বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে যে কজন হাতে গোণা লোক সত্যিকার অর্থেই কাজ করেন এবং বছরের পর বছর দিন-রাত কাজ করে আসছেন, খাঁটি বাংলায় বললে, কলুর বলদের মতো খাটুনি খেটে আসছেন, তাঁদের একজন সাব্বির খান। অথচ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে, বিশ্বকাপে দলের ব্যর্থতার কারণে তার বিরুদ্ধে নাকি লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে এবং তাকে নাকি পদত্যাগ করতে বলা হয়েছে।
মজার ব্যাপার হলো, বিশ্বকাপে তিনি টিম ম্যানেজার ছিলেন না। তিনি ছিলেন টিম অপারেশন্স ও লজিস্টিকস ম্যানেজার। পারফরম্যান্স সংক্রান্ত কোনো কিছুর সঙ্গে তাঁর সরাসরি সম্পর্কই নাই।
সাব্বির খান ১৯৯৮ অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অধিনায়ক। সাবেক অফ স্পিনিং অলরাউন্ডার। দারুণ প্রতিভাবান ক্রিকেটার ছিলেন, ওই সময়ের নানা বাস্তবতায় পারেননি বড় ক্রিকেটার হতে। বোর্ডে কাজ করছেন অনেক বছর ধরেই। তাঁর মূল দায়িত্ব, বিসিবির ক্রিকেট অপারেশন্স বিভাগের ম্যানেজার। বোর্ডের খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই বিভাগ বলা যায় তার ওপর নির্ভর করে ছিল বছরের পর বছর ধরে।
এবং সাকিব আল হাসান কেন, কোনো ক্রিকেটারই তাঁকে নিয়ে কোনো অভিযোগ করেননি। বোর্ডের কেউ এটা বলেননি, বলার প্রশ্নই আসে না। ক্রিকেটারদের সবার সঙ্গে সাব্বির খানের শুধু দাপ্তরিক সম্পর্ক নয়, ব্যক্তিগত সম্পর্কই অনেক গভীর। ক্রিকেটারদের কাজ ক্রিকেট খেলা, অফিসিয়াল নানা প্রসিডিউর তাদের জন্য ঝামেলার। সাকিবসহ সব ক্রিকেটারের এসব কাজ সাব্বির খানই করেন এবং অনেকের অনেক ব্যক্তিগত সহায়তাও করেন। যতদূর জানতে পারলাম, অভিযোগ জানানোর কথা শুনে সাকিব নিজেই আকাশ থেকে পড়েছেন।
বিশ্বকাপের আগেই চাকরি ছাড়ার কথা সাব্বির খান মৌখিকভাবে জানিয়ে গেছেন বোর্ডে। কারণ, বছরের পর বছর বোর্ডের লোড নিতে নিতে তিনি মানসিকভাবে ক্লান্ত ও শ্রান্ত। বোর্ডের কাজে তিনি যেভাবে ল্যাপটপ নিয়ে দিন-রাত একাকার করে গেছেন, এই ক্লান্তি স্বাভাবিক। তবে এটিই সম্ভবত আসল কারণ নয়।
তিনি একদমই নির্বিরোধী মানুষ। নিজের মতো মাথা গুঁজে কাজ করে গেছেন। কখনও সামনে আসতে চাননি, ইন্টারভিউ দেননি শত অনুরোধেও, এমনকি সিম্পল একটা লাইনও তার পেটে বোমা মেরে বের করা যায়নি। আজকের আগে, আপনার কজন জানতেন তার নাম বা ভূমিকা? আড়াল থেকে নিজের কাজ তো করে গেছেন তো বটেই, অন্য আরও অনেক কাজও করেছেন বোর্ডের ও দলের। বোর্ড ও দলের নানা প্রয়োজনে তিনি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন ফেলে কাজ করে গেছেন।
যারা খুব ভালো কাজ করেন, বাংলাদেশে তাঁদের শত্রুর অভাব হয় না। তিনি সম্ভবত সেসব আর নিতে পারছিলেন না। বিশ্বকাপ থেকে ফিরে তিনি কদিন আগেই পদত্যাগপত্র দিয়েছেন। এখন এক মাসের নোটিশ পিরিয়ড চলছে। বোর্ড থেকে তখন তাকে অনুরোধও করা হয়েছে থাকতে। তিনি রাজি হননি। এবং আমার ব্যক্তিগতভাবে ধারণা, তিনি আরও বড় কোনো জায়গা থেকে ভালো প্রস্তাব পেয়েছেন। সেই যোগ্যতা ও দক্ষতা তাঁর আছে।
যাই হোক, সেসব অন্য কথা। এখানে মূল কথা, বিভিন্ন সিরিজ-টুর্নামেন্টে আগে নানা সময়ে টুকটাক ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করলেও বেশির ভাগ সময়ই তিনি ছিলেন অপারেশন্স ও লজিস্টিকস ম্যানেজার এবং এই বিশ্বকাপেও সেটিই। তার যে দায়িত্ব ছিল, সেটির সঙ্গে মাঠের পারফরম্যান্সের সরাসরি সম্পকই নেই এবং কোনো ক্রিকেটার তার নামে অভিযোগ করেনি। লিখিত তো নয়ই।
সম্ভবত, বোর্ডের ভেতরের কেউ কেউ এই খবরটা ছড়িয়ে তাকে সামাজিকভাবে হেয় করার চেষ্টা করছে। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে দিতে চাচ্ছে। এত বছর ধরে ভালো কাজ করার পুরস্কার!
অকর্মাদের দলে করিৎকর্মা লোকের শত্রুর অভাব হয় না। বিশ্বকাপে দলের ব্যর্থতায় শাক দিয়ে নানা মাছ ঢাকার চেষ্টা চলছে। ক্ষতে সাময়িক মলম লাগানোর প্রক্রিয়া চলছে। উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর প্রক্রিয়া চলছে। সাব্বির যেহেতু চলেই যাচ্ছে, তাকেও নাহয় কিছু দায় চাপিয়ে পাবলিকের নজর ঘুরিয়ে দেওয়া গেল, পাবলিক চায় ও খায় সেনসেশনাল কিছু। সাব্বিরদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে বড় বড় কর্তাদের ব্যর্থতা আড়াল করা সহজ হয়।
এই সাব্বির খান আমার ওপর কতদিন যে রাগ করেছেন! কারণ, আমি বোর্ড প্রধান, বোর্ড কর্তাদের এবং বোর্ডের কঠোর সমালোচনা করি। তিনি সিরিয়াস রাগ করতেন। আমি অবাক হয়ে বলতাম, ‘আপনাকে নিয়ে তো লিখিনি, বিসিবিকে নিয়ে লিখেছি। যাদের দায়, তাদের কথা লিখেছি।’ উনি তার পরও রাগ করতেন। কারণ বিসিবিকে তিনি ‘ওউন’ করতেন। তিনি যেহেতু দিন-রাত খাটতেন, বিসিবিকে নিয়ে খারাপ কিছু বললে তার গায়ে লাগত। আজ তার প্রতিদানও পেলেন। সেই বোর্ডের কিছু লোক উড়ো খবর ছড়িয়ে তাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চাইল।
এটাই বিসিবি। এটাই বাংলাদেশ ক্রিকেট। এখানে ভালো কাজ করলে বঞ্চনা ও তিরস্কার মেলে, ভালো কাজের ভান ধরলে মেলে পুরস্কার।
– ফেসবুক থেকে