রুপকথার শুরুও যতটা রুপকথাময় নয়!

চ্যাম্পিয়ন্স লিগের দ্বিতীয় রাউন্ডের সবচেয়ে বড় চমকটা দিয়েছে এফসি শেরিফ নামক একটি ফুটবল দল। অধিকাংশ ফুটবল ভক্ত-সমর্থকেরা হয়ত কখনো নাম শোনেনি। তবে কিছু সংখ্যক ভক্ত হয়ত জানেন এই দলের নাম। ইউরোপা লিগের চার আসরে গ্রুপ পর্বে খেলা দল এফসি শেরিফে এবার প্রথমবারের মতো খেলতে এসেছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে কোয়ালিফাই করা থেকে এখন অবদি তাদের পুরো যাত্রাই যেন এক রুপকথা।

আমাদের দেশে গ্রামে-গঞ্জে প্রতিনিয়তই আমরা সিনিয়ার বনাম জুনিয়ার মধ্যকার ফুটবল কিংবা ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজিত হতে দেখি। ছোটরা জানে তাঁরা শক্তিমত্তা কিংবা অভিজ্ঞতায় বড় ভাইদের তুলনায় ঢের পিছিয়ে। হেরে যাবার সম্ভাবনা প্রখর। তবুও তাঁরা খেলে, নিজেদের জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করে যায় শেষ অবদি। আর যদি হারিয়ে দেওয়া যায় বড়দেরকে তাহলে তাদের আনন্দের সীমানা যে আকাশ ছাড়ায় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

এ ঘটনা টেনে আনবার বিশেষ কারণ নেই, দৃশ্যায়ন করার চেষ্টা সেই মুহূর্তটা যখন হারা নিশ্চিত জেনেও জিতে ফেরা যায়, আনন্দে ফেটে পরা যায়। এমন এক আনন্দের মুহূর্ত এসেছিল মলডোভার ক্লাব এফসি শেরিফ টিরাসপোলের পক্ষে।

১৯৯৭ সালে স্বাধীনতা পাওয়া মালডোভা নামক ইউরোপের ছোট্ট একটি দেশের ক্লাব এফসি শেরিফ টিরাসপোল। শত প্রতিক্ষার পর তাঁরা প্রথমবারের মতো সুযোগ পেয়েছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ পর্বে। ‘শুরুতেই বাজিমাৎ’ – কথাটা তাঁদের সাথে যথার্থই বটে। কেননা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ-ডি এর প্রথম স্থান এখন তাঁদের দখলে। যেই গ্রুপে রয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ, ইন্টার মিলান ও শাখতার ডোনেক্সের মত বড় দল।

রুপকথার এই যাত্রায় গত ২৮ সেপ্টেম্বর তাঁরা কাটিয়েছে এক স্বপ্নের রাত। যে রাতে তাঁরা হারিয়েছে ১৩ বারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতা ইউরোপিয় জায়েন্ট রিয়াল মাদ্রিদকে। এ দিন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচে মুখোমুখি হয় রিয়াল মাদ্রিদ ও এফসি শেরিফ।

পুরো ম্যাচে তাঁদের চিরায়ত খেলার ধরণ অনুসরণ করে আধিপত্য বিস্তার করে খেলতে থাকে রিয়াল মাদ্রিদ। কিন্তু আন্ডারডগ হিসেবে একটা মানসিক চাপ নিয়েই খেলতে নামে শেরিফের খেলোয়াড়েরা। তাই আঁটসাঁট করে রাখে মলডোভা থেকে আসা দলটি।

নিয়তি তাঁদেরকে দু’হাত ভরে দেবার ইচ্ছে নিয়েই বসেছিল, দিয়েছেও। সুযোগ হাত ছাড়া করেননি উজবেকিস্তানের খেলোয়াড় জাসুরবেক ইয়াকশিবোয়েভ। ম্যাচের ২৯ মিনিটে কাউন্টার অ্যাটাক থেকে ডি-বক্সের মধ্যে আশা ক্রসে হেড করে গোল আদায় করে নেন ধারে খেলতে আশা ইয়াকশিবোয়েভ। তাঁর গোল পরবর্তী উদযাপনই বলে দেয় এই গোল কতটা গুরুত্বপুর্ণ, এ গোল কতটা মহিমান্বিত।

শেরিফের গোল বার আগলে রেখেছিল তাঁদের গোলকিপার গিওরগোস অ্যাথানাসিয়াডিস। রিয়ালের ১১ টি শট প্রতিহিত করছেন তিনি রক্ষণের সহয়তায়। আঁটসাঁট রক্ষণের বিরুদ্ধে গোল পাওয়া দুষ্কর হয়ে গিয়েছিল লস ব্ল্যাঙ্কোসদের। কিন্তু শেরিফের এক রক্ষণভাগের খেলোয়াড়ের ভুলে ম্যাচের ৬৫ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল আদায় করে ম্যাচে সমতা ফেরায় ফর্মের তুঙ্গে থাকা করিম বেনজেমা। পুরো বার্নাব্যু যখন ভেবেছিল জয় নিয়েই মাঠ ছাড়বে কার্লো আনচেলত্তির শীষ্যরা।

কিন্তু শেরিফ যেন ছিল সংকল্পবদ্ধ। রিয়ালকে দেওয়া যাবে না পূর্ণ তিন পয়েন্ট। সেই লক্ষ্যেই রক্ষণে মন দেয় তাঁরা। শেরিফের খেলোয়াড়েরা কখনো হয়ত চিন্তা করেনি ভাগ্য তাঁদের প্রতি এত প্রসন্ন হবে।

আবারো রিয়ালের হাই অ্যাটাক লাইন ও অগোছালো রক্ষণের সুবিধা নিয়ে ম্যাচের ৮৯ মিনিটে ডি-বক্সের সামনে পাওয়া বলে বা’পায়ের জোড়ালো ভলিতে থিবো কোর্তোয়াকে কোন সুযোগ না দিয়েই টপ লেফট কর্ণার দিয়ে বল জালে জড়িয়ে নেন লুক্সেমবার্গ থেকে আগত শেরিফের মধ্যমাঠের খেলোয়াড় সেবাস্তিয়ান থিল। সে কি শক্তিশালী ভলি! যেই ভলি গড়েছে নতুন ইতিহাস। যেই ভলি ভাসিয়েছে গোটা মালডোভাকে আনন্দের জোয়ারে।

২-১ ব্যবধানে রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে এবং শাখতার ডোনেক্স ও ইন্টার মিলানের মধ্যকার ম্যাচ ড্র হবার সুবাদে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলতে আসা এফসি শেরিফ দখল করে নিয়েছে গ্রুপের প্রথম স্থান। এর আগে তাঁরা গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে শাখতার ডোনেস্কেও হারিয়েছিল এফসি শেরিফ। তাও আবার ২-০ ব্যবধানে। সে ম্যাচে শেরিফের হয়ে গোল করেছেন আদাম ত্রাওরে ও মোমো ইয়ানসানে।

এবারই প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলার সুযোগ পেলেও এর আগে এফসি শেরিফ টানা তিনবার সহ মোট চার বার খেলেছিলো ইউরোপা লিগের প্রথম রাউন্ড কিন্তু কোন বারই তাঁরা দ্বিতীয় রাউন্ডে পদার্পণ করতে পারেনি। এবার জাতীয় পর্যায়ে রেকর্ড সংখ্যক শিরোপা জয়ী এফসি শেরিফ টিরাসপোলের সামনে রয়েছে ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের মঞ্চে নিজেদের ছাপ ফেলে যাওয়ার। জয়ের এমন ধারা এবং জায়েন্ট বধের মিশন অব্যাহত থাকলেই রুপকার যাত্রা হবে আরো বর্ণিল, ছোঁয়া যাবে স্বপ্ন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link