১৯৮৩ আমার জন্মসাল। ভারতের প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপ জেতার বছরও বটে। আমার থেকে ৮-১০-১৫ বছর বা তারও বেশি বয়োজ্যেষ্ঠরা এই প্রথম বিশ্বকাপ জয় প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং যেকোনো ক্রিকেট সংক্রান্ত আলোচনায় তারা ৮৩ এর জয়কে খুব উঁচু স্থান দিতেন। কপিল ও অধিনায়ক হিসেবে তাঁদের চোখে থাকতেন খুব উপরে।
আমরা যারা ৮৩ বিশ্বকাপের সময় জন্মাইনি বা খুব ছোট, তারা স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তী জেনারেশন এর অন্তর্গত হয়ে গেছিলাম এবং, সেই নস্টালজিয়া থেকে বঞ্চিত হলাম। বহুদিন পর্যন্ত (ধোনি ২০১১ বিশ্বকাপ জেতার আগে পর্যন্ত )আমাদের প্রজন্মের নিজের চোখে দেখা কোনো ভারতীয় অধিনায়কের সেরা সাফল্য ছিল ২০০৩ এর ফাইনালে ওঠা। এখানেই একটা তর্ক হতো, যে সৌরভ ভারতের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ অধিনায়ক কিনা!
সিনিয়র প্রজন্ম সবসময় কপিলকে আগে রাখতেন, প্রথম এবং সেই সময় পর্যন্ত একমাত্র বিশ্বকাপ জয়ের কারণে। আমরা সৌরভ ভক্তরা লড়ে যেতাম ওভারঅল জয় হারের রেকর্ড, বিদেশে টেস্ট জয় ইত্যাদি নিয়ে, এবং যুক্তিতে পেরে না উঠলে একটু বিলো দ্য বেল্ট মন্তব্য – ৮৩ তো ফ্লুক! পরের হোম সিরিজেই তো ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ব্লাকওয়াশ!
এই মন্তব্য কিন্তু দাদা কাকা জ্যাঠারা কিছুতেই হজম করতে পারতেন না। তারা অনেক বোঝাতে চাইতেন, কিভাবে ভারত একটা অতি সাধারণ দল থেকে অসাধারণ পারফরম্যান্স করে কাপ জিতেছিল, কিভাবে এই জয় গোটা দেশকে অনুপ্রাণিত করেছিল, কিভাবে এই জয় থেকেই ভবিষ্যতের ভারতীয় ক্রিকেটাররা অনুপ্রাণিত হয়ে খেলা শুরু করবেন।
কবীর খানকে ধন্যবাদ, এমন একটি সিনেমা তিনি বানালেন, যে আমাদের যে প্রজন্ম ৮৩ বিশ্বকাপ লাইভ দেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, তাদের মনেও আর কোনো সন্দেহ থাকলো না যে কেনো ৮৩ একটা আনরিয়েল অ্যাচিভমেন্ট।
প্রথমত, সিনেমাটা দেখতে যাবার আগে থেকেই জানতাম, আমার জন্যে নতুন কোনো তথ্য এই সিনেমায় নেই, যা আমি আগে জানিনা। তাহলে কেনো গেলাম?
কারণ ওই একটাই, ৮৩ জয়ের ১৭ দিনকে চোখের সামনে জীবন্ত দেখা, যে উত্তেজনা আর আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছি, সেগুলো অনুভব করা। এবং সেই বিষয়ে এই সিনেমা ১০০ শতাংশ সফল। প্রথমত, সিনেমায় কোনো অপ্রাসঙ্গিক ভ্যানতাড়া নেই। কপিলকে কেন্দ্র করেই সিনেমা, কিন্তু কপিলের জন্ম থেকে নিয়ে তাকে কিশোর বয়সে কে সাইকেল চালিয়ে খেলার মাঠে নিয়ে গেছেন বা কত কষ্ট করে তাকে বড়ো হতে হয়েছে সেই নিয়ে মেলোড্রামা নেই।
৮৩ বিশ্বকাপে ভারতের পার্টিসিপেট করা থেকেই সিনেমা শুরু এবং সময় নষ্ট না করে আসল টপিকে প্রবেশ। রণবীর সিং কপিলের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন। চেহারার অমিল ঢেকে দিয়েছেন কথাবার্তা ও ম্যানারিসম দিয়ে। পঙ্কজ ত্রিপাঠী অসাধারণ অভিনেতা, শ্রদ্ধার পাত্র। তিনি কোচ মান সিংহের চরিত্রে বোধ হয় আসল মান সিংহের থেকেও বেশি যথোপযুক্ত।
বাকি ক্রিকেটারদের, বিশেষ করে ভারত ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটারদের একদম ছবির মত মনে হয়েছে। এর প্রধান কারণ ওই টুর্নামেন্টে খেলা ক্রিকেটারদের ছেলেদের উপযুক্ত চরিত্রে কাস্টিং করা, যার ফলে চেহারার মিল ও আচরণ দারুণ মিল খেয়েছে। সন্দীপ পাতিলের চরিত্রে তাঁর ছেলে ভালো মানিয়েছেন, ম্যালকম মার্শালের চরিত্রে তার ছেলে তো পুরো যুবক মার্শাল!
বোলিং অ্যাকশন অবধি হুবহু এক! এ ছাড়াও লয়েডের ছেলে জোয়েল গার্নারের চরিত্রে, চন্দ্রপলের ছেলে ল্যারি গোমস এর চরিত্রে, গর্ডন গ্রিনিজের ছেলে তার বাবার চরিত্রে একদম পারফেক্ট! এ ছাড়াও গাভাস্কারের চরিত্র, মদন লাল, রবি শাস্ত্রী, সদ্য প্রয়াত যশপাল শর্মা, মহিন্দার অমরনাথ এই সব চরিত্রগুলোও জীবন্ত।
বিশেষ করে গাভাস্কারের চরিত্রে তাহির দুর্দান্ত। শ্রীকান্তের চরিত্রেও জিভা একদম খাপ খেয়েছেন। লালা অমরনাথের চরিত্র করেছেন স্বয়ং মহিন্দর অমরনাথ। খেলার বর্ণনা, তথ্যগত ভাবে নিখুঁত থাকা, ছোট ছোট ডিটেল মিস না করা সিনেমাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। অধিকাংশ খেলার দৃশ্য অভিনয় করে শুট করা, কিন্তু বাস্তবের খেলার সাথে হুবহু মিল রয়েছে। অন্যান্য সিনেমার মত আসল খেলার ক্লিপিংস গুঁজে দিয়ে কাজ সারা হয়নি।
মহিন্দরের বুকে পেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোলারদের বলের আঘাতে কালশিটে রয়েছে, বেংসরকারের চোয়ালে চোট পেয়ে পিচে রক্ত পড়া আছে, শ্রীকান্তের হাঁটু মুড়ে রবার্টসকে স্কোয়ার ড্রাইভ মারা আছে, সাঁধুর ইন কাটারে গ্রীনিজের বোল্ড হওয়া আছে। আছে প্রায় নিখুঁত ভাবে শুট করা কপিলের অসাধারণ চল্লিশ গজ দৌড়ে নেওয়া রিচার্ডসের ক্যাচ। প্রতিটা আউটের দৃশ্য চেষ্টা করা হয়েছে বাস্তবের সাথে মিল রাখার। দু-একটি যা তথ্যগত ভুল আছে সেটা এতোই নগন্য যে অগ্রাহ্য করাই যায়।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে গ্রুপ লিগ ও ফাইনাল বাদে এই বিশ্বকাপের মহা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো জিম্বাবুয়ের সাথে ফিরতি ম্যাচ, যা হারলে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় আর সেখানেই ১৭/৫ থেকে কপিলের সেই অমর ইনিংস! যে ম্যাচের কোনো ভিডিও রেকর্ডিং নেই, ব্রিটিশরা কলোনিয়াল মেন্টালিটি থেকে না বেরোতে পারার কারণে ওই ম্যাচে কোনো ক্যামেরা ও ক্যামেরাম্যান না পাঠানোয়।
হ্যাঁ, আপনি ঠিকই পড়ছেন, কোনো বিবিসি স্ট্রাইক হয়নি। ওইদিন পাকিস্তান বনাম ইংল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ ছিল, যে ম্যাচের সম্প্রচার বেশি গুরুত্ব পায় আয়োজকদের কাছে। ( এই তথ্য অবশ্য সিনেমায় পাবেন না, ওখানে বিবিসি স্ট্রাইক এর প্রচলিত গল্পই শোনানো হয়েছে)। এই ম্যাচটির দৃশ্য পুরোপুরি ভাবে বিভিন্ন সংবাদপত্র আর্টিকেল আর স্টিল ফটো থেকে নির্মাণ করা হয়েছে, যা আমাদের কপিলের এই অবিশ্বাস্য ইনিংসটি কল্পিত হলেও নিজে চোখে দেখার সুযোগ করে দেয়।
আজকের দিনে দাঁড়িয়েও অবিশ্বাস্য লাগে কিভাবে ১৭/৫ এবং কিছু পরেই ৭৮/৭ ও ১৪০/৮ হয়ে যাওয়ার পরেও কপিল কিছুটা বিনি আর কির্মানির অমর লড়াই ২৪* এর সাথে একার হাতে দলের স্কোর পৌঁছে দেন ২৬৬ তে! নবম উইকেটে অবিচ্ছেদ্য ১২৬ রানের পার্টনারশিপ আর তাতে কিরমানির মাত্র ২৪! বাকিটা মোটামুটি কপিল। ভাবুন, আজকের দিনে আমার আপনার টি টোয়েন্টি খেলা কোন হিরো কে আপনি কল্পনা করছেন এই ইনিংসটি খেলতে? আমি তো পারছি না কাউকে ভাবতে।
এর পরে আসে কপিলের লড়াকু মনোভাব। বাকি টিমের মধ্যে যদি বা কিছুটা বেড়াতে এসেছি, সেমিফাইনালে গেলেই অনেক – এই ধরনের মনোভাব থেকেও থাকে, কপিল একার হাতে সেগুলো টেমস নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দেন। এই দৃশ্য গুলি রণবীর সিং নিজের ইমেজ থেকে বেরিয়ে এসে অসাধারণ ফুটিয়েছেন। বাস্তব জীবনে চূড়ান্ত ছ্যবলা হিসেবে পরিচিত আর অতি দ্রুত কথা বলতে অভ্যস্ত রণবীর এখানে গ্রাম্য উচ্চারণে, চেপে চেপে কপিলের মত প্রতিটা শব্দ মেপে উচ্চারণ করে দেখিয়েছেন যে তিনি চরিত্রের মধ্যে কতটা ঢুকেছিলেন।
হালকাভাবে হলেও আছে কপিল আর গাভাস্কারের দ্বন্দ্ব। আগে জানা থাকলেও, সিনেমাটি দেখে আবারও মনে হয় এত বড় একটা জয়ে ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ত্রাস সুনীল গাভাস্কারের প্রায় কোনই অবদান ছিল না!
ব্যক্তিগতভাবে আমার দীপিকার চরিত্রটি না থাকলেও চলতো বলে মনে হয়েছে, যদিও তিনি খারাপ করেন নি, অল্পসময়ে। অবশ্য কেউ কেউ তাঁকে রামিজ রাজা ভেবে থাকলে তাদের রসবোধের আমি কদর করি! এছাড়াও সবজায়গায় – হামারে জওয়ান বর্ডার পে লড় রহে হ্যায় – মার্কা ভাবে আর্মির সিন গুলো গুঁজে দেওয়া একটু অতিনাটকীয় লেগেছে।
ফাইনালের সময় এবং সিনেমার শেষে দশ বছরের শচীনের একটা আপিয়ারেন্স আছে। সেটা আরোপিত মনে হলেও, শচীন নিজে ইন্টারভিউতে বলেছেন ৮৩ জয় দেখেই তার মধ্যে স্বপ্ন দেখা শুরু হয় যে তিনিও ভারতীয় দলের হয়ে বিশ্বকাপ খেলবেন ও জিতবেন!
সব মিলিয়ে সিনেমাটি ক্রিকেট ফ্যান দের অবশ্য দ্রষ্টব্য! মাস্ট ওয়াচ যাকে বলে আর কি। অবশ্যই দেখুন, যদি আপনি ৮৩ দেখে থাকেন, ভাগ্যবান আপনি, আরেকবার সেই উত্তেজনার আগুন পোহান, আর যদি আমার মত দুর্ভাগা হন, তাহলে তো আপনার জন্যে আরো দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা হতে চলেছে।
আর আজকের পরে, আমার কাছেও কপিল বাকি ভারতীয় অধিনায়কদের থেকে এগিয়ে থাকবেন। সবার থেকেই। কেননা তিনি ছিলেন বলেই বাকিরা স্বপ্ন দেখেছিলেন। ৮৩ ছিল বলেই ২০০৭, ২০১১ হয়েছে। আর ৬৬-১ দর থেকে ( ফাইনালের লাঞ্চ টাইম এ ১০০-১) চ্যাম্পিয়ন হওয়া, ব্রিটিশ সাংবাদিককে নিজের লেখা গিলতে বাধ্য করা, সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে তাদের দেশে তাদেরকেই ছিটকে দিয়ে ব্রিটিশ প্রভুত্বের শেষ সোপানে পদাঘাত করে তাদের অহঙ্কার চূর্ন করা এসব তো আছেই। ৮৩ ফ্লুক নয়, কোনোভাবেই নয়, হতে পারেনা।
ধন্য ৮৩, ভারতীয় ক্রীড়া ইতিহাসে। ধন্য আমি, এই বছরে জন্মেছি বলে!