১৯৫২-৫৩ মৌসুমের ক্যারিবিয়ান সফর। ক্যারোল বলে এক ট্রিনিদাদিয়ান মেয়ের বাবা, পোর্ট অফ স্পেনের সান ফার্নান্দো নামক একটি জায়গায় একটি প্রদর্শনী ম্যাচের আয়োজন করেন। বছর তেইশের এক যুবক তখন ক্যারিবিয়ান কাঁপাচ্ছেন কব্জির হালকা মোচড়ে।
এই কব্জি অবশ্য ভিভিএস লক্ষ্মণ, মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথের মতো ব্যাট ধরা হাতের কব্জি নয়। এ কব্জি লাল বল ধরা হাতের। সেই মোচড় সেবার ক্যারিবিয়ানদের এমন নেশাতুর করে ফেলেছিলো, যে তার কাছে কোথায় লাগে খাঁটি জামাইকান রাম। তা ম্যাচের পর একটা অনুষ্ঠানে ক্যারোল নামের সেই মেয়েটির সাথে বছর তেইশের সেই যুবকের চোখাচুখি হয়ে যায়।
ব্যাস ! তারপর আর কি? বছর তেইশের যুবক এরপর তাঁর নিজের দেশে ফিরে এসেই ক্যারোলকে চিঠি লেখা শুরু করেন। সে চিঠির উত্তরও পাচ্ছিলেন। শেষমেশ ক্যারোলকে তার বছর সাতেকের মধ্যে বিয়েই করে ফেললেন। তখনকার বছর তেইশের যুবক হলেন সুভাষ গুপ্তে। ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা লেগ স্পিনার। গ্যারি সোবার্সের সংশাপত্র প্রাপ্ত।
অথচ আমরা কুম্বলে, অশ্বিন, বেদি, প্রসন্ন, বেঙ্কট, চন্দ্রশেখর নিয়ে যা আলোচনা করি, তার সিকির সিকি ভাগও সুভাষ গুপ্তের জন্যে বরাদ্দ নেই। অথচ তাঁর সতীর্থ ও বিপক্ষ, দু দলই সমান ভাবে গুপ্তের জয়গান করেছেন। ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তের ইতিহাসবিমুখতা আজ সুভাষ গুপ্তে কে মনে রাখার সুযোগ দেয়নি। কিন্তু গুপ্তেকে ভোলা যায়? কেন যায় না সে বিষয়ে আসি।
গুপ্তের হাতে দু’রকম গুগলি ছিল। অন্তত প্রতক্ষ্যদর্শীরা তাই বলেন। মানকারের খুব প্রিয় বোলার ছিলেন গুপ্তে। ফ্লাইট দিতে ভালোবাসতেন। ব্যাটার যখনই প্রলুব্ধ হয়ে বলটি ওড়াতে যাবেন, তিনি আবিষ্কার করবেন বলটি তাঁর নাগালের বাইরে। অত:পর!
গুপ্তে বললেই যেটা সর্বপ্রথম মনে আসে, সেটা ১৯৫৮ সালে কানপুরে তাঁর ১০২ রানে ৯ উইকেট। এবং তাও প্রথম দিনে। ভালো ব্যাটিং উইকেটে। কনরাড হান্ট, গ্যারি সোবার্স, রোহান কাহ্নাই – প্রত্যেকেই গুপ্তের শিকার। নেহায়েৎ বসন্ত রঞ্জনে মাঝে একবার ল্যান্স গিবসকে আউট করে দেন। নাহলে লেকারের রেকর্ড সেদিনই ছুঁয়ে ফেলতেন গুপ্তে। পরে অবশ্য এটা নিয়ে আক্ষেপও করেছেন, ‘ঐদিন রঞ্জনের জায়গায় ভিনু থাকলে, আমার দশ উইকেটের জন্যে খারাপ বোলিং করে দিতো। বসন্ত করলো না।’
অবশ্য রঞ্জনে পেয়েছিলেন অষ্টম উইকেট। কাজেই রঞ্জনকে একেবারে দশ দেওয়া যায় না। এবং সেটা ম্যাচের প্রথম ইনিংসও ছিল বটে। ম্যাচটা যদিও হেরে যায় ভারত। ওয়েস্ট ইন্ডিজ কে সামনে পেলেই কোনো এক মন্ত্রবলে যেন গুপ্তের ধার বেড়ে যেত। ১৯৫২-৫৩র ক্যারিবিয়ান সফরেই তো। সফরের সব ম্যাচ মিলিয়ে পেয়েছিলেন ২৩ গড়ে ৫০ উইকেট। যার ২৭ টা ছিল টেস্ট ম্যাচে। সেই সময়ের ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে ছিলেন থ্রি ডব্লিউড, স্টলমেয়ার, রে, পারিয়াদিউ। তারকা খচিত বললে কম বলা হয়।
বোম্বে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের হয়ে একবার ইনিংসে ১০ উইকেট নিয়েছিলেন পাকিস্তান সার্ভিস ও ভাওয়ালপুর ক্রিকেট ক্লাবের সম্মিলিত একাদশের বিরুদ্ধে।ভারতের প্রথম পাকিস্তান সফরের আগে সেই ম্যাচে টার্ফ উইকেটে গুপ্তে বিক্রম দেখে, পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড আসন্ন সফরের তিনটি টেস্ট ম্যাচ ম্যাটিং উইকেটে করার সিদ্ধান্ত নেয় ও মাত্র দুটি টার্ফে। তবুও অবশ্য গুপ্তেকে রোখা যায়নি। তিনি সেই সফরেও ভারতের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী।
ঢাকায় একটি টেস্ট ম্যাচে গুপ্তেকে রোখার জন্যে, আম্পায়ার নো-বল ডাকেন। গুপ্তে, যিনি জীবনে কখনও নো-বল করেননি ডাক শুনে স্তম্ভিত। এবং বিশেষ করে তখনও তাঁর ডেলিভারি স্ট্রাইড শেষ হয়নি। গুপ্তে আম্পায়ারকে বোলিং মার্কে ফিরে যেতে যেতে বলেন, ‘তুমি উইজডেনের রেকর্ড বইয়ে গুপ্তেকে নো বল ডাকা একমাত্র আম্পায়ার হিসাবে স্থান পাবে।’ এরপর আর ওই আম্পায়ার গোটা সিরিজেই নো বল ডাকেননি।
গুপ্তের টেস্ট ক্রিকেট জীবনে তালাচাবি লেগে যায় ১৯৬০-৬১র ইংল্যান্ড সিরিজে। সিরিজের প্রথম তিন টেস্ট ড্র হয়ে যায়। দিল্লিতে তৃতীয় টেস্ট শেষ হবার পর কলকাতা টেস্ট শুরু হবার আগে হাতে বেশ কিছুদিন সময় ছিল। হঠাৎ খবর এলো, গুপ্তে এবং তাঁর রুমমেট এ.জি.কৃপাল সিং শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে পরের কলকাতা টেস্ট খেলবেন না। পরে জানা গেছিলো, গুপ্তের সেই ব্যাপারে কোনো দোষই ছিল না। গুপ্তের রুমমেট, কৃপাল সিং, দিল্লির হোটেলের নারী রিসেপশনিস্টকে খাওয়াতে নিয়ে যাবার প্রস্তাব দেন।
তাতে চটে গিয়ে রিসেপশনিস্ট অভিযোগ করেন, ‘ভারতের ক্রিকেটারদের থেকে এরকম ব্যবহার আশা করা যায় না।’ কৃপাল সিং গুপ্তের কাছে স্বীকার করেওছিলেন, যে গুপ্তের কোনো দোষ নেই। অথচ, গুপ্তেকে কমিটি এই বলে বাদ দেয় যে, ‘তোমার কৃপালকে আটকানো উচিত ছিল।’ গুপ্তে সোজাসাপ্টা জবাব দেন, ‘ও কি বাচ্চা ছেলে? আমি কেনই বা বলতে যাবো।’ এবং এই নীতিপুলিশির মাশুল গুনতে হয় গুপ্তের টেস্ট ক্রিকেট জীবনকে।
ঠিক যে কারণে আজও রাহুল দ্রাবিড় তাঁর স্বচ্ছ ইমেজের কারণে এতো জনপ্রিয় এবং রবি শাস্ত্রী তাঁর ফ্ল্যাম্বয়েন্সের কারণে গণশত্রু। একেবারে ক্রিকেট বহির্ভূত কারণে একজন পূজিত হন তো আরেকজন ধিক্কৃত। সেই একই কারণে সুভাষ গুপ্তেকে থেমে যেতে হয় মাত্র ৩৬ টেস্ট, ১৪৯ উইকেট ও ২৯ গড়ে। এরপর তিনি আর ভারতে থাকেননি। ট্রিনিদাদের এক ক্রিকেটপ্রেমী ফ্র্যাঙ্ক ব্ল্যাকবার্ন, তাঁকে চিনির কোম্পানি ক্যারোনিতে চাকরি করে দেন।
ভারতের জনজীবনে এক বাঙালি সুভাষ এতো জনপ্রিয়। কিন্তু এই সুভাষ, বাংলার হয়ে কয়েকদিন খেলেও, বাঙালি তো দূরস্থান, গোটা ভারতের ক্রিকেট মহলেই বিস্মৃত। রোহিত-কোহলি-সৌরভ-ধোনি-শচীন-দ্রাবিড় খেয়োখেয়ি ছেড়ে বেড়োলে অবশ্য মনে এনাদের মতো মানুষের জন্মদিন-টিন গুলো মনে পড়ার সুযোগ থাকে। যাক গে, সেসব আবার অন্য কথা।