রবি শাস্ত্রীর বাড়িতে বসেছে নৈশভোজের আসর। নিমন্ত্রিত অনেক সাবেক ও বর্তমান ক্রিকেটার। ভিনদেশিরাও আছেন। মোটামুটি চেয়ারে বসে আছেন সবাই। বেশ জমকালো পরিবেশ। অনুষ্ঠানের মাঝপথে একজন ছোটোখাটো ভদ্রলোক পাজামা পাতলুম পরে প্রবেশ করলেন সেই নৈশভোজের পার্টিতে; একেবারে ভারতীয় পোষাক।
দূর থেকে দেখলে মনে হবে নিতান্তই সাধারণ কোনো মধ্যবিত্ত ব্যক্তি। কিন্তু সেই আপাতদৃষ্ট মধ্যবিত্ত পার্টিতে প্রবেশ করার সাথে সাথেই পার্টির পরিবেশ যেন হঠাৎ থমকে গেলো। এতক্ষণ চারবন্ধু চেয়ারেই বসেছিলেন। অনেকে আসছিল যাচ্ছিল, কোনো হেলদোল ছিল না তাঁদের। কিন্তু সেই স্বদেশী পোষাক পরিহিত ভদ্রলোক প্রবেশ করতেই উঠে দাঁড়ালো তাঁরা। শুধু উঠে দাঁড়ালোই না, সেই ভদ্রলোককে তারা সম্বোধন করলো – ‘ডি মাস্টার… ডি মাস্টার!’
ওই চার বন্ধুর নাম জানেন? ম্যালকম মার্শাল-জোয়েল গার্নার-অ্যান্ডি রবার্টস-মাইকেল হোল্ডিং। ইতিহাসের সর্বগ্রাসী আগ্নেয়াস্ত্রের বোলিং টেট্রা।
কাট টু ১৯৯২-৯৩। বোম্বে রায়োটের আগুন তখন ছড়িয়ে পড়েছে মুম্বইয়ের অলিগলিতে। সেদিনের সেই পাতলুম পরিহিত ভদ্রলোকের তখন অবসর উত্তর জীবন। ভদ্রলোক দৈনন্দিনের মর্নিং ওয়াক সেরে সবে লেবু জলের অর্ডার করেছেন। এমন সময় দেখলেন সামনে বিশাল ঝামেলার সূত্রপাত।
আসলে তার বাড়ির সামনেই একটা গাড়িকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিল ক্ষুব্ধ জনতা। গাড়ির মধ্যে ড্রাইভার ছাড়াও এক মা আর শিশু ছিল। বোম্বে রায়োটের এক অগ্নিশিখার বহিঃপ্রকাশ। উত্তেজিত জনতার ক্রোধ সেদিন প্রাণ নিয়েই ছাড়তো গাড়ির মধ্যেকার সবকটি মানুষের। নিজের বাড়ির দোতলা থেকে দৌড়ে গেলেন সেই ভদ্রলোক।
জনতার সার্কেলকে ভেদ করে তিনি গাড়ির কাছে পৌঁছে বুক চাপড়ে বললেন, ‘আমি বেঁচে থাকতে এদের কিচ্ছু হতে দেবনা আমি। আগে আমার গায়ে হাত দাও, তারপর এদের গায়ে হাত দেবে।’ সেদিন প্রাণে বেঁচে ছিল গাড়ির মধ্যে থাকা ড্রাইভার সহ নিষ্পাপ শিশু আর তার মা। উদ্ধারকর্তা ছিলেন সেই ভদ্রলোক। আসলে যিনি মার্শাল-গার্নারদের হেলমেট ছাড়া সামলেছেন, তাঁর কাছে রায়োট কি আদৌ গুরুত্ব পায়?
কে এই ভদ্রলোক? আসুন জেনে নিই।
১.
তখন তিনি সদ্যোজাত। পড়ন্ত বিকালে তাঁর দূরসম্পর্কিত এক কাকা হাসপাতালে তাঁকে দেখতে এসে আবিষ্কার করলেন, তাঁর বাম কানে একটা গর্ত আছে।
পরেরদিন সকালবেলায় সেই কাকা আবার সদ্যোজাতকে দেখতে এসেছিল হাসপাতালে। কিন্তু একই বেড থেকে যে বাচ্চাটিকে তিনি কোলে নিলেন, তাঁর দিকে চেয়েই তিনি চমকে উঠলেন; একী বাম কানের পাশে গর্তটা কই! শুরু হলো আসল বাচ্চার খোঁজ।
অবশেষে পাওয়া গেলো তাকে। এক জেলেনীর কোলে খিলখিল করে হাসছে সেই সদ্যোজাত।সম্ভবত কোনো একটা কারণে অদল-বদল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, প্রশ্ন হচ্ছে, সেদিনের দূরসম্পর্কিত কাকার বামকানের ছোট্ট গর্তটা চোখে পড়াটা শুধুই কি মিরাকেল? নাকি ভারতীয় ক্রিকেট উদ্যানে প্রথম শক্তপোক্ত বটগাছ স্থাপনের ঈশ্বর-সংকেত?
২.
ছেলেটার বয়স তখন ২১ বছর। হ্যাঁ, যে বয়সে আমি-আপনি কলেজে যাই কিংবা সদ্য কলেজ পাশ করে চাকরির চেষ্টা করি, সেই ছেলে সেই বয়সে বুক চিতিয়ে গেলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ব্যাটসম্যানদের সাক্ষাৎ মৃত্যুখাদ। বিচরণ করছে গ্যারি সোবার্স ডোয়ে-স্নেফার্ড-হলফোর্ডরা। ভয় পেলোনা সে।
অভিষেক টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ৬৭ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে ভারতকে এনে দিল জয়। হ্যাঁ, পেস বোলিংয়ের মৃত্যুখাদের একখণ্ড ভারতবর্ষের প্রথম ইমারত; উইন্ডিজদের ঘরের মাঠে প্রথম জয়; কারিগর সেই ছেলেটা। ক্রিকেটের ভাবী সম্রাটের পদধ্বনি শুনলো ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্যালিপসো গাইয়েরা।
পরের টেস্টগুলিতে তাঁর ইনিংসগুলো জানেন? -১১৭,১১৬,৬৪,১২৪,২২০। গোটা সিরিজে তার একার রানই সাতশোর বেশী। সময়টা মনে রাখবেন ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধের আঁচ পড়েছে ভারতেও। সাইরেনের শব্দে বিভোর বাংলা। একদিকে নকশাল অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের যৌথতীরে ঘুম আসেনা আর বাঙালির।
এইসময় ভারতবর্ষ পেয়ে গেল তাদের প্রথম ক্রিকেট সুপারস্টারকে; যাকে দেখে ঘুমাতে যেত একটা অখণ্ড ভারতবর্ষ। যেন স্বয়ং ক্রিকেট ঈশ্বর নিজে এসেছে তার বিগ্রহে পুষ্পাঞ্জলি দিতে। কি অনবদ্য সব টেকনিক,কি দুর্দান্ত রিফ্লেক্স। যেন উত্থাল ক্যারিবিয়ান সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ছে একের পর এক।
আর ছেলেটা কোনো হেলমেট ছাড়া, কোনো বর্ম ছাড়া সাহসী যোদ্ধার মতো সামলে নিচ্ছে সেই সব ঢেউগুলো। সেই উত্থাল ক্যারিবিয়ান সাগরও পরাজিত হয়েও যেন কুর্নিশ জানাচ্ছে তাকে। বিখ্যাত কবি লর্ড রিলেটর তাঁর ব্যাটিং সাধনায় মুগ্ধ হয়ে রচনা করলেন ক্যালিপসো –
De Real Master,
Just Like a wall,
We could not out Gavaskar at all, not at all.
You know the West Indies couldn’t out Gavaskar at all.
৩.
সেই ছেলে তখন মধ্য তিরিশের যুবক। রঞ্জির ম্যাচ চলছে বোম্বে আর কর্ণাটকের মধ্যে। কর্ণাটকের রঘুরাম ভাট নামক এক স্পিনারের ছোবলে কুপোকাত হচ্ছে বোম্বের একের পর এক ব্যাটসম্যান। সেই মধ্য তিরিশের যুবক ব্যাট করতে এলো সাত নম্বরে। রঘুরাম ভাট একজন বাম হাতি আন-অর্থোডক্স স্পিনার। তাকে সামলাতে এক অভিনব কায়দা বার করল সেই যুবক।
ডান হাত ছেড়ে ছেলেটা ব্যাট করতে লাগল বাম হাতে। ব্যাস। যে রঘুরামের বল ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের নাকানি চোবানি খাওয়াচ্ছিল, সেই বলগুলো বাম হাতি ব্যাটধারী সেই ছেলেটার ডিরেক্ট বডিতে বাউন্স খেয়ে লাগছিল। ফলস্বরূপ নো লেগ বিফোর উইকেট, নো চান্স অফ আউট। গোটা স্টেডিয়াম থ। কী বলবেন এটাকে? টেকনিক? স্ট্র্যাটেজি? নাকি ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা? ছেলেটা যেন নিঃশব্দে জানান দিল সবাইকে – ‘It is Gavaskar, Just like a wall, You cannot out me at all. You know,you cannot out me at all.’
যে বয়সে আমি-আপনি কলেজে পড়ি,সেই বয়সে সে হেলমেট ছাড়া সামলে এসেছিল গ্যারি সোবার্সদের। যে আমি আপনি ডানহাত ছেড়ে বামহাতে লিখলে হাত কাঁপে, সেই ছেলেটা ডানহাত ছেড়ে বামহাতে একনাগাড়ে সামলে এসেছিল রঘুরাম ভাটকে। যে বয়সে আমি আপনি অবসর উত্তর জীবনে নিশ্চিন্ত ভাত ঘুম দিই, সে বয়সে সে বুকচিতিয়ে বোম্বে রায়োটের মাঝে বুক চিতিয়ে বাঘের মতো বলে এসেছিল ‘আগে আমার গায়ে হাত দাও, তারপর এই নিরীহ মানুষদের ছোঁবে।’
যাকে দেখলে চেয়ার ছেড়ে ‘ডি মাস্টার’ বলে উঠে দাঁড়ায় মার্শাল-গার্নার-রবার্টস-হোল্ডিংরা, উইন্ডিজ মাটিতে যার ব্যাটের স্পর্শে পাগল হয়ে গান লেখে সেই দেশেরই ক্যালিপ্সো কবি; ভারতবর্ষের প্রথম ক্রিকেট আইকন সুনীল মনোহর গাভাস্কার।
তাঁর উইলো কাঠে সেঁটেছিল নিঃশব্দ দুইফলা তলোয়াড়। যার এক ফলা খুন করেছে ডেনিস লিলি,ম্যালকম মার্শাল,মাইকেল হোল্ডিং এর আগুনে পেস আক্রমণকে। হ্যাঁ, সামলেছে ছেলেটা কোনো হেলমেট ছাড়াই,কোনো বর্ম ছাড়াই।আর তাঁর আরেক ফলা সৃজনশীল। যেন ভারতের ক্রিকেট মরুভূমিতে খোদার পাঠানো এক বটগাছ যে নিজেও বড়ো হয়েছে আর বীজ ছড়িয়ে মরুভূমিকে করে গেছে এক মরুদ্যান।
তিনি সুনীল মনোহর গাভাস্কার। ভারতের প্রথম ক্রিকেট সম্রাট। যেন শরীরের কোনো বাফারিং সিস্টেম যেন যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলে নেয়,কখনো নিজে পরিবর্তন হয়ে ঠিক যেমন ডান হাতি থেকে হয়ে গিয়েছিলেন হঠাৎ বামহাতি, কখনো বা পরিস্থিতিটাকে পরিবর্তন করে, ঠিক যেমন নিজের জীবনের শেষ ম্যাচে ১৯৮৭ সালের ব্যাঙ্গালোরের দুর্ভেদ্য স্পিনিং ট্র্যাকে পাকিস্তানের মৃত্যুস্বরূপ আক্রমণকে একা সামলেছিলেন।
বল খুব স্পিন করছিল বলে বলটাকে মাটিতেই পড়তে দেননি। এগিয়ে এসে খেলেছিলেন আর করে গিয়েছিলেন ৯৬ রান যেটিকে ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইনিংস ধরা হয়।কারণ শ্রেষ্ঠত্ব সংখ্যা দিয়ে হয়না হয় অপরিহার্যতা দিয়ে,কাঠিন্য দিয়ে।
১৯৮৩ এর জর্জটাউন। ম্যালকম মার্শালের আগুনে বাউন্সার সোজা মাথায় আঘাত হানল।আহত জায়গায় হাত দিলেন না,পাছে মার্শাল মনোস্তাত্তিক সুবিধা পায়। হেলমেটও পড়লেন না। খালি মৃত্যুখাদের ধারে দাঁড়ানো এক অধ্যাবসায়ীর মতো ব্যাট করে গেলেন। কিরণ মোরে আইস প্যাক নিয়ে গেলে তাকে “গেট আউট”বলে ফিরিয়ে দেন।কোনো হেলদোল না করেই ব্যট করে গেলেন।
আর দিনের শেষে ১৪৭ রানের অপরাজিত ইনিংস ।এটাই কি তবে টেস্ট ক্রিকেট? যেখানে স্থৈর্য হার মানায় উত্তেজনাকে, যেখানে সহনশীলতা হার মানায় রুক্ষতাকে, যেখানে স্বেদন হার মানায় শোনিত কে? – এগুলো কিন্তু শিখিয়ে গেছেন সেই গাভাস্কারই।ম্যালকমকে যেন চোখ মেরে বলে গেলেন, ‘In every pain, in every blood, in every sorrow, I am there to fight and to fight.’
ওরা বলে প্রথম ক্রিকেট আইকন। আর আমি বলি ক্রিকেটের প্রথম আকাশ, যিনি একদিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন বিজয় মার্চেন্টের ব্যাটিং ঘরানা, আবার অন্যদিকে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থাপন করেছেন ভারতীয় ব্যাটিং ঘরানার স্থাপত্য। বিতর্ক তো তাঁর নামে আছেই।
মন্থরতম ব্যাটিং এর ইতিহাস, লবি গিরি আরও কত কি। কিন্তু এটাও জেনে নিন ভারতীয় ক্রিকেটে ওডিআইয়ের প্রথম কনসেপ্ট দিয়েছিলেন কপিল দেব। তার আগে অবধি ওয়ানডে একেবারে অনভ্যস্ত ভারতে মন্থর ব্যাটিংয়ের ঘটনাগুলো কিন্তু জ্ঞানহীনতা থেকে এসেছে, স্বার্থপরতা থেকে নয়। সব বিতর্ক মাথায় রেখেও তিনিই ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম আকাশ যার ছাদের তলায় ৭১’ এর রাজনৈতিক চরমাবস্থায় একফালি সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছিল অখণ্ড ভারতবর্ষ।
আইকন নন, তিনি প্রথম আকাশ।
তাঁর জন্মদিনে পোস্টের ঢল বয়ে যায়না অনেকের মতো। ১৯৭১ সালে ফেসবুক ছিলনা, যদি থাকতো, তাহলে মার্ক জুকারবার্গ নিশ্চিতভাবে রিয়্যাক্টের অপশন লিস্টে লাভ-স্যাড-কেয়ারের পাশাপাশি একটা নীল আকাশের ছবি রেখে দিত, যে আকাশ ধৈর্যের কথা বলে, প্রথম প্রেমের কথা বলে,প্রথম খুশির কথা বলে আবার প্রথম দুঃখের কথা বলে।
তিনি নাকি অহংকারী? একটি উদাহরণ দিই। ব্র্যাডম্যানের সেঞ্চুরির রেকর্ড ব্রেক করবার পর সাংবাদিকরা যখন হইচই করছে তাঁকে নিয়ে, তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘ত্রিশটা সেঞ্চুরি করে রেকর্ড আমি ভাঙিনি। রেকর্ডটা আমি ভাঙতে পারতাম যদি এই ত্রিশটা সেঞ্চুরি আমি পঞ্চাশটা টেস্টে করতে পারতাম। (প্রসঙ্গত, ব্র্যাডম্যান ২৯ টা সেঞ্চুরি করেছিলেন মাত্র ৫২ টেস্টে)। এই রেকর্ড আজও ডনের।’
আজ তিনি অনেক দূরে, সমস্ত প্রচারের বাইরে। ভারতের ক্রিকেটের একদা শঙ্খচিল আজ ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে দেশান্তরে। জন্মদিবসে বিস্মৃতির আড়ালে তলিয়ে যাওয়া সুনীল আকাশে এখন চেয়ে থাকে একটা গোটা ভারতবর্ষ। হয়তো বিবাগী সুরে গেয়ে চলে, ‘তুমি বরুণা হলে আমি সুনীল। তুমি আকাশ হলে হবো শঙ্খচিল।’
মানুষের স্মৃতি যে ক্ষণস্থায়ী। মেঘে ঢাকা সুনীল আকাশে হয়তো কোনো একদিন এক ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কবি নারকেল গাছের তলায় ক্যারিবিয়ান সাগরের পারে বালির মধ্যে খুঁজে বেড়াবে তার সুনীলকে। হয়তো আপনমনে গেয়ে চলবেন তার হারানো সেই ক্যালিপ্সোটা –
De real master,
Just like a wall.
We couldn’t out Gavaskar at all, not at all
You know the West Indies couldn’t out Gavaskar at all.