২৯ জানুয়ারি; ১৯৯৮। এই তারিখটার কথা মনে আছে?
না, খুব বিশেষ কিছু নয়। একটা ক্রিকেটীয় ঘটনা আছে এই দিনে। আপনি যদি ক্রিকেটের খুব নিবিঢ় অনুসরণকারী হয়ে থাকেন, তাহলে হয়তো মনে করতে পারবেন, এই দিনে ‘জ্যামাইকা তামাশা’ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। নতুন বসানো ভয়ঙ্কর উইকেটের কারণে ১০.১ ওভার খেলার পরই সেদিন পরিত্যাক্ত হয়ে গিয়েছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ইংল্যান্ডের জ্যামাইকা টেস্ট।
এই তো; এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। এই দিনটায় এমন কোনো ডন ব্র্যাডম্যানের জন্ম হয়নি, শচীন টেন্ডুলকার কোনো বিষ্ময়কর ইনিংস খেলেননি; কিংবা ওয়াসিম কোনো জাদুকরী স্পেল বল করেননি। ফলে এই দিনটা আপনার আমার মনে রাখাটা খুব জরুরী নয়। কিন্তু এই দুনিয়ায় একজন মানুষ আছেন, তিনি এই দিনটা কখনোই ভুলতে পারবেন না।
মানুষটার নাম ডিন ওয়ারেন হেডলি। হ্যা, স্যার জর্জ হেডলির নাতি এবং রন হেডলির ছেলে ডিন হেডলি।
১৯৯৮ সালের এই দিনটা হতে পারতো ডিন হেডলির জীবনের সবচেয়ে বড় দিন। হতে পারতো যে, এই দিনে তিনি বাবা এবং দাদার নামের উচ্চতায় তুলে নেবেন নিজেকে। অন্তত তেমন কিছুর জন্যই প্রস্তুত ছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্যাবাইনা পার্ক। তেমন কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলো জর্জ হেডলি প্যাভিলিয়ন। কিন্তু কিছুই হয়নি। হয়েছে এক ট্রাজেডি। সেই ট্রাজেডির গল্পই শোনা যাক।
আচ্ছা, তার আগে ডিন হেডলির পরিচয়টা একটু বুঝিয়ে বলা যাক।
ডিনের দাদা জর্জ হেডলি সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। জর্জ আলফোনসো হেডলিকে জ্যামাইকার লোকেরা আদর করে ‘ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান’ বলতো। আর ভক্তরা চটে গিয়ে ব্র্যাডম্যানকে ‘হোয়াইট হেডলি’ বলতো। সে আপনি যাই বলুন, পরিসংখ্যানই স্বাক্ষ্য দেয় হেডলি কেনো সর্বকালের সেরাদের একজন ছিলেন।
২২ টেস্টে ৬০.৮৩ গড়ে ২১৯০ রান করেছেন ১৯৩০ থেকে ১৯৫৪ সালের মধ্যে। প্রথম শ্রেনীর ক্যারিয়ারও ছিলো দুর্দান্ত। প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে ৯৯২১ রানের পাশাপাশি ৫১টি উইকেটও আছে।
জর্জ হেডলির পূত্র রন হেডলি অবশ্য এতোটা সুযোগ পাননি। ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতেন ইংল্যান্ডে। কাউন্টিতে টানা ১৫ মৌসুমের মধ্যে ১৩ মৌসুমে এক হাজারের ওপরে রান করেছেন। উস্টারশায়ারের হয়ে এই দূরন্ত ক্যারিয়ারের ছিটেফোটাও ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে দেখাতে পারেননি। জাতীয় দলের হয়ে দু’টি টেস্ট ও একটি ওয়ানডে খেলেছেন।
রন সপরিবারেই এরপর ইংল্যান্ডে আবাস গেড়ে ফেলেন। আর এখানেই জন্ম নেন ও বড় হয়ে ওঠেন ডিন হেডলি। তিনিও আস্তে আস্তে ক্রিকেটার হয়ে ওঠেন। তবে মজার ব্যাপার হলো কিংবদন্তী দুই ব্যাটসম্যানের বংশধর ডিন ব্যাটসম্যান না হয়ে হলেন ফাস্ট বোলার। ডিন ক্যারিয়ারের শুরুতেই মার্ভ হিউজের সঙ্গে তুলনা পেলেন। তাকে ইংল্যান্ডের ভবিষ্যত বলেই মনে করা হচ্ছিলো।
১৯৯৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক। অভিষেকে দূরন্ত বল করলেন। জায়গাটা পাঁকাই মনে হচ্ছিল। ১৯৯৮ সালে যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গেলেন, তখন তার সামনে লম্বা ক্যারিয়ার। আর সেই ক্যারিয়ারে একটা মাইলফলক হয়ে থাকার কথা ছিলো স্যাবাইনা পার্কের টেস্টটা। কিন্তু সেটা হয়ে গেলো ট্রাজেডি।
এই টেস্ট নিয়ে রীতিমতো কাব্য করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সবাই। নিজের দেশের বিপক্ষে নিজের পূর্বপুরুষের ভূমিতে টেস্ট খেলতে এসেছেন ডিন হেডলি। বল করবেন দাদার নামে নামকরণ করা প্রান্ত থেকে। মানে, মঞ্চ পুরোপুরি প্রস্তুত। বুকের ভেতর এই আবেগ নিয়েই খেলা শুরু করেছিলেন ডিন। কিন্তু সেই খেলা আর হলো কই!
টসে জিতে আগে ব্যাট করতে গেল ইংল্যান্ড। আর মুহূর্তেই তারা টের পেলো, উইকেট নয়, বোমার ওপর দাড়িয়ে আছে ব্যাটসম্যানরা। বল অদ্ভুত আচরণ শুরু করলো। নতুন বসানো উইকেটে একটা বল মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়, একই লেন্থে পড়ে পরের বল বুকে আঘাত করে এবং তৃতীয় বল গোড়ালির নিচ দিয়ে গড়িয়ে যায়। মাত্র ১০.১ ওভার খেলা হলো। এর মধ্যে ইংল্যান্ড ৩ উইকেট হারিয়ে ফেললো। তার চেয়ে ভযঙ্কর হলো এর মধ্যে ৬ বার ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের সুশ্রসা করতে মাঠে যেতে হলো ফিজিওকে। বল শরীরে লাগলো অন্তত ১৩ বার।
এই অবস্থায় এখানে খেলায় আপত্তি করলো ইংল্যান্ড। ম্যাচ রেফারিও বুঝতে পারলেন, খেলা চালানো বিপজ্জনক হবে। ফলে ওখানেই শেষ হয়ে গেলো জ্যামাইকা টেস্ট।
এই টেস্টকে আস্তে আস্তে সবাই ভুলে গেলো। কিন্তু ডিন হেডলি ভুলতে পারলেন না। কারণ, এখান থেকে ফেরার পর ইনজুরি তাকে জেকে ধরলো। আস্তে আস্তে ইংল্যান্ড দলেই অনিয়মিত হয়ে গেলেন। ১৫ টেস্টে ৬০ উইকেটের ঈর্ষনীয় পরিসংখ্যান নিয়ে শেষ হয়ে গেলো ডিনের ক্যারিয়ার।
শেষ টেস্ট যখন খেলেন বয়স তখন মাত্র ২৭। এই সময়ে তিনি প্রতি ৫০.৪০ বলে একটি করে উইকেট নিয়েছেন। এই স্ট্রাইক রেট স্যার রিচার্ড হ্যাডলি, জোয়েল গার্নার, মাইকেল হোল্ডিং, ওয়াসিম আকরাম, ডেনিস লিলি, ইমরান খান কিংবা কার্টলি অ্যামব্রোসের চেয়ে কম। মাত্র ৩০ বছর বয়সে অবসরে যান, পিঠের ইনজুরি তাঁর ক্যারিয়ারটা বড় হতে দেয়নি।
এটা অবশ্যই আফসোস। তবে, সবচেয়ে বড় আফসোস – সেই জ্যামাইকাতে আর কখনোই বল করা হলো না হেডলির। আর কখনোই রোমান্টিক কাব্যটা ফিরে এল না।