সৈয়দ কিরমানির উইকেটটা পড়বার সাথে সাথে ভারত অল আউট হয়ে গেলো ১৮৩ রানে। সবাই ভীত সন্ত্রস্ত।বিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ।এত কম রানে কিভাবে জেতা সম্ভব, হাল ছেড়ে দিল সবাই। তখনই চওড়া হাসি হেসে সবার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে তাদের অধিনায়ক। চওড়া গোঁফ, চওড়া ছাতি, আর সব থেকে চওড়া বোধহয় বুকের পাটা টা, তারস্বরে বললেন, ‘চালো জওয়ানো লাড়কে আতে হে।’
হয়তো এই পেপটকটাই এক্সট্রা অ্যাড্রিনালিন দিয়েছিল ওই ১৯৮৩ এর ২৫ জুনের ফাইনালে। অশ্বমেধের ঘোড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজকে থামিয়ে লর্ডসের আকাশে নীল রামধনু রাঙিয়ে বিশ্বজয় করেছিলো সেই হারিয়ানা হ্যারিকেনের জওয়ানরা। আর সামনে সিংহের মতো রাজকীয়তায় চওড়া গোঁফের সেই লোকটা লর্ডসের ব্যালকনিতে তুললেন প্রুডেনশিয়াল ট্রফিটা। যেন জানান দিলেন, ‘এসে গিয়েছি আমি; বিশ্ব, তোমাকে জয় করতে।’
ইনি কপিল দেব রামলাল নিখাঞ্জ।
তাঁর আবির্ভাব এমন সময়ে হয়েছিল যে সময়ে ভারতীয় ফাস্ট বোলিং ব্যাপারটা বাঘের দুধের মতোই কাল্পনিক। ১৯৭৭ সাল। পাকিস্তান সিরিজ।আবির্ভাব হলো তাঁর। যেন বাঘের দুধের কাল্পনিক চাহিদা মেটাতে স্বয়ং বাস্তবের বাঘ নেমে এসেছেন ভারতের হয়ে খেলতে। যেন সৃষ্টিকর্তা রুক্ষতম মৃত্তিকায় বপন করলেন তাঁর ঝুলিতে থাকা উর্বরতম বীজটি।
দুটো সিরিজেই বুঝিয়ে দিলেন তাঁর সিংহ হৃদয়ের অন্তর্নিহিত উপন্যাসটা, ‘I shall go to the top, to the top।’ মধ্যবিত্ত ঘরের অতি সাধারণ একজন হয়েও তাঁর সুঠাম গঠন, আর অ্যাথলিটিজমে মুগ্ধ হয়ে চন্ডী গাঙ্গুলী একবার বলেছিলেন, ‘কী ফিটনেস না! দেখলে মন ভরে যায়।’একটা ছোট শহরের ছেলে, পেছনে ছিল না মুম্বাই লবি, না ছিল সুইং পরিবেশ। তবুও এতগুলো প্রতিকুলতাকে জয় করে আর বাবার দেওয়া সাহসটাকে হাতিয়ার করে ইতিহাসের ফিনিক্স পাখির মতো আবির্ভাব তাঁর, ভারতীয় ক্রিকেটের বিস্ময়।
যেমন ভয়ংকর গতিময় বোলিং, তেমন সুইং, সুইংয়ের পরিবেশ ছাড়াই রেকর্ড ৪৩৪ উইকেট, তেমনি মারকাটারি ব্যাটিং, ব্যাট তো নয়, যেন হাতির গদা যে এক হাতে গুঁড়িয়ে দিতে পারে প্রতিপক্ষকে। যেন বিশ্ব ক্রিকেটের অলিখিত সর্বনায়ক যিনি কঠিন পরিস্থিতিতেও অভয় দেন, ‘নাই নাই ভয়, হবেই হবেই জয়।’
কপিল মানে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আবশ্যিক জয়ের ম্যাচে ১৭-৫ এ মাঠে নামে ১৭৫ রানের তাণ্ডব, যেন শত লাশের মাঝে স্বয়ং সম্রাট নেপোলিয়ন এসেছেন এবার তলোয়ার চালাতে, আর বলছেন, ‘যতক্ষণ কপিল আছেন, ততক্ষণ কোনো ভয় নেই।’ কপিল মানে লর্ডসে পরপর চারটে ছয় মেরে ফলোঅন বাঁচানো, কপিল মানে একাশির মেলবোর্ন টেস্টে আহত হ্যামস্ট্রিং নিয়ে পাঁচ উইকেট, কপিল মানে অসুস্থ শরীরে হিরো কাপ ফাইনালে লারাদের তুবড়ে দেওয়ার মতো বোলিং, কপিল মানে ৮৩’র ফাইনালে স্নায়ু চাপ ধরে রেখে অতটা দৌড়ে নেওয়া অবিশ্বাস্য ক্যাচ।
সাংবাদিক গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের কথানুযায়ী তিনি হলেন, ‘ধোনির আগের ধোনি, দ্রাবিড়ের আগের দ্রাবিড়, সৌরভের আগের সৌরভ, শ্রীনাথের আগের শ্রীনাথ।’ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম র্যোমান্টিসিজম।
তিনি এসেছিলেন যেমন মরুভূমিতে অরণ্যদেবের দূত হয়ে, চলেও গেলেন হাসিমুখে। সেই ট্রেডমার্ক চওড়া হাসি। একবারই কাঁদতে দেখেছিলাম তাঁকে, যখন এমন একজন ব্যক্তিত্বের ওপরেও আনা হয়েছিল বেটিংয়ের চার্জ, এনেছিলেন তাঁরই কাছের মানুষ।
এ যেন জুলিয়াসের বুকে ছুঁড়ির আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করছে ব্রুটাস ।চওড়া ছাতির সেই লোকটা যেন শিশুর মতো ভাবলেশহীন কান্নায় আর্তনাদ করছে, ‘মুক্তি দাও আমায়, মুক্তি দাও।’ দীপাবলির সন্ধ্যায় প্রেস কনফারেন্সে যখন তিনি তাঁর আচমকা অবসরের কথা ঘোষণা করলেন, যেন অমাবস্যার আঁধার গ্রাস করল আকাশের চন্দ্রদেবকে। চারিদিক থমথমে, চুপ।
এতদিন ধরে তাঁকে বাদ দেবার নোংরা রাজনীতি, মিথ্যা বেটিং চার্জ যেন নৃশংস হাসি হাসছিল সেদিন, কপিল সেদিন বললেন তাঁর মায়ের সেই অমরবাণীটা- ‘কুক্কু, যাবভি ছোড়না, হাসকে ছোড়না।’ তাই তিনি চলে গেলেন হাসতে হাসতে, কলার উচু করে, চওড়া গোঁফে পাক দিতে দিতে। ভারত সেদিন হারিয়েছিল তার প্রথম ও অন্তিম অনির্বাণতম দ্বীপ শিখাকে।
গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথের কথায়, ভারতের সবচেয়ে বেশী মাটিতে থাকা সুপারস্টার যে সর্বদা তৈরী বন্ধুর বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তে। তাইতো যখনই প্রবল প্রতিকুলতা প্রতিদ্বন্দী হিসেবে খাড়া হয় সামনে, তখনই যেন কাঁধে একটা রোমশ হাত এসে পড়ে, চওড়া গোঁফে হাসতে হাসতে আমাকে যেন সে বলছে, ‘চালো জওয়ানো, লাড়কে আতে হ্যায়’ – যেন তিনিও প্রস্তুত আমার যুদ্ধের সারথী কৃষ্ণ হয়ে আমার কাঁধে কাঁধ মেলাতে।
আজও চোখ বন্ধ করলে অনুভব করি সেই লোকটা মাঝে মাঝে কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে মাসেলটাকে লুজ করছে, আর দৌড়ে আসছে বল করতে, অক্লান্ত সে দৌড়, লক্ষ্যভেদী সে দৌড়, বিরামহীন সে দৌড়, আর পাশ থেকে যেন তার মা বলে যাচ্ছে, ‘কুক্কু ছোড়না নেহি, লেকিন যাবভি ছোড়না হাসকে ছোড়না।’
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, ওটা কি কপিল দৌড়াচ্ছে? নাকি গোটা ভারত? আমি ঠিক জানি না, ঠিক জানি না।