এক মনীষীর বিদায়ী যাত্রা

ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে ক্লাসিক ব্যাটসম্যানদের তালিকায় হয়তো তিনি থাকবেন, কিংবা থাকবেন না। কোন একটা ড্রাইভ, পুল কিংনা ফ্লিকের জন্য তিনি হয়তো মনে থাকবেন না। তবে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট আজ যে আকাশ ছুঁয়েছে তাঁর অন্যতম স্থপতি হিসেবে তিনি মনে থাকবেন। দেশটির দুটি জেনারশনের মধ্যে  এক সেতুবন্ধন হয়ে ছিলেন। সর্বপরি রস টেলর ছিলেন পুরো ক্রিকেট দুনিয়ার এক সাধক।

জীবনের ৩৭ টা বছর এই ক্রিকেট ধ্যানেই কাটিয়ে দিয়েছেন। তবে এবার তাঁর জীবনের একমাত্র সঙ্গী ওই ক্রিকেট ব্যাটটাকে একেবারে তুলে রাখতে চান। আর ওই ব্যাটটা হাতে নিয়ে স্ট্রেচ করতে করতে বাইশ গজের দিকে হেঁটে যাবেন না, সেঞ্চুরির পর জিহ্বা বের করে বুনো উল্লাস করবেন না এই ঘোষণা আগেই ছিল। তবে শূন্যতাটা বোঝা যাচ্ছে এখন, যত সময় এগোচ্ছে সবটা যেনো এক হাহাকার হয়ে আসছে।

বাংলাদেশের বিপক্ষেই নিজের শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আজ যখন ব্যাট করতে নামছিলেন তখন এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখলো ক্রিকেট দুনিয়া। পুরো বাংলাদেশ দল গার্ড অব অনার দিল এই ক্রিকেট মনীষীকে। ক্রিকেটের এই বিশাল সাধক লিটন, শান্তদের সামনে তাঁর ধ্যান ভাঙবেন। এই উৎসব থেকে শান্তরা নিজেদের বঞ্চিত করে কী করে। হ্যাঁ, তাঁর বিদায় জানানোটাও একটা উৎসবই।

এই উৎসবে হয়তো রঙ ছোড়াছুড়ি হবে, গান বাজবেনা। বরং একটা মুহূর্তের জন্যে থমকে যাবে পুরো একটা পৃথিবী। রস টেলরকে বিদায় জানানোর জন্য মেঘগুলো হয়তো থেমে যাবে, কিছুক্ষণের জন্য সমুদ্র হয়তো হবে যাবে শান্ত। ক্রিকেটের এক নিপাট ভদ্রলোক বিদায় জানাচ্ছে। পৃথিবীতে সেই সময় কেউ দুষ্টুমি করবে কী করে।

বাংলাদেশ আগীমাকাল ইনিংস ব্যবধানে হেরে গেলে আর হয়তো সাদা পোশাকের ক্রিকেটে ব্যাট হাতে নামবেন না। আজই হয়তো শেষবারের মত তাঁর উইলোটা ঘুরিয়ে ফেললেন। লেগ সাইডে একটু বেশি খেলতেন বলে কত কটূ কথাই না শুনেছেন। তাতে কীই বা আসে যায়। নিউজিল্যান্ডের হয়ে টেস্টে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়েই তো ব্যাটটা উঠিয়ে রাখছেন।

বাংলাদেশের বিপক্ষে এর আগের টেস্টে তাঁর দল হেরেছিল। টেস্ট চ্যাম্পিয়ন নিউজিল্যান্ডের কাছে এটি ব্যর্থতাই বটে। তবে নিজের দলের হারের থেকে ক্রিকেটের জয়টাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল এই ক্রিকেট মনীষীর কাছে। নিজেদের হার ছাপিয়ে টেলর দেখেছিলেন ক্রিকেটের বৃহত্তর চিত্র।

তিনি বলেছিলেন, ‘নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, আমার মনে হয় এটি (বাংলাদেশের জয়) বিশ্ব ক্রিকেটের জন্য ভালো। অবশ্যই আমরা হতাশ যে আমরা তেমন কোনো লড়াই করতে পারিনি। পুরো সময়টায় আমরা স্রেফ উড়ে গেছি। তবে আমার মনে হয়, টেস্ট ক্রিকেটের টিকে থাকার জন্য, বাংলাদেশের উঠে আসা প্রয়োজন।’

সেই ব্রেন্ডন ম্যাককালাম যখন হারতে থাকা নিউজিল্যান্ড দলটার হাল ধরলো তখনো পিছন থেকে লড়ে গিয়েছিলেন এই রস টেলর। কখনো সেভাবে আলোচনায় আসেননি। আবার কেন উইলিয়ামসন যখন নিউজিল্যান্ডকে টেস্ট চ্যাম্পিয়ন করলো সেখানেও অন্যতম কারিগর তিনিই। প্রায় ১৬ বছর ধরে কিউইদের জন্য খেলে গিয়েছেন নীরবে।

তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ার নিয়ে কথাটা বেশি হলেও তিন ফরম্যাটেই সমান কার্যকর ছিলেন। বিশ্বের যেকোন কন্ডিশনে, যেকোন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে তাঁর ব্যাট কথা বলবেই। ওয়ানডে ক্রিকেটে তো প্রায় ৫০ ছুঁই ছুঁই গড়ে রান করেছেন। এই ফরম্যাটে আছে ২১ টি সেঞ্চুরিও।

এবার এই কিংবদন্তির বিদায় বলার সময় এসেছে। বিদায় বেলাতেও কেমন যেনো নিশ্চুপ তিনি। আজ নিজের শেষ ম্যাচ খেলতে নেমেও নিজের কাজটাই করে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। বাড়তি কিছু না, আবার কমও না। যেনো ওই বাইশ গজে নামলে এক ভিন্ন মানুষ, ভিন্ন সাধক।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link