রেলওয়ের একজন সাধারণ টিকিট চেকার থেকে পরবর্তীতে বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক হওয়ার গল্পতো সবার জানা। রুপালি পর্দায় তুলে ধরা হয়েছিল ভারতীয় অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির সেই সংগ্রামের দিনগুলোর কথা। তবে রেলওয়ের চাকরি থেকে ক্রিকেটে আসার উদাহরণ এরও বহু আগে ঘটেছে এই উপমহাদেশে। সেটা করেছিলেন পাকিস্তানের একজন ক্রিকেটার ডানকান শার্প।
ডানকান শার্প, নামটার সাথে পাকিস্তানের ক্রিকেটের সম্পর্ক রয়েছে এমন বক্তব্যে হয়ত অনেকে ভ্রু ইতোমধ্যে কুঁচকিয়ে ফেলেছেন। হ্যাঁ, তিনি পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলে খেলা একজন খেলোয়াড়। অবশ্য তিনি একমাত্র নন। খ্রিষ্টান ক্রিকেটার হিসেবে তিনি তৃতীয়। আর এখন অবধি সাত জন অমুসলিম ক্রিকেটার খেলেছেন পাকিস্তানের হয়ে। তবে আজকে গল্পের প্রধান চরিত্র ডানকান শার্প।
ডানকান শার্পকে ঠিক ইংরেজ বলা যাবে নাকি পাকিস্তানি সে এক চিন্তার বিষয়। তিনি মূলত একজন অ্যাঙলো-ইন্ডিয়ান। আসলে ইংরেজ চলে গেলেও, তাঁরা উপমহাদেশে স্মৃতিচিহ্ন রেখে গিয়েছিল। দেশভাগের পরও তাই অনেক ইংরেজ রয়ে গিয়েছিল উপমহাদেশে। এদের বলে অ্যাঙলো ইন্ডিয়ান। এদের অধিকাংশই ছিল আসলে ভারতে, গুটিকয়েক ছিল পাকিস্তানে। তেমনই এক পরিবারের ছেলে হলেন শার্প।
ডানকানের পরিবার ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ব্রিটিশ ইন্ডিয়াতে চলে আসেন। এসে উপমহাদেশের পরবর্তীতে হওয়া পাকিস্তান অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। ডানকানের জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে ১৯৩৭ সালের ৩ আগস্ট। তবে তাঁর বেড়ে ওঠা পাকিস্তানের আরেক শহর লাহোরে। তাঁর মা ছিলেন একজন নার্স। তাঁর চাকরিসূত্রেই মূলত লাহোরে শৈশব কেটেছে তাঁর।
তবে খুব যে একটা সুখী পরিবারের সন্তান ছিলেন ডানকান তা কিন্তু নয়। বাবা মা’র বিচ্ছেদের পর তাদের তিন ভাইয়ের ঠিকানা হয় লাহোরের এক বোর্ডিং স্কুল। সেখান থেকেই জীবনে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার মূলমন্ত্র খুঁজে পান ডানকান শার্প। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই তিনি পাকিস্তান রেলওয়েতে একজন কেরানী পদের চাকরি নেন। চাকরি-সূত্রেই ক্রিকেটে আসার সুযোগটা মূলত পেয়েছিলেন ডানকান।
১৯৫৫-৫৬ সালের দিকে তিনি নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শুরু করেন। প্রথম শ্রেণির ম্যাচে একজন মিডেল অর্ডার ব্যাটার হিসেবে সফরকারী মেলবর্ন ক্রিকেট ক্লাবের বিপক্ষে রেলওয়ে ও বেলুচিস্তানের হয়ে খেলেছিলেন ডানকান। ১৯৫৭-৫৮ সালে তিনি কায়েদ এ আজম টুর্নামেন্টে অংশ নেন পাঞ্জাবের হয়ে। এরপর কপালটা বোধহয় খুলতে শুরু করেছিল ডানকানের।
ডাক পেয়ে যান পাকিস্তান ঈগলস দলে। প্রথম সফরে চলে যান সুদূর ওয়েস্ট ইন্ডিজে। সেখানে খেলার সুযোগটা পাননি তিনি। ছিলেন দ্বাদশ খেলোয়াড়। তবে তিনি যে জাতীয় দলের খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলেন, তা হয়ত তিনি বুঝতে শুরু করেছিলেন। সেজন্য অবশ্য তাঁকে নয়টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়েছে। নয় ম্যাচে তাঁর মোট রান ছিল ২৫৫, গড় ২১.২৫। সর্বোচ্চ ৬৭ রানের একটি ইনিংস খেলে তিনি ডাক পেয়ে যান জাতীয় দলে।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৯৫৯ সালে তাঁর অভিষেক হয়। অভিষেক ম্যাচে পাঁচ নম্বরে ব্যাটিং করতে নেমে তিনি ৫৬ ও ৩৫ রানের দু’টি ইনিংস খেলেন। যা কিনা ছিল দলের সর্বোচ্চ। স্বপ্ল রানের ম্যাচে হার এড়ানোর কোন উপায় ছিল না পাকিস্তানের। পাকিস্তানে ভাগ্যের মতোই নিজের ভাগ্যটা পরবর্তী দুই ম্যাচে আর ফেরাতে পারেননি ডানকান। পরবর্তী সময়ে তিনি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নিজের প্রথম সেঞ্চুরি করেন ডানকান শার্প। ইন্ডিয়া স্কার্লেটে বিপক্ষে সেই শতক পেয়েছিলেন তিনি।
এরপর আইয়ুব ট্রফির সেমিফাইনালে রাওয়ালপিন্ডির বিপক্ষে তিনি খেলেছিলেন দুর্দান্ত ১০৯ রানের একটি। পারফর্ম করার পরও তিনি ছিলেন অবহেলিত। পাকিস্তান জাতীয় দলে অজানা কারণে তিনি খুব একটা সুযোগ পেতেন না। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন নাগরিকত্ব বদলে ফেলে ক্রিকেট খেলবেন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে।
তিনি তাই করে বসলেন। সে বিষয়ে অবশ্য তাঁকে অর্থ কড়ি এবং বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটার ব্যারি জারমান। তিনি শেফিল্ড শিল্ড টুর্নামেন্টে অংশ নেন দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার হয়ে। প্রথম ম্যাচেই তিনি দেখা পান অর্ধ-শতকের। সেখানে তিনি ব্যাট চালাতে থাকেন আপন ছন্দে। তবে খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি তাঁর প্রথম শ্রেণি ক্রিকেট ক্যারিয়ার। সমাপ্তি ঘটে ১৯৬৬ সালে।
আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটে তিনি মাত্র তিনটি ম্যাচ খেলেছিলেন পাকিস্তানের হয়ে। তাছাড়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাঁর খেলা ম্যাচের সংখ্যা ৩৭। ১৫০০ রানের পাশাপাশি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাঁর নামের পাশে রয়েছে দুইটি শতক ও সাতটি অর্ধ-শতক। নিজের ক্যারিয়ারটা খুব বেশি সুদীর্ঘ করার আফসোস হয়ত এখনও করেন ডানকান শার্প। এই শেষ বয়সে এসে নিশ্চয়ই নিজের ক্যারিয়ারের স্মৃতিগুলো তাঁর ঠোঁটে মৃদু হাসির উদ্ভব ঘটায়।