বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের স্কোয়াডে সাকিব আল হাসানের সাথে আরো চার পাঁচ জন অলরাউন্ডার রয়েছেন। দলের প্রধান শক্তি হিসেবে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ বেশ কয়েক বারই অলরাউন্ডারদের কথা বলেছেন। তবে স্বনামধন্য কোচ ও ক্রিকেট বিশ্লেষক নাজমুল আবেদীন ফাহিম মনে করেন বিশ্বকাপে বাংলাদেশের মূল শক্তির জায়গা হতে পারেন বোলাররা।
দেশের মাটিতে গত দুই সিরিজে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। এই দুই সিরিজ জয়ের পিছনে মূল অবদান ছিল বোলারদের। দুই সিরিজে স্পিনারদের সাথে সমান তালে দাপট দেখিয়েছেন বাংলাদেশের পেসাররাও। ঘরের মাঠে দুর্দান্ত এই সফলতার জন্য বিশ্বকাপের আগে আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে রয়েছেন বাংলাদেশের বোলাররা।
খেলা ৭১ – এর সাথে আলাপকালে নাজমুল আবেদীন ফাহিম জানিয়েছেন এখন যদি সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানের কন্ডিশনে বোলাররা মানিয়ে নিতে পারেন তবে তাঁরাই হবেন বাংলাদেশ দলের মূল ভরসার জায়গা। অভিজ্ঞ এই কোচ মনে করেন আত্মবিশ্বাসের কারণে বোলারদের ভিতর নেগেটিভ কিছুও তেমন কাজ করবে না।
ফাহিম বলেন, ‘এই সময় বোধহয় বোলিংকেই মূল শক্তি বলতে হবে। এখন বোলিংয়ে আমরা সফলতা পেয়েছি এটা একটু আত্মবিশ্বাসী করে রাখবে। আত্মবিশ্বাসের জন্য নেগেটিভ কিছু কাজ করবে না। এবং আমাদের বোলাররা যে খুব খারাপ বোলিং করেছে সেটাও না। আগেও বলছি এখানে সহজ কন্ডিশনে বল করেছে, ওখানে কঠিন কন্ডিশনে বোলিং করতে হবে। এরপরেও যদি মানিয়ে নিতে পারে আমাদের বোলিংয়ের উপর ভরসা করা যায়।’
অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ জয়ে বোলারদের বড় অবদান থাকলেও তাদের সফলতার পিছনে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে মিরপুরের মন্থর ও টার্নিং উইকেট। কন্ডিশনের সুবিধা কাজে লাগিয়ে বল হাতে প্রতি ম্যাচেই আগুন ঝড়িয়েছেন বোলাররা। কাটার, স্লোয়ার, ইয়র্কার, টার্ন সবই খুব সহজে পেয়েছেন সাকিব মুস্তাফিজরা।
ঘরের মাঠের এই দুই সিরিজে ওভার প্রতি ছয় রানের উপরে গুনতেই হয়নি কোন বোলারকে। দেশের মাটিতে ছয় রানের নিচে দেওয়ার কাজটা যেখানে খুব সহজেই করে গিয়েছেন বোলাররা সেখানে বিশ্বকাপে এই ইকোনমি রাখাটা অসম্ভব হয়ে যাবে বোলারদের জন্য। দেশের মাটিতে এরকম উইকেটে খেলে গিয়ে বিশ্বকাপের কন্ডিশনে বল করতে হবে দেখে এখানে নিজেদের একটু পিছিয়ে রাখছেন নাজমুল আবেদীন ফাহিম।
তিনি বলেন, ‘আর বোলিংয়ে যেটা হয়েছে আমরা খুব সহজেই সফলতা পেয়েছি এই কন্ডিশনে। আমরা জানি টি-টোয়েন্টি এরকম সহজ না। বোলারদের পক্ষে ওভারে চার রান বা সাড়ে চার রান দেওয়া এটা আসলে সম্ভব না ভালো উইকেটে। সব সময় এটা কঠিন। কিন্তু বিশ্বকাপে তো এরকম থাকবে না। ওখানে যেরকম থাকবে সে রকম উইকেটে ম্যাচ না খেলাতে আমরা মনে হয় কিছুটা পিছিয়ে গেছি।’
গত দুই সিরিজে বোলাররা দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করলেও ব্যাট হাতে একদম বাজে সময় পার করেছেন ব্যাটসম্যানরা। গত দুই সিরিজের দশ ম্যাচে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের পক্ষে একমাত্র হাফ সেঞ্চুরি পেয়েছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। এছাড়া বড় ইনিংস আসেনি আর কারো ব্যাট থেকে। ফাহিম মনে করেন এরকম উইকেটে খেলার কারণে ব্যাটসম্যানদের আত্মবিশ্বাসে যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে।
ফাহিম বলেন, ‘আমাদের ব্যাটসম্যানদের দিকে যদি আমরা তাকাই। যে রান করেছে ও তাদের যে স্ট্রাইকরেট ছিল, সব কিছু বিবেচনা করলে এটা যথেষ্ট খারাপ। এই রকম পারফরম্যান্স কখনোই কোন ব্যাটসম্যানকে আত্মবিশ্বাস দিতে পারে না। আমার মনে হয় এই সিরিজে ব্যাটসম্যানদের আত্মবিশ্বাসে ক্ষতি হয়েছে।’
ব্যাটসম্যানদের এরকম ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণেই তাদের নিয়ে এখনই কোন মূল্যায়ন করতে নারাজ স্বনামধন্য এই কোচ। বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ার রাউন্ড শেষ হওয়ার পর ব্যাটসম্যানদের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে বলে মনে করেন ফাহিম। তাই আপাদত তাঁর ভরসা দলের বোলারদের উপরই।
তিনি বলেন, ‘ব্যাটিংয়ের বিষয়ে এখনি কিছু বলতে পারছি না। আমরা কোয়ালিফায়ার রাউন্ড খেলবো তখন বুঝতে পারবো। ব্যাটিংয়ের অবস্থাটা কেমন। তবে বোলিংয়ে মোটামুটি ভরসা রাখা যায়।’
ফাহিম মনে করেন অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে যদি বিশ্বকাপের উইকেটের কাছাকাছি উইকেটও বানাতো বাংলাদেশ তবে দলের সার্বিক অবস্থাটা এখন বোঝা যেত। এটা না করার কারণে এই কোচ মনে করেন এই দুই সিরিজ স্বাগতিক হিসাবে যে বেনিফিট নেওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশের সেটা স্বাগতিকরা নিতে পারেনি কোন ভাবেই।
ফাহিম বলেন, ‘আমরা যদি বিশ্বকাপের কন্ডিশনের মোটামুটি কাছাকাছি থাকতাম তাহলে আমাদের আস্থার যে বিষয়টা সেটা থাকতো। সেই দিক থেকে ব্যাটসম্যানরা একটু ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বোলাররা ট্যাকটিক্যালি একটু সমস্যয় পড়বে। এখানে যে সুবিধা তাঁরা পেয়েছে সেখানে হয়তো তাঁরা সেটা পাবে না। সেটা তাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাবে। সব কিছু মিলিয়ে আমরা যে বেনিফিট নিতে পারতাম এই সিরিজ গুলো থেকে, সেটা আমরা নিতে পারিনি।’
বিশ্বকাপের মূল পর্ব অনুষ্ঠিত হবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। বিশ্বকাপের ভেন্যু গুলোতেই এখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) ১৪ তম আসরের বাকি অংশ। আইপিএল শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ পরেই সেখানে শুরু হবে বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপের আগে তাই উইকেট গুলোর বিশ্রামেরও কেমন সুযোগ থাকবে না।
অনেকেই মনে করছেন বিশ্বকাপের আগে বিশ্বকাপের ভেন্যু গুলোতে আইপিএলের ম্যাচ হওয়াতে ক্লান্ত থাকবে উইকেট গুলো। যার কারণে উইকেট মন্থর হয়ে যেতে পারে। তবে এই ধারণার সাথে একমত নন নাজমুল আবেদীন ফাহিম। এই কোচ মনে করেন বিশ্বকাপের উইকেটে অনেক রান হবে।
তিনি বলেন, ‘কেউ যদি এরকম মনে করে তাহলে তো আমার কিছু বলার নেই। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে কী হয় সেটা দেখার জন্য। আমরা দেশে যে রকম উইকেটে খেলেছি, বিশ্বকাপের কন্ডিশন যদি এরকম হয়ে যায় আমি খুবই খুশি হবো। কিন্তু আমার মনে হয়না বিশ্বকাপের কন্ডিশন এরকম থাকবে। উইকেট ব্যাটসম্যানদের জন্য কঠিন হবে, বোলারদের জন্য সুবিধা থাকবে, আমার মনে হয়না এরকম হবে। বিশ্বকাপে অনেক রান হবে। যদি কেউ মনে করে আইপিএলের কারণে উইকেট কঠিন হবে, সে বলতে পারে। তবে আমার কাছে মনে হয়না এরকম হবে।
বিশ্বকাপের মূল পর্ব খেলতে বাছাইপর্বে উত্তীর্ণ হতে হবে বাংলাদেশকে। প্রথম পর্বে স্বাগতিক ওমানের সাথে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ পাপুয়া নিউগিনি ও স্কটল্যান্ড। গ্রুপ পর্বে চ্যাম্পিয়ান হতে পারলে মূল পর্বে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ হবে ভারত, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড ও আফগানিস্তান। আর গ্রুপ পর্বে রানারআপ হলে মূল পর্বে বাংলাদেশ প্রতিপক্ষ হিসাবে পাবে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়াকে।
সাদা চোখে সব গুলো দলই শক্তিমত্তায় বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। তাই সব কিছু বিবেচনা করা বিশ্বকাপে বাংলাদেশের যাত্রাটা কঠিনই মনে হচ্ছে ফাহিমের কাছে। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি মূল পর্বের কথা বলি। যেগুলো দল আছে কাগজে কলমে সব গুলো দলই আমাদের থেকে ভালো। কিছু দল আছে আমাদের থেকে অনেক ভালো। এই সব কিছু বিবেচনা করে আমাদের জন্য কঠিন বলতেই হবে।’
তবে একাবারেই আশাহত হচ্ছেন না নাজমুল আবেদীন ফাহিম। এই কোচ মনে করেন বাংলাদেশ দলে এমন কিছু ক্রিকেটার রয়েছে যারা ম্যাচ জেতাতে পারে। এছাড়া বিশ্বকাপ খেলতে প্রায় দুই সপ্তাহ আগেই আগামীকাল ওমানের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়বে বাংলাদেশ। ফাহিম মনে করেন প্রস্তুতির এই সময়টা কাজে লাগাতে পারলে ভালো করার সম্ভবনা থাকবে বাংলাদেশের।
ফাহিম বলেন, ‘যেহেতু টি-টোয়েন্টি খেলা আমাদের কিছু ক্রিকেটার আছে হয়তো কিছু ম্যাচ জিতবো। আমাদের প্রস্তুতির যে সুযোগ রয়েছে, এটা যদি কাজে লাগাতে পারি, আত্মবিশ্বাস যদি ভালো জায়গাতে নিতে পারি। কারণ আত্মবিশ্বাস খুব গুরুত্বপূর্ণ এই ধরণের খেলায়। আত্মবিশ্বাস না থাকলে নেগেটিভ মানসিকতা নিয়ে খেললে খুব ভালো করা কঠিন হবে। আমার মনে হয় প্রস্তুতিটা ভালো নিতে পারলে আমরা ম্যাচ জিততে পারবো।’
তিনি আরো বলেন, ‘এটা বুঝতে হবে যে মূল পর্বে আমাদের গ্রুপে যারা থাকবে তাঁরা সবাই কিন্তু আমাদের থেকে ভালো। তাঁরা আশা করছে ভালো কিছু করার, আমরাও আশা করছি ভালো কিছু করতে। আমরা যদি বলি এই করবো, সেই করবো, আমি অসম্ভব বলছি না। তবে সেক্ষেত্রে ভাগ্যর উপর নির্ভর করতে হবে। প্রতিপক্ষ যদি খারাপ খেলে, আমরা যদি পূর্ণ পারফরম্যান্স দিতে পারি তাহলে সম্ভব হবে। আমরা খুব ভালো অবস্থায় নেই এটা আমরা জানি। আমরা ভালো খেলতে পারলে ম্যাচ জিততে পারবো।’
ঘরের মাঠে গত দুই সিরিজে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাটসম্যানরা বাজে সময় কাটালেও ব্যাট হাতে প্রায় প্রতিটা ম্যাচেই সাবলীল ছিলেন আফিফ হোসেন ধ্রুব। কিন্ত অনেক ম্যাচে আফিফকে এমন সময় ব্যাটিংয়ে পাঠানো হয়েছে যখন ইনিংসের বাকি ছিল মাত্র কয়েক ওভার।
কিছু ম্যাচে আফিফের ব্যাটিং অর্ডারও ঠিক ছিল না। আফিফকে আরো উপরে না খেলানোর সমালোচনাও হয়েছে অনেক। তবে ফাহিম মনে করেন আফিফকে উপরে না খেলিয়ে আফিফের উপরে যারা খেলে তাদের ভালো করাটাই গুরুত্বপূর্ণ।
ফাহিম বলেন, ‘সবারই ভালো খেলতে হবে। আফিফের পর সোহান আসবে, ওর ভালো করতে হবে। ভালো খেলা মানে এই না যে তাকে উপরে খেলাতে হবে। মুশফিককে নিচে খেলিয়ে আফিফকে উপরে খেলানো এখন যে সেটআপ আছে সেটা মনে হয় করবে না। আমার মনে হয় যেখানে আছে ঠিকই আছে। আমরা যদি বলি যে আফিফের উপরে যে আছে তাকে আরো ভালো খেলতে হবে তাহলে জিনিসটা ভালো হয়।’