দ্য মেকিং অব শ্রেয়াস আইয়ার

‘আরে ব্যাটা কাল কিছু করে দেখা। দুই ম্যাচ ধরে মাঠের বাইরে থেকে আর কত তালি বাজাবি! মাঠে নাম, সবাই তোর জন্য তালি বাজাবে!’ – বক্তা কোচ প্রবীন আম্রে, যিনি সেই ১২ বছর বয়স থেকে জানেন শ্রোতা শ্রেয়াস আইয়ারকে। আইয়ারের বয়স তখন ১৯। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর, কানপুরের এই গ্রিনপার্কেরই ঘটনা।

৫৩ রানে নেই পাঁচ উইকেট। দলের বেহাল দশা শ্রেয়াস আইয়ার নামবেন ব্যাটিং-এ কিন্তু তিনি যে করেছেন এক বিশাল বড় ভুল। নিজের ক্রিকেট সরঞ্জামের ব্যাগ তিনি ফেলে এসেছেন টিম হোটেলেই। এমন পরিস্থিতিতে কোচের চোখ রাঙানি আর মাথায় পাহাড়সম চিন্তা নিয়ে সতীর্থের ব্যাটিং কিট নিয়ে মাঠে নামলেন আইয়ার। দল বিপদে, একটা ভুল তাছাড়া এর আগে কোচের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে দলের প্রয়োজনে ভাল কিছু করে দেখানো খুবই কষ্টসাধ্য এক বিষয়।

ঘটনাটা শ্রেয়াস আইয়ারের উত্থানের পেছনের এক ছোট্ট কিন্তু প্রচুর প্রভাবশালী ঘটনা। এই ঘটনার পরিক্রমায় আজ আইয়ারের অভিষেক হয়েছে ভারতের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে। ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে ৩০৩ নম্বর ক্রিকেটার তিনি। ভারতের রঞ্জি ট্রফির ২০১৪-১৫ মৌসুমে উত্তর প্রদেশের দেওয়া ২০৬ রানের টার্গেট শ্রেয়াসের মুম্বাইয়ের জন্যে যেন এভারেস্টে পরিণত হয়েছিল।

সেই এভারেস্ট টপকাতে প্রয়োজন ছিল ধৈর্য্যের তাছাড়া পালটা আক্রমণের। কিন্তু দুশ্চিন্তায় মগ্ন পূর্ববর্তী ম্যাচগুলোতে কিছু করতে না পারা শ্রেয়াস সেদিন যে তাঁর উপর অর্পিত কাজটা পুরোপুরি করতে পারবেন তাতে সন্দেহ ছিল হয়ত। কিন্তু একেবারে শুরু থেকেই তিনি চাপে রেখেছিলেন উত্তর প্রদেশের বোলারদের।

তৃতীয় বলেই ডাউন দ্য উইকেটে এসে ছক্কা হাঁকিয়ে তিনি প্রমাণ করেছিলেন, দুশ্চিন্তায় তিনি হন না নড়বরে। শেষমেশ বোলারদের পালটা আক্রমণের সাথে নিজের ধৈর্যের সংমিশ্রণে তিনি করেন ৭৫ রান এবং দলকে শুধু যে বিপর্যয় থেকে বাঁচিয়েছিলেন তা নয় এনে দিয়েছিলেন জয়।

জয়ের পাশাপাশি নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন এবং সর্বোপরী কোচের আস্থার প্রতিদান দিতে পেরেছিলেন আইয়ার। তারপর সেই মৌসুম তিনি শেষ করেছিলেন ৮০৯ রানে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান নিয়ে।

সবচেয়ে মজার বিষয় আইয়ার যেই মাঠে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলেন যেই মাঠ থেকেই একজন লাল বল আর সাদা জার্সির সম্মানের মাহাত্ম্য বুঝতে পেরেছিলেন আজ তাঁর ভারত দলের টেস্ট অভিষেক হলো ঠিক সেই মাঠেই। কানপুরের গ্রিন পার্ক স্টেডিয়ামটা নিশ্চয়ই আইয়ারের জীবনে হয়ে রইবে চিরস্মরণীয়। কিন্তু আদৌ কি মসৃণ ছিল তাঁর এই পথ?

শ্রেয়াস আইয়ার বরাবরই ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটের নিয়মিত পারফর্ম করে যাচ্ছিলেন সেই ২০১৪ থেকেই। নিয়মিত ব্যাট হাতে রানের চাকা থাকতো তাঁর সচল। এখন পর্যন্ত ৫৪টি প্রথম বিভাগ ম্যাচ খেলেছেন আইয়ার। রান পেয়েছেন ৪৫৯২। গড় ৫২.১৮। শতক হাঁকিয়েছেন ১২টি এবং অর্ধশতকের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ ২৩টি। সর্বোচ্চ ২০২ রানে অপরাজিত ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এক প্রস্তুতি টেস্ট ম্যাচে। সেই ম্যাচটি প্রথম বিভাগ ম্যাচ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল আইসিসির কাছ থেকে।

নিজের ব্যাটিং দক্ষ্যতার ফলশ্রুতিতে তিনি ২০১৭ সালে ডাক পেয়েছিলেন ভারতীয় টেস্ট দলে। কিন্তু সেবার তাঁর অভিষেক হয়নি কোন এক কারণবশত। তারপর কেটে গেলো প্রায় বছর চারেক তবুও কেমন যেন এক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন শ্রেয়াস আইয়ার। কিছুটা বিরক্তি কিংবা হতাশা নিয়ে তাঁর বাল্যকালের কোচ প্রবীন আমরেকে বলেছিলেন, ‘আমি যদি অন্যদেশের হয়ে ক্রিকেট খেলতাম তাহলে হয়ত আমি এতদিনে টেস্ট খেলতে পারতাম।’

হতাশ ছাত্রের এমন উক্তিতে বিচলিত না হয় কোচ প্রবীন তাঁকে ধৈর্য্য ধরার পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং সেই পুরোনো উক্তির মতো ‘সবুরে মেওয়া ফলেদ এর ভাবার্থ শ্রেয়াসকে বুঝিয়ে তিনি থাকতে বলেছিলেন অপেক্ষায়। প্রবীন জানতেন একদিন না একদিন তাঁর এই ছাত্র ভারতের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটের মর্যাদার ক্যাপটি পরবেন এবং বনে যাবেন ক্রিকেটের বনেদী ফরম্যাটের একজন সদস্য।

২০১৭ তে টেস্ট অভিষেক না হলেও ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে ভারতের হয়ে সেই বছরই রঙ্গিন জার্সি গায়ে জড়িয়েছিলেন শ্রেয়াস আইয়ার। তারপর থেকে এখন অবধি সে ওয়ানডেতে ম্যাচ খেলেছেন ২২টি পক্ষান্তরে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে ৩২টি। ওয়ানডেতে ১০০ স্ট্রাইক রেটে রান করেছেন ৮১৩টি এবং গড় প্রায় ৪৩ এর কাছাকাছি। টি-টোয়েন্টিতে তাঁর রানের সংখ্যা ৫৮০। গড় ২৭.৬১ ও স্ট্রাইক রেট ১৩২ এর থেকে একটু বেশি।

বহুল প্রত্যাশিত টেস্ট ক্যাপ শ্রেয়াস আইয়ার পেয়ে গেছেন। এখন দেখবার পালা তিনি সবার প্রত্যাশা মিটিয়ে তিনি ভারতের টেস্ট ইতিহাসের সেরাদের কাতারে জায়গা করে নিতে পারবেন কিনা! শুরুটা অবশ্য বেশ প্রশংসনীয়ই ছিল। ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট ইনিংসেই পেয়েছেন বড় ইনিংসের দেখা। এবার আর নিশ্চয়ই বাইরে বসে থাকতে চাইবেন না, মাঠে থেকেই গ্যালারির করতালিতে সিক্ত হতে চাইবেন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link