‘ফরম্যাট ম্যাটার করেনা, গুড টাচে থাকা ম্যাটার করে।‘- গতকাল ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে লিটন দাস কথাটা বলছিলেন। সত্যিই তো। গত কয়েক মাসে লিটন যেখানে, যেভাবে, যে ফরম্যাটেই খেলেছেন রান করেছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কিংবা ফ্র্যাঞ্চাইজি লিটন তাঁর ব্যাটিংটাকে নেক্সট লেভেলে নিয়ে যেতে পেরেছেন। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি লিটন নিজের উইকেটের মূল্যটা বুঝেছেন।
গতবছর নভেম্বরে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচ। চট্টগ্রামে লিটন টেস্ট ক্যারিয়ারে নিজের প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পেলেন। লিটনের মত ক্লাসিক, এলিগেন্ট ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরি পাওয়া মানে শুধু সেই ম্যাচের জন্যই সস্তি নয়। বরং সেই সেঞ্চুরিটা জানান দেয়, ব্যাটসম্যান লিটন ফর্মে আছেন।
তবে লিটনের ক্ষেত্রে সেই সস্তিটা কাজ করছিল না। কেননা এই ব্যাটসম্যান গত ছয়-সাত বছরে বাংলাদেশের হয়ে দারুণ কয়েকটি ইনিংস খেলেছেন। তবে সবগুলোই বিচ্ছিন্ন ভাবে। ফলে লিটন আসলেই ফর্মে ফিরলেন কিনা সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছিল। যদিও টেস্টে অনেকদিন ধরেই টুকটাক রান করে যাচ্ছিলেন। ফলে অন্য ফরম্যাটে গেলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে সেই শঙ্কাও ছিল।
তবে গত তিন-চার মাসে লিটনের ব্যাটে বিশাল এক বিপ্লব দেখা গেল। এই সময়টাতে লিটন কখনো মিরপুরের মন্থর উইকেটে খেলেছেন, কখনো আবার মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের পেসবান্ধব উইকেটে খেলেছেন। কখনো টেস্ট খেলেছেন, কখনো আবার ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি তবে লিটনের ব্যাটের সেই ছুটে চলা থামেনি। বিশ্ব তাকিয়ে দেখল কী করে লিটনের ব্যাটটা হঠাত করেই তরবারি হয়ে উঠলো।
তবে এই কাজটা লিটন করতে পারেন সেই বিশ্বাসটা এই ক্রিকেট দুনিয়ার সবার ছিল। লিটন বিচ্ছিন্ন ভাবে হলেও দেখিয়েছেন তাঁর ব্যাটে কী জাদু আছে, কী শিল্প আছে, কী এক মোহ আছে। ফলে লিটন ব্যাট হাতে এমন ছড়ি ঘুরাবেন সেটাই প্রত্যাশিত ছিল। ব্যাট হাতে গত কয়েকমাসে লিটনের বিপ্লবটা সবাই দেখেছে। তবে যেটা চোখের আড়ালে থেকে গিয়েছে সেটা হলো লিটনের মনস্তাত্বিক বিপ্লব।
লিটন তাঁর ভাবনার জগতে বিরাট একটা পরিবর্তন আনতে পেরেছেন। ব্যাটসম্যান লিটন যে বিশ্বক্রিকেটের জন্যই কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা তিনি বুঝে ফেলেছেন। নিজের উইকেটের মূল্যটা যে কত বেশি সেটাও এখন তিনি জানেন। ব্যাট হাতে লিটনের কারুকাজটা স্বভাবজাত ভাবেই ছিল, এবার মস্তিষ্কের কারুকাজটা পুরোদমে যোগ হয়েছে।
ফলে এই লিটনকে আপনি টেস্ট, টি-টোয়েন্টি, ঢাকা, চট্টগ্রাম, মাউন্ট মঙ্গানুই যেখানেই ফেলে দিবেন সে রান করে আসবে। যেমন লিটন গতকাল বলছিলেন, ‘আপনি যদি ভালো টাচে থাকেন যেকোন সংস্করনই সহজ হয়ে যায়।‘ লিটনের জন্য এখন আসলে ক্রিকেটটাই সহজ হয়ে গিয়েছে। এই লিটনের এখন শুধু ছুটে চলা বাকি।
এখন প্রশ্ন হতে পারে লিটন এই কাজটা গত সাত বছর করতে পারেননি কেন? কিংবা এই ফর্ম যে আবার থেমে যাবেনা তাঁরই বা নিশ্চয়তা কী? নিশ্চয়তা অবশ্যই নেই। তবে ক্রিকেটের খুব চিরায়িত একটা কথা আছে, ফর্ম ইজ টেম্পরারি বাট দ্য ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট।’
লিটন আসলে এখন নিজের ক্লাসটা বুঝতে পেরেছেন। ফলে তাঁর থেমে যাওয়াটাই বরং কঠিন।
ক্যারিয়ারের শুরু থেকে লিটনের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল ইনিংসের শুরুটা। নিজের প্রথম ১৫-২০ লিটন বেশ সেকি থাকেন। তবুও তিনি ওই সময়টায় এতদিন জোর করে বাউন্ডারি মারার চেষ্টা করেছেন। তবে এখন আর লিটন সেটা করছেন না। নিজেকে ক্রিজে সময় দেন। কারণ তিনি জানেন একবার সেট হয়ে গেলে লিটন বাইশ গজে যেকোন কিছু করতে পারেন।
শুধু বলার জন্য বলা না, সত্যিই যেকোন কিছু করতে পারেন। যেমন ওয়ানডেতে লিটন ৫০ টি ইনিংস খেলেছেন। যার মধ্যে ২৫ রান পার করতে পেরেছেন মাত্র ১৫ ইনিংসে। অর্থাৎ শুরুর কঠিন সময়টায় তিনি নিজের উইকেট দিয়ে দিচ্ছিলেন। অথচ একবার সেই সময়টা কাটিয়ে ফেললে লিটন ক্রিকেট দুনিয়ারই সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাটসম্যানদের একজন।
কারণ যেই ১৫ ইনিংসে তিনি ২৫ পার করেছেন সেগুলোতে তাঁর ব্যাটিং গড় ৮০ এর উপরে। অর্থাৎ একবার শুরুর সময়টা পার করতে পারলেই তিনি বড় ইনিংস খেলেছেন। যেমন নিজের ৯টি পঞ্চাশ পার করা ইনিংসের ৫টি কেই সেঞ্চুরি বানিয়েছেন। এরমধ্যে একটি বিশ্বকাপে ৯৪ রানের অপরাজিত ইনিংসও আছে। এই সংখ্যাগুলোই বলে দেয় এই লিটনকে থামানো কী কঠিন।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করার পর সংবাদ সম্মেলনে এসে লিটন বলেছিলেন, ‘আমি আমার ব্যাটিংটা নিয়ে চিন্তা করেছি। আমার মনে হয় আমার উইকেটের একটা মূল্য আছে। নিজের মূল্যটাই দেয়ার চেষ্টা করছি। আশাকরি সামনেও দিতে পারব।’
ব্যস! লিটন শুধু নিজের উইকেটের মূল্যটা দিতে থাকুক। তাহলেই খুব দ্রুতই ক্রিকেট দুনিয়ার সবচেয়ে মূল্যবান উইকেটে পরিণত হতে পারেন তিনি। তিন ফরম্যাটেই বিশ্ব ক্রিকেটের ব্র্যান্ড হয়ে উঠতে পারেন।