আধুনিক বিশ্বে অনেকেই হয়ত ভেবে থাকে ক্রিকেটের সবচেয়ে উপভোগ্য এবং মর্যাদার ফরম্যাট হয়ত ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টি। তবে সত্যিকার অর্থে ক্রিকেটের সবচেয়ে মর্যাদার ফরম্যাট টেস্ট ক্রিকেট। একজন ক্রিকেটারের সম্পূর্ণ মানসিক দৃঢ়তা ও ক্রিকেটীয় স্কিলের প্রমাণ মেলে। তাছাড়া একজন নানন্দিক ব্যাটারেরে ব্যাটিং কিংবা একজন ধূর্ত বোলারের একটানা বোলিং অবশ্যই উপভোগের বিষয়।
ক্রিকেটের এই বনেদি ফরম্যাটের মর্যাদা ও উত্তেজনা বাড়াতে, আইসিসি প্রচলন করছেন নতুন এক শিরোপার। যার নামকরণ করা হয়েছে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ। ২০২১ সালের পুরোটা সময় জুড়ে প্রাধান্য পেয়েছে টেস্ট ক্রিকেট। টেস্ট খেলুড়ে সবগুলো দলই বছরের বিভিন্ন সময়ে নেমেছিল সাদা পোষাকে লাল বল হাতে। তাছাড়া প্রথম টেস্ট চ্যাম্পিয়নের দেখা তো এ বছরই পেয়েছিল বিশ্ব। ভারতকে হারিয়ে শিরোপা নিজেদের করে নিয়েছিল নিউজিল্যান্ড। বছরজুড়ে যেহেতু হয়েছে টেস্ট, তাই বছরের শেষ প্রান্তে এসে বছরের সেরা টেস্ট একাদশ সাজানোর একটা প্রচেষ্টা করা যেতেই পারে। সেই আয়োজনে সবাইকে আমন্ত্রণ।
- রোহিত শর্মা (ভারত)
ভারতের ব্যাটিং আক্রমণের নির্ভরযোগ্য প্রতিনিধি রোহিত শর্মা। বছরের পুরোটা জুড়েই সাদা পোষাকে ছিলেন দারুণ ছন্দে। যদিও এই বছরের শেষ টেস্টে তাঁর সার্ভিসটা পাচ্ছে না টিম ইন্ডিয়া। তবে এর আগে রোহিত ভারতের হয়ে এই বছরের টেস্ট খেলেছেন ১১টি। ৪৭.৬৮ গড়ে রান তুলে রয়েছেন বর্ষসেরা রান সংগ্রাহকদের তালিকার দ্বিতীয়স্থানে। নামের পাশে রয়েছেন দুইটি শতক ও চারটি অর্ধশতকের পাশাপাশি ৯০৬ রান। ইনিংস ওপেনিং এর দায়িত্ব তাই তাঁর হাতেই ছেড়ে দেওয়া যথার্থ।
- দ্বিমুথ করুনারত্নে (শ্রীলঙ্কা)
লঙ্কান টেস্ট অধিনায়ক দ্বিমুথ করুনারত্নে এ বছরের ছিলেন দলটির সেরা পারফর্মার। একা হাতেই লঙ্কান টেস্ট ক্রিকেটটাকে টেনে নিয়েছেন বছরজুড়ে। বছরের সেরা টেস্ট রান সংগ্রাহকদের তালিকার তৃতীয় স্থানে থাকা দ্বিমুথ করুনারত্নে টেস্টের সেরা একাদশের রোহিত শর্মার যোগ্য সঙ্গী হতে পারেন দ্বিমুথ করুনারত্নে। তাঁর ব্যাট থেকে চার শতক ও তিন অর্ধশতকের কল্যাণে বছরজুড়ে রান এসেছে ৯০২। মাত্র সাত টেস্ট থেকে। শীর্ষে থাকা তিন ব্যাটারদের মধ্যে করুনারত্নের গড় সবচেয়ে বেশি ৬৯.৩৮।
- মার্নাস লাবুশেন (অস্ট্রেলিয়া)
টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে দ্রুততম ২০০০ রানের মাইলফলক পার করা পঞ্চম ব্যাটার অস্ট্রেলিয়ার ল্যাবুশেন। মাত্র ২০ টেস্ট খেলেই তিনি চলে এসেছেন আলোচনায়। তাছাড়া তাঁর সামর্থ্যের কথা মাথায় রেখে বছরে সেরা টেস্ট একাদশেও জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। মাত্র চার টেস্ট খেলে লাবুশেন রান করেছেন ৪৭৪। গড় ঠিক ৭৯। তাছাড়া মাত্র আট ইনিংসের ব্যাটিং-এ তিনি দুইটি শতক ও তিনটি অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন। তৃতীয় উইকেটে তাঁর প্রতি আস্থা রাখাই যায়।
- জো রুট (ইংল্যান্ড)
২০২১ সালে ইংল্যান্ডের সেরা পারফর্মার কোন দ্বিধাদ্বন্দ ছাড়াই বলে দেওয়া যায় জো রুট। এই বছরের সেরা রান সংগ্রাহকদের তালিকা ডমিনেট করছেন জো রুট। রানের বিবেচনায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা ব্যাটারের রানের দূরত্ব প্রায় সাতশ রানে। এই বছরে রুট খেলেছেন ১৪টি টেস্ট ম্যাচ। অ্যাশেজ ও চলমান। এই ১৪টি ম্যাচে রুট রান করেছেন প্রায় ৬৪ গড়ে। তাঁর মোট রান ১৬০৬। সর্বোচ্চ ২২৮ রানের এক ইনিংসও রয়েছে। তাছাড়া ছয়টি শতকের সাথে তিনটি অর্ধশতকের দেখাও পেয়েছেন রুট ২০২১ সালে। বছরের সেরা টেস্ট একাদশের মিডেল অর্ডরকে স্বস্তি জোগাতে রুটে বিকল্প নেই। তাছাড়া ইংল্যান্ডের অধিনায়কের দায়িত্বে আজকের একাদশের অধিনায়কত্বের দায়িত্বও ন্যাস্ত থাকছে।
- ঋষাভ পান্ত (ভারত)
বর্ষসেরা টেস্ট একাদশের উইকেট রক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে দলে থাকছেন ঋষভ পান্ত। কেননা ১১ ম্যাচ খেলা ঋষভ উইকেটের পিছনে দাড়িয়ে অংশ নিয়েছেন ৩২টি উইকেট শিকারে। যা কিনা এ বছরেরে তৃতীয় সর্বোচ্চ। তাছাড়া ব্যাট হাতে ঋষভ এ বছর ছিলেন ভারতের দ্বিতীয় সেরা রান সংগ্রাহক। প্রায় ৬৬ গড়ে তাঁর ব্যাট থেকে রান এছেছে ৭০৬। একটি শতকের সাথে রয়েছে পাঁচটি অর্ধশতক। মিডেল অর্ডারের আস্থার প্রতীক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন ঋষভ পান্ত। ব্যাটিং এর পাশাপাশি তাঁর হাতে রয়েছে ভরসার দস্তানাও।
- লিটন দাস (বাংলাদেশ)
বাংলাদেশে হয়ে এ বছরের সেরা পারফর্মারদের একজন লিটন দাস। টেস্টে বাংলাদেশের হয়ে একমাত্র ধারাবাহিক খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। ব্যাট হাতে বছরটা বেশ ভালই কেটেছে লিটনের। পাঁচটি অর্ধশতক ছাড়াও এ বছর তিনি দেখা পেয়েছেন টেস্টে তাঁর প্রথম শতকের। ৫৭.৫০ গড়ে তিনি লোয়ার মিডেল অর্ডারে খেলেছেন মানানসই সব ইনিংস। সাত টেস্টে ৫৯৪। তাছাড়া উইকেটের পেছনের দায়িত্বও পালন করতে পারবেন লিটন। উইকেট রক্ষকের দস্তানা হাতে তিনি ২০টি উইকেট শিকারে সহয়তা করেছেন তাঁর স্বদেশি বোলারদের। লোয়ার মিডেল অর্ডারে বর্ষসেরা একাদশে তিনি হতে পারেন যোগ্য বিকল্প।
- রবিচন্দ্রন অশ্বিন (ভারত)
ভারতের প্রথম টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ওঠা দল। তবে দুর্ভাগ্যবশত তাঁরা হেরেছে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। তবে ২০২১ সালে তাঁদের হয়ে ব্যাট হাতে যেমন আলো ছড়িয়েছেন ঋষভ, রোহিতরা তেমনি বল হাতেও ভারতকে বহু জয়ের ভীত গড়ে দিয়েছেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। তিনি রয়েছেন উইকেট সংগ্রাহকদের তালিকার শীর্ষে। এবছর ভারতের হয়ে আট ম্যাচে অশ্বিনের উইকেট সংখ্যা ৫২টি। প্রায় ১৬ গড়ে তিনি উইকেট নিয়েছেন নিয়মিত। তিন ইনিংসে ফাইফার নেওয়ার কীর্তিও রয়েছে তাঁর। তাই বর্ষসেরা একাদশের স্পিন আক্রমণের দায়িত্ব তাঁর উপর ছেড়ে দেওয়াই শ্রেয়।
- অক্ষর প্যাটেল (ভারত)
রবিচন্দ্রন অশ্বিনের যোগ্য স্পিন বোলিং সতীর্থ হিসেবে বর্ষসেরা টেস্ট একাদশে থাকছেন তাঁরই স্বদেশি বা-হাতি স্পিনার অক্ষর প্যাটেল। এই দুই ভারতীয় স্পিনার প্রতিপক্ষের ব্যাটারদের কোনঠাসা করে উইকেট শিকারে যেন কার্পণ্য করেননি। মিলেমিশে প্রতিপক্ষের ব্যাটিং ধ্বসিয়ে দেওয়াই যেন ছিল তাঁদের মূল লক্ষ্য। ৩৬ উইকেট নিয়ে সেরা উইকেট সংগ্রাহকদের তালিকার চতুর্থস্থানে অবস্থান করছেন অক্ষর প্যাটেল। পাঁচ বার ইনিংসে পাঁচের অধিক উইকেট নেওয়ার পাশপাশি একটি ম্যাচে দশ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্বও রয়েছে অক্ষর প্যাটেলের।
- শাহিন শাহ আফ্রিদি (পাকিস্তান)
বর্তমান বিশ্বের পেসারদের মধ্যে পারফর্মেন্স এবং বোলিং দক্ষতার বিবেচনার শীর্ষের দিকে রয়েছেন পাকিস্তানের বা-হাতি ফাস্ট বোলার শাহিন শাহ আফ্রিদি। প্রতিপক্ষে ব্যাটারদের মূর্তিমান আতংকের নাম শাহিন শাহ আফ্রিদি। এই বছর সবগুলো ফরম্যাটেই ছিলেন উজ্জ্বল। টেস্টে তো রয়েছে উইকেট সংগ্রাহকদের তালিকায় রয়েছেন দ্বিতীয় স্থানে। উইকেট সংখ্যা ৪৭। প্রায় ১৭ গড়ে উইকেট নিয়েছেন এই গতিতারকা। খেলছেন নয় ম্যাচ। তাঁর মধ্যে তিন ইনিংসে নিয়েছেন ফাইফার ও এক ম্যাচে একাই নিয়েছিলেন প্রতিপক্ষের দশ উইকেট।
- হাসান আলী (পাকিস্তান)
ভারতের অশ্বিন-অক্ষর জুঁটি যেমন প্রতিপক্ষকে কাবু করেছে স্পিন ঘূর্ণিতে তেমনি পাকিস্তানের হাসান আলী-আফ্রিদি খাবি খাইয়েছেন দ্রুতগতি আর সুইং-এ। আফ্রিদি রয়েছেন উইকেট সংগ্রাহকদের তালিকার দ্বিতীয়তে এবং হাসান রয়েছেন তৃতীয়স্থানে। হাসান ১৬.০৭ গড়ে উইকেট নিয়েছেন ৪১টি। পাঁচটি ইনিংসে পাঁচের অধিক উইকেট নেওয়ার পাশপাশি এক ম্যাচে দশ উইকেটও নিয়েছেন হাসান আলী। সুতরাং হাসান আলী এবং শাহীন আফ্রিদির জুঁটি ভরসা জুগিয়ে যায়গা করে নিচ্ছেন বর্ষসেরা টেস্ট একাদশে।
- জেমস অ্যান্ডারসন (ইংল্যান্ড)
টেস্টে ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের সেরা বোলারদের মধ্যে নিস:ন্দেহে জেমস অ্যান্ডারসন অন্যতম। ২০২১ সালে এসেও অ্যান্ডারসনের ধার যেন কোন অংশেই কমেনি। এ বছর তাঁর নেওয়া উইকেট সংখ্যা ৩৪টি। ২৩.৭৩ গড়ে তিনি উইকেট নিয়েছেন ১১ ম্যাচে। চলমান অ্যাশেজ সিরিজের দলে রয়েছেন তিনি। সুযোগ পেলে তিনি যে তাঁর এই পরিসংখ্যান ছাপিয়ে যাবেন সে বিষয়ে সন্দেহের বিশেষ অবকাশ নেই। তাই তিনি থাকছেন আজকের একাদশের তৃতীয় পেস বোলার হিসেবে।