেট লিগ খেলেন, বিপিএল আর ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে কোচিং করান। বাংলা টাইগার্সের সাথেও আছেন তিনি। সময় দিব্যি কেটে যাচ্ছে। কিন্তু, আক্ষেপটা কী কখনো মুছে যাবে!