ইনিংসের ৫০ তম ওভার। চার্ল ল্যাঙ্গেভেল্টের বল ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টের দিকে ঠেলে দিয়ে দ্রুত প্রান্ত বদল। ‘দ্য গড অব ক্রিকেট’ নিজের দু’হাত উঁচু করে কৃতজ্ঞতা জানালেন এই বিশ্বভ্রমাণ্ডের সৃষ্টিকর্তাকে। আর অন্যদিকে, ইতিহাসের পাতায় লেখা হলো নতুন ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসের পাশে লেখা হলো শচীন রমেশ টেন্ডুলকারের নাম। তিনি ক্রিকেটের দেবতা, এই রেকর্ডে তাঁর নামটাই সবচেয়ে ভাল মানায়।
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০, ভারতের গোয়ালিওরে দক্ষিণ আফ্রিকাকে আতিথেয়তা দিচ্ছিলো ভারত। ওয়ানডের সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে তাঁদেরকে একটু অন্যভাবে আপ্যায়নের পরিকল্পনা মাথায় এঁটে নিয়েছিলেন শচীন টেন্ডুলকার। তাঁর সেই পরিকল্পনায় সম্মতি জানিয়ে অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তবে শুরুতেই ধাক্কা খেয়ে যায় ভারত। দলের অন্যতম মারকুটে ওপেনার বীরেন্দ্র শেবাগকে অল্প রানেই ফিরতে হয় প্যাভিলিয়নে।
তাতে বোধকরি সেদিন শচীনের বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ ছিল না। তিনি নিজের পরিকল্পনায় ছিলেন অনড়। জুটি বেঁধে রান করতে থাকলেন দীনেশ কার্তিকের সাথে। যুক্ত করেন ১৯৪ রান। তবে রানের বিচারে শুধু সেদিনের শচীনকে বর্ণনা করা যাবে না। সেদিনের শচীনে ঐশ্বরিক কোন শক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। নিজেকে সেদিন ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন ‘লিটল মাস্টার’।
সেই ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু করা ক্যারিয়ারটা নানান রেকর্ডে পরিপূর্ণ করেছেন শচীন টেন্ডুলকার। ২০১০ সালের আগের একটা রেকর্ড করাই বাকি ছিল, সেটা ওয়ানডে ক্রিকেটে দ্বি-শতক করার। অবশ্য তাঁর আগে ছেলেদের ক্রিকেটে সেই রেকর্ডটাই হয়নি। ১৯৯৭ সালে মেয়েদের বিশ্বকাপে বেলিন্ড ক্লার্ক দ্বিশতকের রেকর্ডটা করেছিলেন। ছেলেদের ক্রিকেটে তখনও এমন রেকর্ডের পাতাটা খালি পড়ে রয়েছিল।
দক্ষিণ আফ্রিকার দারুণ এক বোলিং লাইন আপের বিপক্ষে গোয়ালিওরে সেদিন শচীন খালি থাকা পাতাটা আর খালি রাখতে চাননি। মাত্র ৯০ বলে তিনি তুলে নেন সেঞ্চুরি। প্রোটিয়া বোলারদের বিন্দুমাত্র পাত্তা দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না তাঁর। শতক করেই নিজের ব্যাটিং এর ধাঁচ পুরো ৩৬০ ডিগ্রি বদলে ফেললেন। যতটুকু সমীহ করছিলেন প্রোটিয়া বোলারদের তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বেদম মার মারতে শুরু করেন শচীন।
১১৮ বলে পৌঁছে গেলেন ১৫০ রানে। মাঝে অবশ্য তাঁর দীর্ঘক্ষণের সঙ্গী দীনেশ কার্তিককে হারান। খানিকক্ষণ উপভোগ করেন ইউসুফ পাঠানের মারকাটারি ব্যাটিং। নিজেকে তখনও শান্ত রেখেছিলেন শচীন। চাপমুক্ত থাকতে চেয়েছিলেন। ১৫৬ এর বেশি স্ট্রাইকরেটে ইউসুফ পাঠানের ব্যাটিং উপভোগ করে নিজেকে আরো বেশি সংযত রাখতে চেয়েছিলেন তিনি।
ধীরচিত্তে স্বভাবচারিত ব্যাটিংটাই করে যেতে থাকেন শচীন। পাঠানের বিদায়ের পর তাঁকে সঙ্গ দিতে নামেন অধিনায়ক ধোনি। দুইজন জুঁটি বেঁধে দলের রান যেমন বাড়াতে থাকেন তেমনি নতুন এক রেকর্ডের দিকে এগোতে থাকেন লিটল মাস্টার। সে জন্য অপেক্ষা করতে হয় ইনিংসের শেষ ওভার অবধি। দলকে সুবিধাজনক এক জায়গায় আবিষ্কার করে ধোনিও সপাটে চালিয়েছেন তাঁর ব্যাট। ৩৫ বলে ৬৮ করেছিলেন ‘ক্যাপ্টেন কুল’।
মাহেন্দ্রক্ষণের খুব কাছে শচীন। ৪৯.৩ তম বল ল্যাঙ্গেভেল্ট ছুঁড়ে দিলেন শচীনের উদ্দেশ্যে। ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টের দিকে বল অগ্রসর হয়, আর শচীন অপরপ্রান্তের দিকে। আর কমেন্ট্রি বক্সে থাকা রবি শাস্ত্রীর উল্লাসের চিৎকার। ‘দ্যা ফার্স্ট ম্যান অন দ্য প্ল্যানেট টু রিচ ২০০ এন্ড ইট ইস দ্য সুপারম্যান ফ্রম ইন্ডিয়া, শাচীন টেন্ডুলকার ২০০ ফ্রম ১৪৭, টেক অ্যা বাও।’
ইতিহাসের একটা পাতা আর খালি রাখলেন না শচীন টেন্ডুলকার। নিজের নামটি স্বর্ণালী অক্ষরে লিখিয়ে নিলেন। ক্রিকেটের ইতিহাসের প্রথম পুরুষ ক্রিকেটার হিসেবে তুলে নিলেন ২০০ রান, তাও আবার ওয়ানডে ফরম্যাটে। তিনি পথ দেখিয়ে দিলেন। ওয়ানডেতেও যে ২০০ রান করা যায় সে তথ্যটা ছড়িয়ে দিলেন বিশ্বদরবারে। এরপর শচীনের দেখানো পথ অনুসরণ করে আরো সাতবার ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন।
এর মধ্যে ভারতীয় ক্রিকেটাররাই করেছেন চারবার। বর্তমান ভারত দলের অধিনায়ক রোহিত শর্মা তো আবার এক ধাপ এগিয়ে তিনি ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন দুইবার। তবে শচীনের আজ থেকে প্রায় এগারো বছর আগে করা ডাবল সেঞ্চুরির মাহাত্ত্ব শব্দজালে আটকে ফেলা কঠিন।
শচীন সেদিন শচীন সুলভ ইনিংস খেলেছিলেন। মেরেছিলেন ২৫টি চার। বাড়তি ঝুঁকির বিন্দুমাত্র ইচ্ছে যেন ছিল না তাঁর। দারুণ টাইমিংয়ে বল হাওয়ায় ভাসিয়ে মাঠ ছাড়া করেছিলেন মাত্র তিনবার। সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন অবশ্যই শচীনের ব্যাটিং এর পর তাঁর রানিং বিটুইন দ্যা উইকেট। নতুবা ১৪৭ বলে মাত্র তিনটি ওভার বাউন্ডারির বদৌলতে ২০০ রান করা যেত কিনা সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
তবে এই একটি ডাবল সেঞ্চুরি শচীনের রেকর্ডের মুকুটে যুক্ত করেছেন আরো একটি পালক। সেই পালক আরো বেশি সুসজ্জিত করেছে ক্রিকেটের মহারাজার মুকুট। যে মহারাজার রাজত্ব হয়ত ক্রিকেটে থাকবে চিরকাল অমলিন।