ঠাণ্ডা মাথার নীরব ঘাতক

যদি প্রশ্ন করা হয়, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাসে দ্রুততম ফাস্ট বোলার কে ছিলেন? উত্তরে সবার আগে যার নামটা আসা উচিত তিনি হলেন অ্যান্ডি রবার্টস। সত্তর ও আশির দশকে ক্রিকেট দুনিয়ায় একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারকারী ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিখ্যাত পেস আক্রমণের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন যিনি।

অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েডের গড়া বিখ্যাত ‘পেস কোয়ার্টেটের’ অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন এই অ্যান্ডি রবার্টস। বহুল আলোচিত সেই ‘পেস চতুষ্টয়ের’ বাকি সদস্যরা হলেন মাইকেল হোল্ডিং, জোয়েল গার্নার এবং কলিন ক্রফট। এঁদের সবার মূলমন্ত্র ছিল একটাই – গতি, গতি এবং গতি!

‘৭০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটে আধুনিক ফাস্ট বোলিংয়ের এক বৈপ্লবিক ধারার সূচনা হয়েছিল। যার নেতৃত্বে ছিলেন অ্যান্ডি রবার্টস। সৌভাগ্যবশত সে সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফাস্ট বোলিং ডিপার্টমেন্টে প্রতিভার কোন অভাব ছিল না। হোল্ডিং, গার্নার, ক্রফটরা তো ছিলেনই; আরও ছিলেন ওয়েইন ড্যানিয়েল, ম্যালকম মার্শাল, কার্টলি অ্যাম্ব্রোস, ইয়ান বিশপ, কোর্টনি ওয়ালশ, কেনি বেঞ্জামিন, প্যাট্রিক প্যাটারসনের মত উঠতি প্রতিভাবানরাও।

ছয় ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার দীর্ঘদেহী এই ফাস্ট বোলারের কাঁধ দুটো ছিল বেশ প্রশস্ত ও শক্তিশালী যা তাকে জোরে বল করতে সাহায্য করত। জেনুইন ফাস্ট বোলারদের ক্ষেত্রে এই কাঁধের ব্যবহারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ছন্দবদ্ধ রানআপ, ‘কুইক থ্রু দ্য এয়ার’ রিলিজ এবং স্ট্রেইট লো আর্ম অ্যাকশনে প্রচণ্ড গতিতে বল করতেন তিনি।

টিপিক্যাল ফাস্ট বোলারদের মত রবার্টসের আর্মারিতেও প্রধান অস্ত্র হিসেবে ছিল পেস, বাউন্স ও অ্যাকুরেসি। জোরের ওপর করা গুড লেংথ ডেলিভারির সাথে শার্প বাউন্স মিশিয়ে ব্যাটসম্যানদের তীব্র অস্বস্তিতে ফেলতে পারতেন তিনি। ড্রাইভিং লেংথ থেকে সাপের ফণার মত বল ওঠাতে পারতেন বলে তাকে ড্রাইভ করাটা ছিল রীতিমত দুঃসাধ্য।

ডানহাতি ফাস্ট বোলার রবার্টস ছিলেন মূলত ইনসুইং বোলার। ন্যাচারাল মুভমেন্ট হত অফ থেকে লেগের দিকে। তবে মাঝেমধ্যেই দুর্দান্ত আউটসুইঙ্গার দিয়ে ব্যাটসম্যানদের বোকা বানাতেন তিনি।

রবার্টসের স্টক ডেলিভারি ছিল বাউন্সার। সেই বাউন্সারের আবার দু’রকম ভ্যারিয়েশন ছিল। একটা ছিল স্লোয়ার বাউন্সার, আরেকটা স্কিডি বাউন্সার। ‘স্লোয়ার’ বাউন্সারগুলো ব্যাটসম্যানকে হুক শট খেলতে প্রলুব্ধ করত। যেগুলো আপাতদৃষ্টিতে সামলানো সহজ মনে হলেও ব্যাটসম্যানকে ট্র্যাপে ফেলতে ছিল অত্যন্ত কার্যকরী।

অন্যদিকে, ‘স্কিডি’ বাউন্সারগুলো ব্যাটসম্যানের জন্য ছিল যেন একেকটা প্রাণঘাতী মারণাস্ত্র! যেগুলো সরাসরি গিয়ে আঘাত হানত ব্যাটসম্যানের পাঁজরে, গলায় কিংবা মাথায়। মারাত্মক গতি, এক্সট্রা বাউন্সের সাথে ঘটনার আকস্মিকতা মিলিয়ে ব্যাটসম্যানের জন্য সেগুলো হয়ে উঠত আনপ্লেয়েবল! ক্যারিবীয় সমর্থকরা বিপজ্জনক এই ডেলিভারির নাম দিয়েছিল ‘থ্রোট কাটার’! অনেকে বলতেন ‘রিব ব্রেকার’।

ক্রিকেট ইতিহাসের ভয়ংকরতম ডেলিভারিগুলোর একটা মনে করা হয় রবার্টসের এই ‘স্কিডি বাউন্সার’কে। বেশিরভাগ ব্যাটসম্যান যারা আউট হয়েই বরং বেঁচে যেতেন! আর আউট না হওয়াদের সহ্য করতে হত শরীরে আঘাতের নিদারুণ যন্ত্রণা! ক্যারিয়ার জুড়ে বলের আঘাতে কত জনের যে চোয়াল রক্তাক্ত করেছেন, দাঁত ভেঙেছেন, নাক ফাটিয়ে দিয়েছেন কিংবা পাঁজরের হাড় গুঁড়িয়ে দিয়েছেন, তার কোন হিসেব নেই!

ব্যাটসম্যানকে সেটাপ করতে ইচ্ছেমত পেস ভ্যারিয়েশন অর্থাৎ গতি কমাতে বা বাড়াতে পারতেন রবার্টস। একই জায়গায় বল ফেলে দুই রকম বাউন্সার দিতে পারার ক্ষমতাটা সেই সামর্থ্যেরই জলজ্যান্ত প্রমাণ।

একটা প্রশ্ন মনের ভেতর উঁকি দিতেই পারে, হাউ ফাস্ট ওয়াজ হি? সে প্রসঙ্গে বলব, রবার্টসের বলে গর্ডন গ্রিনিজ যখন স্লিপে দাঁড়াতেন, তিনি সব সময় একটা বাড়তি ‘প্রটেক্টিভ গার্ড’ ব্যবহার করতেন!

অ্যান্ডি রবার্টস তাঁর ক্যারিয়ারের দ্রুততম ডেলিভারিটি করেছিলেন ১৯৭৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে, পার্থের ওয়াকায়। বলটির গতি ছিল ঘন্টায় ১৫৯.৫ কিমি।

পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও কিংবদন্তী অলরাউন্ডার ইমরান খান একবার বলেছিলেন, তাঁর দেখা সবচেয়ে বিপজ্জনক ও ভয়ংকরতম ফাস্ট বোলারের নাম অ্যান্ডি রবার্টস।

টেস্ট ক্যারিয়ারে ‘প্রতিটি’ ম্যাচেই তিনি হাতে তুলে নিয়েছেন নতুন বল। মাত্র ৭ ম্যাচ বাদে বাকি সবকটি ম্যাচে প্রথম ওভারটাও করেছেন তিনিই। তাঁর উদ্বোধনী বোলিংয়ে পার্টনার ছিলেন মাইকেল হোল্ডিং। যাকে সবাই ‘হুইসপারিং ডেথ’ নামে ডাকত। অপরপ্রান্তে রবার্টসকে বলা যেতে পারে ‘ঠান্ডা মাথার খুনি’ কিংবা ‘নীরব ঘাতক’।

অ্যান্ডি রবার্টসের মধ্যে একটা লক্ষণীয় ব্যাপার ছিল যে, তিনি ছিলেন ভীষণ রকমের ‘এক্সপ্রেশনলেস’। খেলার মাঠে কখনই তিনি আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেন না। এমনকি তাঁকে কোনদিন স্লেজিং করতেও দেখা যায়নি! উইকেট লাভের পর কিংবা ব্যাটসম্যান আহত/আঘাতপ্রাপ্ত হলেও তার চোখেমুখে অভিব্যক্তির লেশমাত্র ফুটে উঠত না।

১৯৭৪ সালে বারবাডোজের ব্রিজটাউনে ইংলিশদের বিপক্ষে অ্যান্ডি রবার্টসের টেস্ট অভিষেক, মাত্র ২৩ বছর বয়সে। নয় বছরের ক্যারিয়ারে তিনি টেস্ট খেলেছেন ৪৭টি। ২৫.৬ গড়ে উইকেট নিয়েছেন ২০২টি। ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন ১১ বার আর ম্যাচে ১০ উইকেট পেয়েছেন ২ বার। ক্যারিয়ার সেরা বোলিং ফিগার ৭/৫৪।

টেস্টের পাশাপাশি ওয়ানডে খেলেছেন ৫৬টা। মাত্র ২০.৩৫ গড়ে তাঁর শিকার ৮৭ উইকেট। সেরা বোলিং ৫/২২। এছাড়া প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ২১ গড়ে ৮৮৯টি উইকেট আছে তাঁর। ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলেছেন লিওয়ার্ড আইল্যান্ডস, হ্যাম্পশায়ার, লেস্টারশায়ার ও নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে।

সাবেক এই ডানহাতি ফাস্ট বোলার তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা কাটিয়েছেন কাউন্টি দল হ্যাম্পশায়ারের হয়ে। সে সময় কাউন্টি ক্রিকেটের উইকেটগুলো ছিল বেশ নিচু ও মন্থরগতির। আর বেশিরভাগ দলেই খেলতেন বিশ্বের বাঘা বাঘা সব ব্যাটসম্যান। তবে রবার্টসের মত দ্রুতগতির ফাস্ট বোলার কাউন্টিতে আর একজনও ছিলেন না।

১৯৭৪ সালের গ্রীষ্মকালটা ছিল তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনের স্বর্ণালি অধ্যায়। হ্যাম্পশায়ারের হয়ে সে বছর কাউন্টিতে রবার্টসের শিকার ছিল ১১৯ উইকেট! গড় মাত্র ১৩.৬২!

১৯৭৪-৭৫ মৌসুমে ভারত সফরে ইনসুইঙ্গার আর বাউন্সার দিয়ে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের রীতিমত নাকাল করে ছেড়েছিলেন রবার্টস। সত্যিকারের ফাস্ট বোলিং কী জিনিস সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল স্বাগতিকরা। সাবকন্টিনেন্টের অসহনীয় গরম ফাস্ট বোলিংয়ের জন্য মোটেই অনুকূল নয়। তবে রবার্টস ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। ভারতের স্লো লো স্পিন সহায়ক ট্র‍্যাকেও ছিলেন দারুণ সফল। ৪ ম্যাচের সিরিজে মাত্র ১৮.২৭ গড়ে নিয়েছিলেন ৩২ উইকেট।

রবার্টস ছিলেন ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বাধীন ‘৭৫ ও ‘৭৯ বিশ্বকাপজয়ী দলের একজন গর্বিত সদস্য। ১৯৭৫ সালের বিশ্বকাপে ৫ ম্যাচ খেলে রবার্টসের শিকার ছিল ৮ উইকেট। ইকোনমি রেট ছিল ৩ এরও নিচে!

তবে ‘৭৫ বিশ্বকাপটা তাঁর কাছে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে অন্য একটা কারণে। গ্রুপ পর্বের মহাগুরুত্বপূর্ণ এক ম্যাচে ব্যাট হাতে অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শনের জন্য। বার্মিংহামে পাকিস্তানের বিপক্ষে বাঁচা মরার সেই লড়াইয়ে রান তাড়া করতে নেমে শেষ উইকেট জুটিতে উইকেট রক্ষক ডেরেক মারেকে (৬১*) দারুণ সঙ্গ দিয়েছিলেন রবার্টস (২৪*)। অবিচ্ছিন্ন দশম উইকেট জুটিতে দুজনে মিলে যোগ করেছিলেন ৬৪ রান। মাত্র ১ উইকেটের অবিশ্বাস্য এক জয় তুলে নিয়েছিল ক্যারিবিয়ানরা। জয়সূচক রানটাও এসেছিল রবার্টসের ব্যাট থেকে।

১৯৭৫-৭৬ মৌসুমে টেস্ট সিরিজ খেলতে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তবে সফরকারীদের জন্য সিরিজটা ছিল দুঃস্বপ্নের মত। জেফ টমসন আর ডেনিস লিলির গতির সামনে দাঁড়াতেই পারছিল না তরুণ অনভিজ্ঞ কিন্তু প্রতিভাবান ক্যারিবিয়ান ব্যাটিং লাইন আপ। ছয়টা ম্যাচের মধ্যে পাঁচটাই হেরে বসে তারা। একমাত্র যে ম্যাচটি তারা জিততে পেরেছিল সেটাও সম্ভব হয়েছিল কেবল অ্যান্ডি রবার্টসের অনবদ্য পারফরম্যান্সের সৌজন্যে। পার্থ টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে একাই ৭ উইকেট তুলে নিয়ে দলকে এনে দিয়েছিলেন সান্ত্বনাসূচক এক জয়। সিরিজ শেষে রবার্টসের অর্জন ছিল ২৬ গড়ে ২৪ উইকেট।

১৯৭৫ সালের ওই লজ্জাজনক সিরিজ হারের পরই মূলত অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড গড়ে তোলেন বিখ্যাত সেই ‘পেস কোয়ার্টেট’। যার অগ্রসেনানী ছিলেন ‘অভিজ্ঞ’ রবার্টস। ১৯৭৬ সালের ইংল্যান্ড সফরটাও দারুণ কেটেছিল রবার্টসের। মাত্র ২০ গড়ে নিয়েছিলেন ২৮ উইকেট।

লর্ডসের ফ্লাট ট্র‍্যাকে দুই ইনিংসেই নিয়েছিলেন পাঁচটি করে উইকেট। ম্যাচে শিকার ১০ উইকেট। ওল্ড ট্র‍্যাফোর্ডের সিমিং উইকেটেও দুই ইনিংস মিলিয়ে নেন ৯ উইকেট। সেই ম্যাচেই পরপর দুই বলে অ্যালান নট আর ডেরেক আন্ডারউডকে ফিরিয়ে দেবার পরের বলেই পেয়ে যেতে পারতেন কাঙ্ক্ষিত হ্যাটট্রিকটাও। কিন্তু বিধি বাম! ফার্স্ট স্লিপে ইংলিশ ব্যাটসম্যান মাইক শেলভির ক্যাচটা ফেলে দেন গ্রিনিজ!

হেডিংলিতে পরের টেস্টে ক্যারিয়ারের অন্যতম বিধ্বংসী স্পেলটি করেছিলেন তিনি। মাত্র কয়েক বলের ব্যবধানে তিনি তুলে নিয়েছিলেন ডেভিড স্টিল, ফ্রাংক হায়েস ও ক্রিস বল্ডারস্টোনের উইকেট। ওই স্পেলেই তিনি পেতে পারতেন পিটার উইলির উইকেটটিও। কিন্তু রবার্টসের লেগ বিফোরের জোরালো আবেদন নাকচ করে দেন আম্পায়ার।

হেডিংলি টেস্টটা ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের ১৯ তম টেস্ট। ওই ম্যাচেই তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাসে দ্রুততম বোলার (বিশ্বে চতুর্থ) হিসেবে টেস্টে ১০০ উইকেটের মাইল ফলক অর্জন করেন। যে রেকর্ডটি আজ পর্যন্ত কেউ ভাঙতে পারে নি।

ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা সময়টাতে দুটো বছর তাঁকে খেলতে হয়েছে ক্যারি প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজে। রবার্টস সেখানে দুর্দান্ত পারফর্ম করলেও তা ঢাকা পড়ে যায় আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির অভাবে।

ওয়ার্ল্ড সিরিজ পরবর্তী সময়ে রবার্টসের গতি কিছুটা কমে গেলেও কার্যকারিতা হারাননি মোটেও। বরং বয়সের সাথে তিনি হয়ে উঠেছেন আরও অভিজ্ঞ, আরও পরিণত, আরও নিখুঁত।

ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসেও দলকে তিনি উপহার দিয়েছেন বেশ কিছু স্মরণীয় মুহূর্ত। ১৯৮০ সালে ট্রেন্টব্রিজ টেস্টের দুই ইনিংসে রবার্টসের বোলিং ফিগার ছিল যথাক্রমে ৫/৭২ ও ৩/৫৭। আর ইংলিশদের দেয়া ২০৮ রানের টার্গেটে ১৮০ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যখন ধুঁকছিল, ঠিক তখনই দলকে বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন ‘ব্যাটসম্যান’রূপী রবার্টস। অপরাজিত ২২ রান করে দলকে জিতিয়ে তবেই মাঠ ছেড়েছিলেন তিনি।

১৯৮২-৮৩ মৌসুমে ভারতের বিপক্ষে হোম সিরিজে রবার্টসের শিকার ছিল ২২ গড়ে ২৪ উইকেট। কিংস্টনের স্যাবাইনা পার্কে একাই নিয়েছিলেন নয় উইকেট।

১৯৮৩ বিশ্বকাপেও তাঁর বেশ কিছু ভাল স্পেল ছিল। বিশেষ করে ফাইনালে তাঁর ৩২ রানে ৩ উইকেটের স্পেলটাই ম্যাচ উইনিং স্পেল হতে পারত, যদি না ১৮৪ রানের মামুলি টার্গেট তাড়া করতে নেমে মাত্র ১৪০ রানেই সবকটি উইকেট খুইয়ে না বসত ক্যারিবিয়ানরা!

১১৯ রানে ৭ উইকেট পড়ার পর আরও একবার ব্যাট হাতে নায়ক হবার সুযোগ এসেছিল রবার্টসের সামনে। কিন্তু ১২৪ রানের মাথায় এলবিডব্লিউয়ের ফাঁদে পড়ে প্যাভিলিয়নে ফিরতে হয়েছিল তাঁকে।

১৯৮৩ বিশ্বকাপের পর ভারত সফরটাই ছিল রবার্টসের শেষ আন্তর্জাতিক ট্যুর। যে সফরে ভারতকে টেস্টে ৩-০ এবং ওয়ানডেতে ৫-০ তে হোয়াইটওয়াশ করে ফাইনাল হারের ‘মধুর প্রতিশোধ’ নিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

ফিটনেস সমস্যার কারণে প্রথম চার টেস্টে মাঠেই নামতে পারেননি রবার্টস। অবশেষে সুযোগ আসে কলকাতার ইডেন গার্ডেনে সিরিজের পঞ্চম ম্যাচে। ১৯৭৫ সালে কলকাতার ইডেন গার্ডেনেই ইনিংসের প্রথম বলে তিনি তুলে নিয়েছিলেন ভারতীয় ওপেনার সুধীর নায়েকের উইকেট। এবারে একই মাঠে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটান তাঁরই সতীর্থ আরেক ‘গ্রেট’ ম্যালকম মার্শাল; ম্যাচের প্রথম বলেই সুনীল গাভাস্কারকে আউট করে। কলকাতা টেস্টে রবার্টস নেন ৫৬ রানে ৩ উইকেট।

ভারতের ২৪১ রানের জবাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সংগ্রহ যখন ২১৩/৮, ‘নাম্বার টেন’ হিসেবে ব্যাটিংয়ে নামেন রবার্টস। ম্যালকম মার্শালকে সাথে নিয়ে পাক্কা তিন ঘন্টা ৪০ মিনিট ক্রিজে থেকে নবম উইকেট জুটিতে যোগ করেন ১৬১ রান। পাঁচ চার ও তিন ছয়ে সেদিন রবার্টস খেলেছিলেন ৬৮ রানের ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস।

টেস্টে রবার্টসের ব্যাটিং পরিসংখ্যানের দিকে ভালভাবে খেয়াল করলে একটা ব্যাপার পরিষ্কার। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তিনি বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংয়েও রেখেছেন পরিণতি বোধের ছাপ। টেইলএন্ডার হলেও তাঁর ব্যাটের হাতটা যে মন্দ ছিল না তার প্রমাণ তিনি অসংখ্যবার দিয়েছেন।

প্রথম ২৭ টেস্টের পর তাঁর ব্যাটিং গড় ছিল মাত্র ৭.৩৮! অথচ পরবর্তী ২০ টেস্টে ৩ ফিফটিসহ সেটা ২৬.৬৫! ক্যারিয়ার গড়ও বেড়ে গিয়ে দাঁড়াল ১৫ তে!

মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত সিরিজের ষষ্ঠ ও শেষ টেস্টটা হয়ে রইল অ্যান্ডি রবার্টসেরও ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট। পরবর্তীতে আর একটি বারের জন্যও জাতীয় দলের জন্য বিবেচনা করা হয়নি তাঁকে।

১৯৮৩-৮৪ মৌসুমে ইংলিশ কাউন্টিতে বল হাতে দুর্দান্ত ফর্মে থাকলেও (২১ গড়ে ৫৪ উইকেট) উইন্ডিজ নির্বাচক প্যানেল তাঁকে উপেক্ষা করে।

খেলা ছাড়ার পর ১৯৯০ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হেড কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন কিছুদিন। ২০০১ সালে স্বল্প সময়ের জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি; বোলিং পরামর্শকের ভূমিকায়। যাবার আগে সম্ভাবনাময় দুই তরুণ মাশরাফি বিন মুর্তজা আর তালহা জুবায়েরকে দিয়ে গিয়েছিলেন জেনুইন ফাস্ট বোলারের সার্টিফিকেট। এরপর ২০০৫ সালে তিনি পুনরায় আসেন বাংলাদেশে। ফাস্ট বোলারদের নিয়ে বেশ কিছু কাজ করেছেন তখন। ২০০৬ সালে কিছু দিনের জন্য ভারতের বোলিং কোচের দায়িত্বও পালন করেন তিনি।

খেলোয়াড়ী জীবন থেকে অবসর নেয়ার পর থেকে দেশের ক্রিকেট উন্নয়নে তিনি নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন। ২০০৬ সালের জুলাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলের সিলেকশন কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে যোগদান করেন তিনি। অবশ্য ২০০৮ সালে রবার্টস সহ পুরো নির্বাচক কমিটিকেই বরখাস্ত ঘোষণা করে উইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড।

১৯৭৫ সালে উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটার হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৫ সালের অক্টোবরে ক্রিকেটে অসামান্য অবদানের জন্য দ্বিতীয় অ্যান্টিগান হিসেবে ইউনাইটেড স্টেটস ক্রিকেট হল অব ফেমের সদস্যপদ লাভ করেন। ২০০৭ সালে অ্যান্টিগা ও বারবুডা সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রীয় মর্যাদাসম্পন্ন ‘অর্ডার অব মেরিট’ উপাধিপ্রাপ্ত হন। ২০০৯ সালে আইসিসি ক্রিকেট হল অব ফেমের সদস্য মনোনীত হন। ২০১৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে তিনি সম্মানসূচক ‘নাইটহুড’ উপাধিতে ভূষিত হন।

১৯৫১ সালের ২৯ জানুয়ারি, অ্যান্টিগার আর্লিংস ভিলেজ নামক এলাকায় এক দরিদ্র জেলে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ক্যারিবীয় ক্রিকেটের স্বর্ণযুগের কান্ডারি, কিংবদন্তীতূল্য সাবেক এই ফাস্ট বোলার।

অ্যান্টিগায় জন্মগ্রহণকারী প্রথম টেস্ট ক্রিকেটার ছিলেন অ্যান্ডি রবার্টস। তাঁর দেখানো পথ অনুসরন করেই পরবর্তীতে ভিভ রিচার্ডস, রিচি রিচার্ডসন, এলডিন ব্যাপ্টিস্ট, কার্টলি অ্যামব্রোস, সিলভেস্টার জোসেফের মত জনপ্রিয় ক্রিকেটাররা এ অঞ্চল থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রেখেছেন দৃপ্ত পদচারণা।

Share via
Copy link