ব্রেন্ডন টেলর: স্পট ফিক্সিং, মাদক ও নিষেধাজ্ঞা

জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন, চারিদিকে সবাই আমোদ-ফূর্তিতে ব্যস্ত। অধিকাংশেরই বেশ নাম-ডাক রয়েছে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে। এমন এক পার্টিতে হাজির জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটার ব্রেন্ডন টেলর। সেখানে তিনি আর বাকি সবার মতোই মেতে উঠলেন আমোদ-ফূর্তিতে৷ এক পর্যায় একটা ভুল করে বসলেন ৷ আর সেই ভুলের মাশুল তাঁকে দিতে হয়েছে গত বছর দুই ধরে। তবে তাতেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করা শেষ হয়ে যাচ্ছে না।

সম্প্রতি ব্রেন্ডন টেলর এক বিশাল বিবৃতি প্রকাশ করেছেন। ২০১৯ সালে তাঁকে ভারতীয় অজ্ঞাত ব্যবসায়ী একটা মোটা অংকের স্পন্সরশিপ ও জিম্বাবুয়েতে একটি ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগ আয়োজনের প্রস্তাব দেন। সেই বিষয়েই আলাপ করতে টেলরকে ডেকে পাঠানো হয় ভারতে। মোটা অংকের স্পন্সরশিপের একটা টোপ গিলে ফেলেন টেলর।

তাঁর খুব বেশিকিছু করারও ছিল না। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট গেল ছয় মাসের কোন বেতনাদি দিতে পারেনি খেলোয়াড়দের। এমন এক পরিস্থিতিতে ১৫ হাজার ডলারের এক অর্থচুক্তি ফিরিয়ে দেওয়াও তো বেশ কঠিন। তাই টেলর হাজির হলেন ভারতে। পূর্ণ আলাপ আলোচনা সেরে ফেলতে।

আলাপ আলাচনা হলো বেশ। মোটামুটি একটা খসড়া কাঠামোও দাঁড় করিয়ে ফেললো দুইপক্ষ। এখন ফিরবার পালা। তার আগে শেষ রাতে এক জমকালো পার্টির নেমন্তন্ন। গেলেন টেলর। তাঁর ভাষ্যমতে, সেই ভারতীয় ব্যবসায়িকের কাছের লোকজন টেলরকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন ভয়ংকর মাদক ‘কোকেন’ গ্রহণ করার।

মদ্যপ টেলর কোনকিছু পর্যালোচনা না করেই সেই চ্যালেঞ্জ লুফে নেন। গ্রহণ করেন কোকেন। ব্যাস! তাতেই ফেঁসে যান টেলর। তাঁর কোকেন গ্রহণের ভিডিও ধারণ করে ফেলে ব্যবসায়ীর ঘনিষ্ঠরা ৷ আর সেই ভিডিও দেখিয়েই তাঁকে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করেন সেই ভারতীয় অজ্ঞাত ব্যবসায়ী।

টেলর বলেন, ‘পরদিন সকালে সেই লোক আমার হোটেল রুমে আসে এবং আমাকে কোকেন গ্রহণে ভিডিওটি দেখায়। তারপর তারা তা ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় যদি না আমি তাদের কথা মত আন্তর্জাতিক ম্যাচে স্পট ফিক্সিং করি। আমি রীতিমত ভয় পেয়ে যাই। তারা ছয়জন ছিল। আমি কোনমতে তাদের প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে ১৫ হাজার ডলার গ্রহণ করি। আমার পরিকল্পনা ছিল কোনমতে নিজেকে রক্ষা করা। তাই আমি সেই অর্থ নিয়ে ভারত ত্যাগ করি।’

এরপর মানসিক অস্বস্তিতে ভুগতে থাকেন ব্রেন্ডন টেলর। কি করবেন না করবেন তা ভেবে উঠতে না পেরে মানসিক দোটানায় পরে যান তিনি। এমনকি মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসাও করান বর্ষীয়ান এই ক্রিকেটার। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয়নি। কেননা সেই ভারতীয় ব্যবসায়ী তাকে ১৫ হাজার ডলার দিয়েছিলেন বিনিয়োগ হিসেবে।

তিনি টেলরকে চাপ প্রয়োগ করেই যাচ্ছিলেন তার সেই বিনিয়োগের লাভের জন্য। দারুণ এক মানসিক দোলাচল শেষে দীর্ঘ চার মাস পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসির শরণাপন্ন হন টেলর। এখানেই তিনি আরো একটি ভুল করে বসেন।

আইসিসি ফিক্সিং বিষয় বদ্ধ পরিকর। ফিক্সিং আইন অনুযায়ী একজন খেলোয়াড়কে প্রস্তাব পাওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব আইসিসিকে অবহিত করার নির্দেশ দেওয়া রয়েছে। অন্যথায় সেই খেলোয়াড়ও সমান দোষী হিসেবে গণ্য হবেন। ব্রেন্ডন টেলর যদিও স্বীকার করেছেন যে তিনি কোন ফিক্সিং এ অংশ নেননি।

এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি এটা স্পষ্ট করেই বলতে চাই যে আমি কোন ফিক্সিং এ অংশ নেইনি। আমি সম্ভবত অনেক খারাপ কোন ব্যক্তি হতে পারি কিন্তু আমি চিটার নই। ক্রিকেটের প্রতি আমার যে ভালবাসা তা আমাকে দেওয়া যেকোন হুমকির ঊর্ধ্বে।’

তবে দেরিতে আইসিসির শরণাপন্ন হওয়ার পেছনেও রয়েছে টেলরের ভিন্ন যুক্তি। তিনি বলেন, ‘আমি জানি আমি খুব দেরি করে আইসিসির কাছে বিষয়টি জানিয়েছি ৷ তবে আমি আসলে সবাইকে বাঁচাতে চেয়েছি, বিশেষ করে আমার পরিবারকে। আমি ভেবেছিলাম আইসিসিকে যদি আমি আমার ভয়ের কারণ এবং সার্বিক পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলি তাহলে হয়ত তাঁরা বুঝবেন। কিন্তু আফসোস তাঁরা বুঝলেন না।’

টেলরের ভাষ্য হয়ত আইসিসি বুঝতে পেরেছে কিংবা পারেনি। কিন্তু ফিক্সিং এর বিষয়ে আইসিসি বেশ কঠোর। এর আগে বাংলাদেশী অলরাউন্ডারকে শুধুমাত্র প্রস্তাবে বিষয়ে আইসিসিকে না জানানোর অপরাধে সব ধরণের ক্রিকেট থেকে এক বছরের নিষেধাজ্ঞা গ্রহণ করতে হয়েছিল ৷ এমন শাস্তিই হয়ত অপেক্ষা করছে ব্রেন্ডন টেলরের জন্য। তবে টেলর জানিয়ে দিয়েছেন যে তাঁর উপর এক বছরের বেশি সময়ের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এ বিষয়ে আইসিসির পূর্ণাঙ্গ বিবৃতি এলে বিস্তারিত জানা যাবে।

তবে নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে আবারো ক্রিকেটে ফিরতে টেলর বদ্ধপরিকর। তিনি তাঁর বিবৃতিতে আরো বলেছেন, ‘আমি নিজেকে সব ধরণের বাজে অভ্যাস থেকে সড়িয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট সংস্থার সাথে যোগাযোগ করেছি। আমি শীঘ্রই রিহেবিলিটেশন শুরু করবো। আর আমার পরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে আমার বন্ধু ও ভক্ত সমর্থকদেরর ধন্যবাদ। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে আমাকে বোঝার জন্য এবং আমার পাশে থাকার জন্য।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link