লালমোহন বাবু থাকলে না হয় টস নিয়ে একটি টসটসে লেখা এত দিনে লিখে ফেলতেন। সে যাই হোক এই টস জেতা এবং হারা, এটা কি এই প্রথম বার এত বেশি করে প্রভাব ফেলল? সত্যি কি টস দায়ী? কয়েন এর উল্টো দিক কি বলছে?
ক্রিকেটের সঙ্গে ফুটবল বা এই জাতীয় খেলাগুলোর সঙ্গে একটা বিরাট পার্থক্য হলো ক্রিকেট বাহ্যিক পরিস্থিতির উপর অনেকটা নির্ভরশীল। আর সেই কারণেই টসের এত গুরুত্ব।
তবে এটাও ঠিক টস এর উপরে রয়েছে স্কিল, যেটাকে আপনি অস্বীকার করতে পারেন না। আর দিনের শেষে মনে হয় সেটাই শেষ কথা বলে। চলুন একটু পিছনে যাওয়া যাক। ভারতে দিন রাতের ক্রিকেট শুরু হয় নয়ের দশকের শুরু থেকে। আর তখন বছরের এই সময়টায় একটা করে বহুদলীয় প্রতিযোগিতা ভারতে হতো। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে এরকম তিনটে ম্যাচ। ’৯৩ এর হিরো কাপ ফাইনাল, ’৯৪ এর উইলস কাপ ফাইনাল, ’৯৬ এর টাইটান কাপ ফাইনাল। তিনটে ম্যাচই হয়েছে মাঝ নভেম্বরে এবং তিনটে ম্যাচেই পরে বল করা দল জিতেছে, স্পিনারের দাপটে।
কি জানি সেই সময়ে হয়তো নভেম্বর মাসে ভারতে শিশির পড়তো না। হিরো কাপ ফাইনালের কথাই ধরা যাক। একজন পেসার এর বোলিং ফিগার ১০-৩-১৮-২ আর একজন স্পিনারের ৬.১-২-১২-৬। শিশির বাধা হতে পারেনি স্কিল এর সামনে। আর হ্যাঁ এই ম্যাচ গুলো ৫০ ওভারের ছিল। শিশিরের প্রভাব আরও বেশি হওয়া উচিত ছিল, কুড়ি ওভারের তুলনায়। তখন বল ব্যবহারেরও ভিন্ন নিয়ম ছিল। বিভিন্ন জায়গায় এবারের বিশ্বকাপ চলাকালীন দেখলাম লাহোরের ফাইনালের উদাহরণ উঠে এল।
অর্জুনা রানাতুঙ্গা দু দিন ধরে সন্ধ্যে বেলা মাঠের ধরে চক্কর মেরেছিলেন। ভাল কথা। ওই বিশ্বকাপও তো ফেব্রুয়ারি তে শুরু হয়েছিল। শিশিরের মধ্যেও দিনরাতের ম্যাচে পরে ব্যাট করা দল হারেনি? মুম্বইতে ভারত, ব্যাঙ্গালোরে পাকিস্তান, মোহালিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ব্যাঙ্গালোরে কুম্বলের তিন উইকেট আর মোহালিতে ওয়ার্ন এর চার। স্কিল। আরও আছে। কি জানি তখন বোধহয় শিশির পড়ত না। শুধু লাহোরের ফাইনালেই শিশির পড়ার সম্ভাবনা ছিল! লাহোর আর মোহালির মধ্যে দূরত্ব কিন্তু খুব বেশি না।
এবার একটু অন্য কথা বলি। মুত্তিয়া মুরালিধরন সেরা ফর্মে থাকাকালীন দিনের পর দিন শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত যেকোন প্রতিযোগিতার ফাইনাল হতো প্রেমদাসা স্টেডিয়ামে, দিনরাতের ম্যাচ। আর শ্রীলঙ্কার লক্ষ্যই থাকতো টসে জিতে ভদ্রস্থ রান করে পরে স্লো এবং টার্নিং উইকেটে মুরালি, জয়াসুরিয়া, ডি সিলভার সামনে বিপক্ষকে ফেলে দেওয়া।
ভারত দেশের মাঠে চেষ্টা করেনি দিনের পর দিন টেস্ট ম্যাচে টস জিতে ব্যাটিং নিয়ে দু দিন ধরে ব্যাট করে তারপর স্পিনিং উইকেটে বিপক্ষকে দুবার আউট করে ম্যাচ জিততে? কিংবা এই ভারতই যখন ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড গেছে টেস্ট খেলতে, বিপক্ষ সবসময় চেষ্টা করেছে গ্রীন টপ বানিয়ে টসে জিতে ভারত কে ব্যাট করতে পাঠাতে। এরকম অনেকক্ষেত্রেই টস গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছে বা আজও করছে।
তাহলে হঠাৎ করে একটা নির্দিষ্ট প্রতিযোগিতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো কেন? দুনিয়ার কোন দল টসের মাধ্যমে হোম এডভেন্টেজ নেওয়ার চেষ্টা করেনি? হ্যাঁ, টস এবারে এখানে অবশ্যই একটা বড় ভূমিকা নিয়েছে কিন্তু সেটাই সব নয়। যারা স্কিলের যথাযথ ব্যবহার করতে পেরেছে তারা জিতেছে আর যারা পারেনি তারা হেরেছে।
এই সাধারণ বিষয়টিকে অযথা জটিল করার চেষ্টা করা হচ্ছে হয়তো কোন বিশেষ কারণে। সেদিন সেমিফাইনালে হাসান আলী যদি ক্যাচটা ধরে ফেলতো, এত সহজ হতো কথা গুলো বলা? এই তত্ত্বকে দাঁড় করানো? ওখানে টস বা শিশির জেতেনি, হেরেছে ক্রিকেটীয় দক্ষতা।
আর দিনরাতের বা সন্ধ্যের টি-টোয়েন্টি ম্যাচকে দুপুর বা বিকেলে নিয়ে আসা বাস্তবের আঙিনায় দাঁড়িয়ে সত্যি সম্ভব? ব্যবসা চলবে? ব্রডকাস্টিং কোম্পানিগুলো মানবে? ১৯৯২ বিশ্বকাপের দক্ষিণ আফ্রিকা দলের কাছে বোধহয় এর উত্তর আছে।
বরং আমরা এটা ভাবছি না যে হয়তো আমাদের অজান্তে এই বিশ্বকাপের মাধ্যমে টি২০র জন্য একটা অদৃশ্য টেমপ্লেট সেট হয়ে গেল। বিপক্ষকে আগে ব্যাট করতে পাঠিয়ে টার্গেট সামনে রেখে সেটার পেছেনে পরিকল্পনা করে তাড়া করা। এতে প্রথমে ব্যাট করে যত বেশি সম্ভব রান করার প্রচেষ্টায় অহেতুক ঝুঁকি নেওয়ার সম্ভবনাটা নেই। ‘Dew’ নিয়ে আলোচনাটা ‘due’ রেখে এটা নিয়েও তো একটু ভাবে যেতে পারে।