সত্যিই কি খালি পায়ে বিশ্বকাপ খেলতে চেয়েছিল ভারত?

ভারতের ফুটবল আর আগের অবস্থানে নেই। জাতীয় দলের অবস্থান পাল্টেছে। খেলায় পেশাদারিত্ব অনেক বেড়েছে। এই সময়ে আই-লিগ, ইন্ডিয়ান সুপার লিগ (আইএসএল) ইত্যাদির মধ্য দিয়েও বেশ এগিয়েছে ভারত। তবে, এই এগোনোটা বিশ্বকাপ খেলার জন্য এখন পর্যন্ত যথেষ্ট নয়। এখনও ভারতকে আরও লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে।

তবে, একবার সত্যিই বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পেয়েছিল ভারত। তবে, শেষ অবধি মাঠে নামা হয়নি। চলুন, এবারে সেই অল্প শোনা গল্পটাই শোনা যাক।

এখন ভারতীয় ফুটবল একটু একটু করে এগোলেও ভারতীয় ফুটবলের স্বর্ণযুগ ছিল সেই দেশভাগের পরবর্তী সময়ে। মানে ১৯৪৭ সালের পর থেকে। ষাটের দশকের মধ্যবর্তী সময় অবধি সেই ‍যুগ টিকেছিল।

ভারত প্রথম সারাবিশ্বের নজরে আসে ১৯৪৮ সালের অলিম্পিক আসরে। সদ্য স্বাধীন হওয়া ভারত সেবারই প্রথম অলিম্পিকে অংশ নেয়। তারা ফ্রান্সের কাছে ২-১ গোলে হেরে যায়। ম্যাচের ৮৯ মিনিট পর্যন্ত তারা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে ম্যাচে ১-১ ব্যবধানের সমতা বজায় রেখেছিল।

অলিম্পিক সেবার হয়েছিল লন্ডনে। রাজা ষষ্ঠ জর্জ ভারতের পারফরম্যান্সে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন যে তিনি বাকিংহ্যাম প্যালেসে ফুটবল দলকে আমন্ত্রন জানান। এক বছর আগেও যে ব্রিটিশদের শোষনের শিকার হতে হয়েছে, সেবার সেই ব্রিটিশ রাজ দরবার থেকেই আসে নিমন্ত্রন। বিষয়টা ছিল, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জয়ও।

১৯৪৮ সালের অলিম্পিক খেলা ভারতীয় ফুটবল দল।

দলটার কোচ ছিলেন সৈয়দ আব্দুল রহিম। ফরোয়ার্ড আহমেদ খান দুর্দান্ত খেলেছিলেন। বল নিয়ন্ত্রনের অসামান্য ক্ষমতার কারণে ব্রিটিশ মিডিয়ার কাছ থেকে তিনি ‘সাপুড়ে’ ‍সম্বোধন পেয়ে যান। ওই অলিম্পিকের আসরে ভারতের কেউ খালি পেয়ে খেলেছেন, কেউ খেলেছেন কেবল মোজা পায়ে।

এর পরের বার, মানে ১৯৫২ সালের অলিম্পিক হয় ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কিতে। তখনও খালি পায়ে খেলে ভারত। কিন্তু, ফিনল্যান্ডের ঠাণ্ডা মাটিতে সেটাই তাঁদের জন্য বিপদ ডেকে আনে। যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে ১০-১ গোলে হারতে হয়। এরপরই অল ইন্ডিয়া ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (এআইএফএফ) বুট পরে খেলা বাধ্যতামূলক করে দেয়।

এবার আবার সেই বিশ্বকাপের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। ১৯৩৮ সালের পর টানা দু’টি বিশ্বকাপের আসর বিঘ্নিত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে ১২ বছর বন্ধ থাকার পর ১৯৫০ সালে আয়োজিত হয় বিশ্বকাপ।

ইউরোপের কোনো দেশ টুর্নামেন্ট আয়োজনে রাজি নয়। দায়িত্বভার তাই বর্তায় ব্রাজিলের ওপর। বিশ্বযুদ্ধে সম্পৃক্ততার কারণে নিষিদ্ধ হল জার্মানি ও জাপান। নিয়ম অনুসারে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করার কথা ১৬ টি দেশের।

স্বাগতিক দেশ ব্রাজিল ও ১৯৩৮ সালের চ্যাম্পিয়ন ইতালি ছাড়া সাতটি দেশ আসে ইউরোপ থেকে। ছয়টি জায়গা আমেরিকা মহাদেশের জন্য বরাদ্দ থাকে। এশিয়া থেকে বাকি একটা দেশের আসার কথা ছিল।

পঞ্চাশের দশকের ভারতীয় দল

বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার জন্য ফিফা ও আয়োজক দেশ ব্রাজিল চারটি দেশকে আমন্ত্রন জানায়। তারা হল – ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার ও ভারত। ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও সেকালের বার্মা আগেই না করে দেয়। তখন বিশ্বকাপের সুযোগ আসে ভারতের সামনে।

ব্রাজিলের পক্ষ থেকে আমন্ত্রন আসে, যাতায়াতের জন্য টাকা-পয়সা দেওয়ার আশ্বাসও দেয় লাতিন আমেরিকান দেশটি। তারপরও বিশ্বকাপে যাওয়া হয়নি ভারতের। অনেকে দাবী করেন যে, ফিফা সাফ জানিয়ে দেয় যে কোনো দলই বিশ্বকাপে খালি পায়ে খেলতে পারবে না। কিন্তু, ভারত গোঁয়ার্তুমি করে খালি পায়ে খেলার সিদ্ধান্তে অটল থাকে, তাই বিশ্বকাপে খেলা হয়নি তাঁদের।

কিন্তু, আসল সত্যটা অন্যরকম। এআইএফএফ, মানে ভারতীয় ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিজে থেকেই না খেলার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তের পেছনে অনেক রকম কারণ ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হল, ভারত তখন বিশ্বকাপের গুরুত্বই বুঝে উঠতে পারেনি। কারণ, তখনও তাঁরা অলিম্পিককেই সবচেয়ে বড় আসর বলে ভেবেছে। আর প্রায় এক মাস সময় নিয়ে জাহাজে করে প্রায় অর্ধেক পৃথিবী ভ্রমণ করে বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়াটা তাঁদের কাছে অর্থহীন বলে মনে হয়েছে।

ওই সময় আসলে অনেক দেশই বিশ্বকাপের গুরুত্ব বুঝতো না। যেমন, সেবারই আমন্ত্রন পেয়েও স্রেফ খরচের ভয়ে বিশ্বকাপে যায়নি তুরস্ক। এমনকি স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল ও ফ্রান্সের মত ইউরোপিয়ান দলগুলোও বিশ্বকাপ মিস করে।

১৯৬০ সালের অলিম্পিকে যাওয়া ভারতীয় ফুটবল দল।

ভারতীয় খেলোয়াড়রারও বিশ্বকাপের মর্ম  বুঝলে হয়তো নিজেরাই একটা ব্যবস্থা নিতেন। আর ওই সময় হকি দলের সাথে তাঁদের একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা ছিল। হকি দল অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জিতে যাওয়ায়, ফুটবল দলেরও সকল নজর ছিল সেদিকেই।

ভারতীয় দলের তৎকালীন ভারতীয় দলের অধিনায়ক শৈলেন মান্না বলেন, ‘আমাদের বিশ্বকাপ নিয়ে কোনো ধারণা ছিল না। যদি থাকতো তাহলে আমরা নিজেরাই উদ্যোগ নিতাম যাওয়ার জন্য। সে সময় আমাদের জন্য অলিম্পিকই ছিল সবকিছু। কোনো কিছুই অলিম্পিক থেকে বড় ছিল না।’

এআইএফএফ-এর ‘না’ বলার পেছনে আরেকটি কারণ হল খেলোয়াড়দের ফিটনেসের ঘাটতি। খেলোয়াড়রা তখ ৯০ মিনিটের ফুটবলে অভ্যস্তই ছিল না। ঘরোয়া লিগেও খেলতো ৭০ মিনিট করে। নিজেদের বানানো এই ভুতুড়ে নিয়ম ৭০-এর দশক অবধি বহাল রাখে এআইএফএফ।

আইএএফএফ বড় দলগুলোর সামনে পড়ে শুধু শুধু লজ্জার ভাগীদার হতে চাচ্ছিল না। আর ১৯৫১ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত হয় এশিয়ান গেমস। ভারতের সকল নজর ছিল সেদিকে। ভারতের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছিল ব্রাজিল, একদম শেষ মুহূর্তে গিয়ে না করে দেয় এআইএফএফ। ‘দল নির্বাচনে মতৈক্যের অভাব এবং অনুশীলন করার যথেষ্ট সময় নেই’ জানিয়ে ব্রাজিল ও ফিফাকে নিরাশ করে এআইএফএফ।

ওই সময় ভারত ফিফা ও অলিম্পিকের নিয়ম বুঝতেও ভুল করে। ভারত মনে করেছিল, বিশ্বকাপ খেললে আর কখনও অলিম্পিকে অংশ নেওয়া যাবে না। কারণ, অলিম্পিকে ওই আমলে অপেশাদার দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হত। ভারত ভেবেছিল, বিশ্বকাপ খেললে তাদের পেশাদার দল বলে বিবেচনা করা হতে পারে। তবে, এই নিয়ম তখন ইংল্যান্ড, স্পেন, ইতালি, ব্রাজিলের মত যেসব দেশে পেশাদার লিগ প্রথা ছিল,  সেসব দেশের জন্য ছিল।

১৯৬২ সালে জাকার্তায় এশিয়ান গেমসে যাওয়ার সময় ভারতীয় ফুটবল দল। সেবার চ্যাম্পিয়ন হয় ভারত। অনেকে এই ছবিটাকে ১৯৫০ সালের বলেও দাবী করেন, তবে সেই দাবী বানোয়াট।

বিশেষ করে স্যোশালিস্ট ব্লকের জন্য এই নিয়ম ছিল না।  ফেরেঙ্ক পুসকাস, জোসেফ বোজিক, ন্যান্দোর হাইডেগকুটি (হাঙ্গেরি), লেভ ইয়াশিন, ইগোর নেতোর (সোভিয়েত ইউনিয়ন) মত তারকারা সেই আমলে অলিম্পিক ও বিশ্বকাপ – দু’টোই খেলেছেন।

বিশ্বকাপটা চাইলে ভারত খেলতেই পারত। অনুশীলনের জন্য এক বছরের মত সময় হাতে ছিল। আর, ওই সময়ে মাইশোর ও হায়দরাবাদ ভিত্তিক খেলোয়াড়রা বুট পায়েই খেলতেন। ওই সময়ে ভারতীয় দলে খেলা আহমেদ খান, এম.এ সাত্তার, এস. রামান ও শৈলেন মান্নারা বুট পায়ে স্বাচ্ছন্দেই খেলতে। ফলে, বুটের জন্য বিশ্বকাপ খেলতে না পারার গল্পটা মিথ ছাড়া কিছুই নয়।

ভারত অবশ্য নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছিল। ততক্ষণে অবশ্য বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গিয়েছে। ১৯৫৪ এআইএফএফ নিজে থেকেই  ফিফার কাছে বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ যায়। কিন্তু, ফিফা চার বছর আগের অপমানের কথা ভুলে যায়নি। এবার তারাই ভারতের আবেদন বাতিল করে দেয়।

ফিফার ক্ষোভ এতটাই ছিল যে, দীর্ঘকাল এআইএফএফ-এর সাথে তাঁরা বিমাতাসুলভ আচরণ করে। বরফ গলে ৮০’র দশকে এসে। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব খেলে। ১৯৮৫ সালের মার্চ এপ্রিলের সেই বাছাই পর্বে ভারতের গ্রুপে ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড বাদে তৃতীয় দলটি ছিল বাংলাদেশ।

ওই সময় থেকে প্রতিটি বিশ্বকাপেরই বাছাই পর্ব খেলেছে ভারত। ২০১৭ সালে তো অনূর্ধ্ব- ১৭ বিশ্বকাপ ফুটবলের মূল পর্বই অনুষ্ঠিত হয় ভারতে। সেদিন হয়ত খুব দূরে নয়, যেদিন সত্যিই বিশ্বকাপ খেলবে ভারত।

১৯৫৬ সালের অলিম্পিকে চতুর্থ স্থান পাওয়া ভারতীয় দল। এটাই দেশটির ফুটবল ইতিহাসের সেরা সাফল্য।

তবে, ১৯৫০ সালে বিশ্বকাপটা খেলে ফেললে হয়ত আজকের চেহারাটা আরও অনেক ভাল হত। শৈলেন মান্না যেমন আক্ষেপ করে বললেন, ‘ওই সময় একবার বিশ্বকাপের যাত্রাটা শুরু হয়ে গেলে ভারতীয় ফুটবল আজ অন্য অবস্থানে থাকতো!’

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link