মাত্র ১:৩০ মিনিটের মাথায় ডি-বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া এক শটে গোল করে বসেন আনসু ফাতি। আর এতেই তিনি বনে যান উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা। ১৭ বছর ৪০ দিন বয়সে ইতালিয়ান ক্লাব ইন্টার মিলানের দূর্গ স্যান সিরোতে এমন রেকর্ড করে বসেন ফাতি।
৩১ নম্বর জার্সি পড়ে ম্যাচের ৮৪ মিনিটে মাঠে নামেন কিশোর ফুটবলার। পৃথিবীর ফুটবল ইতিহাসে বিশেষ করে ক্লাব ফুটবলের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ক্লাব বার্সেলোনার হয়ে। প্রতিপক্ষের সাথে তখন ১-১ গোলের সমতা বিরাজমান। এমন এক ম্যাচে জয়সূচক গোলটি করে তিনি যে বড় এক তারকা হতে চলেছেন তাঁর ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন ফাতি।
বেশ সম্ভাবনাময়ী এই তরুণ খেলোয়াড় বার্সাকে নতুন দিনের আলো দেখাচ্ছিলো। ভবিষ্যৎ দিনের কাতালান ক্লাবটির পোষ্টার বয়ের তকমা যেন ছিলো একেবারেই অবধারিত। তবে ২০১৯ এ যখন তাঁর অভিষেক ঘটে তখনও দলের সেরা খেলোয়াড় এবং পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু লিওনেল মেসি। সবাই স্বপ্ন বুনতে লাগলেন মেসি পরবর্তী সময়ে ফাতিই ধরবেন বার্সার হাল। সেই স্বপ্নে যেন আঘাত দিতে শুরু করেছে ইনজুরি নামক ভয়ংকর দানব।
২০১৯/২০ মৌসুমে লা-লিগা ও চ্যাম্পিয়নস লিগ মিলিয়ে মোট ২৯ ম্যাচ খেলেছিলেন আনসু ফাতি। গোল করেছিলেন আটটি। কিন্তু গত সিজন অর্থাৎ ২০২০-২১ সিজনে মাত্র ১০টি ম্যাচ খেলতে পেরেছেন তরুণ এই তুর্কি। স্প্যানিশ লিগের ক্লাব রিয়াল বেটিসের সাথে ম্যাচে হাঁটুর ইনজুরিতে পড়েন ফাতি।
সেই থেকেই শুরু। সেই হাঁটুর ইনজুরির কারণে তাঁকে মুখোমুখি হতে হয়েছে অস্ত্রপচারের। সেড়ে ওঠার সম্ভাব্য সময় চার মাস হলেও তা নানা জটিলতায় বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় দশ মাসে। ব্যাস! সেখানেই শেষ ফাতির ক্যারিয়ারের একটি মৌসুম।
সেই ইনজুরি কাটিয়ে ধীরে ধীরে প্রত্যাবর্তন করতে শুরু করেন ফাতি। নতুন এক গুরু দায়িত্বও এসে যায় তাঁর কাঁধে। দলের প্রাণ ভোমরা লিওনেল মেসির ফেলে যাওয়া ‘১০’ নম্বর জার্সিটির মালিক বনে যায় ১৯ বছরের তরুণ আনসু ফাতি। যেই জার্সি গায়ে জড়িয়ে পুরো মাঠে প্রতিপক্ষকে খাবি খাইয়েছে রিভালদো, রোনালদিনহো, মেসিরা সেই জার্সি এখন তাঁর শরীরে।
কি এক রোমাঞ্চ! রোমাঞ্চের সিড়ি বেয়ে খুব বেশি দূর উঠতে পারলেন না ফাতি। হানা দিলো ইনজুরি। কোপা ডেল রে-এর ম্যাচে অ্যাতলেটিক ক্লাব বিলবাও এর বিপক্ষে হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে পড়েন তিনি। স্বপ্ন যাত্রায় আবার এলো বাঁধা। বার্সার মেডিকেল কর্তারা জানিয়েছেন ফাতিকে আবারো যেতে হতে পারে অপারেশন টেবিলে।
কিন্তু আগের অভিজ্ঞতা থেকে আনসু ফাতি এবং তাঁর পরিবার চিন্তায় আছেন আরো একটি অপারেশন করাবেন কিনা। তাঁদের পরিকল্পনায় রয়েছে সনাতন পদ্ধতিতে ইনজুরি কাটিয়ে ওঠার টোটকা। এর মূল কারণ এ বছরের শেষেই তো অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ ফুটবল বিশ্বকাপ।
বিশ্বকাপে খেলার হাতছানিকে অবহেলা করা যে বড্ড কঠিন। কিন্তু এই সনাতন পদ্ধতিতে কিংবা ঘরোয়া পদ্ধতি যে যাই বলুক না কেন এর যে বিপরীত এক দিক রয়েছে। হয়ত ফাতি দ্রুতই আবার ফুটবল মাঠে ফিরবেন কিন্তু ফাতি কি আগের ফাতি হয়েই ফিরবেন কিনা সে নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কারণ উদাহরণ তো খোদ বার্সাই স্বচোক্ষে দেখেছে।
স্যামুয়েল উমতিতি ২০১৮ বিশ্বকাপের আগে সে সময়ের অন্যতম তরুণ ডিফেন্ডারদের একজন হিসেবেই গন্য হতেন। বিশ্বকাপের খুব কাছাকাছি সময়ে ইনজুরিতে পড়েছিলেন উমতিতি। তিনি সে সময় অস্ত্রোপচার করতে অস্বীকৃতি জানান।
কেননা আর বাকি সবার মতোই তিনি বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি। তিনি খেলেছিলেন এবং জিতেছিলেন বিশ্বকাপ। কিন্তু তারপর সেই বিধ্বংসী রুদ্রপ্রাচীর উমতিতি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। সে বিষয়ে উমতিতি অবশ্য পরে আক্ষেপও প্রকাশ করেছেন। তবে সময় গেলে কি আর সাধন হয় কিছু?
সে যাই হোক বার্সা হয়ত ফাতিকে নিয়ে এমন নেতিবাচক কোন ভবিষ্যতের চিন্তা করছে না। কিন্তু এমন ঘটনার পুনঃরাবৃত্তিও তো ঘটতে দেওয়া যায় না। সে সব কিছুই এখন ভেবে দেখছেন বার্সেলোনার ডাক্তাররা। তবে ডাক্তারদের কথা মেনে অপারেশন যদি করিয়ে ফেলেন ফাতি তাহলে নিশ্চিতরুপেই তাঁর মৌসুম শেষ।
কিন্তু, এভাবে আর কতদিন! এমন দোটানায় তো আর একজন সম্ভাবনাময়ীকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না। অন্তত ক্লাব কিংবদন্তি ও বর্তমান কোচ জাভি তা চাননা। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন ফাতির জন্যে সম্পূর্ণ আলাদা এবং সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা সাজাবো, যাতে করে সে বারবার ইনজুরি আক্রান্ত না হয়। আমাদের তাঁকে দরকার। শারীরিকভাবে তাঁকে সুস্থ করে তোলার পাশাপাশি তাঁকে মানসিক ভাবেও ইনজুরিমুক্ত করাই আমাদের পরিকল্পনার অংশ।’
বার্সেলোনা সর্বকালের সেরাদের সেরা লিওনেল মেসির ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছিলো। মেসি তাঁর ক্লাব ক্যারিয়ারের শুরুরদিকে বেশ ইনজুরি প্রবণ একজন খেলোয়াড় ছিলেন। সেখান থেকে ক্লাব তাঁর ডায়েটে হস্তক্ষেপ করে ও তাঁকে সুস্থ জীবন যাত্রায় উদ্বুদ্ধ করে। যার ফলাফল সবারই জানা। ইনজুরি প্রতিরোধী হয়ে পরবর্তী সময়ে মেসি পুরো বিশ্বফুটবলে রাজত্ব করেছেন। এমন কোন পদক্ষেপ হয়ত ফাতির ক্ষেত্রেও নিতে পারে বার্সেলোনা। তাতে মন্দ হয় না৷
তবে তরুণ ফাতি বেশ আত্মবিশ্বাসী ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে তিনি আবার ফিরবেন এবং নিজের স্বরুপেই ফিরবেন। এমনটা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইন্সট্রাগ্রামে ফাতি লিখেছেন, ‘দূর্ভাগ্যবশত, আমাকে ফুটবলের সবচেয়ে বাজে অংশের মোকাবেলা করতে হচ্ছে, তবে আমি কখনোই হাল ছেড়ে দেবো না।’ এই হাল ছেড়ে না দেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ই ফাতিদের একদিন ফুটবল আকাশের ধ্রুবতারায় পরিণত করে। আর অনুজদের জন্যে রেখে যায় শত বাঁধা পেরিয়ে আকাশ ছুঁয়ে দেখার দৃষ্টান্ত।