বিস্মৃত-প্রায় এক নায়কের কাহিনী

পৃথিবীতে কিছু ক্রিকেটার আছেন সময়ের থেকে অনেক অনেক এগিয়ে থাকেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন ভারতের স্বর্ণযুগের অন‍্যতম সেরা উইকেটরক্ষক -ব‍্যাটসম‍্যান বুধীসাগর কৃষ্ণাপ্পা কুন্দেরন তথা বুধী কুন্দেরন। নিজের ও সেই সময়ের সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও যেভাবে নিজেকে মেলে ধরেছিলেন তা এক কথায় অনবদ্য এবং ক্রিকেট যতদিন বেঁচে থাকবে তার জন্য কুর্ণিশ পাবেন।

পৃথিবীতে কিছু ক্রিকেটার আছেন সময়ের থেকে অনেক অনেক এগিয়ে থাকেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন ভারতের স্বর্ণযুগের অন‍্যতম সেরা উইকেটরক্ষক -ব‍্যাটসম‍্যান বুধীসাগর কৃষ্ণাপ্পা কুন্দেরন তথা বুধী কুন্দেরন। নিজের ও সেই সময়ের সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও যেভাবে নিজেকে মেলে ধরেছিলেন তা এক কথায় অনবদ্য এবং ক্রিকেট যতদিন বেঁচে থাকবে তার জন্য কুর্ণিশ পাবেন।

কুন্দেরন মহাশয় বর্তমানের ধোনির যোগ‍্য পূর্বসূরি ছিলেন, যিনি নিজের মানদণ্ড সবার কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছিলেন বিশালভাবে। শুধু উইকেট রক্ষা করবার জন্যই যে উইকেটরক্ষকরা একটি দলের সদস্য হতে পারেন না তা তিনি বিশ্বের কাছে জানান দিয়েছিলেন তার অসাধারণ ব‍্যাটিং কীর্তিকলাপ দিয়ে। ভাবলে অবাক হতে হয় ওই সময় যদি সীমিত ওভারের ক্রিকেট থাকতো তাহলে অবশ্যই তিনি এই খেলার একজন নক্ষত্র হতে পারতেন।

কিন্তু ক্রিকেটীয় জীবনের শুরুতে সব কিছু সঠিক ছিল না। ওনার বাবা কখনোই চাইতেন না ছেলে ক্রিকেটে মনোযোগ দিক কিংবা ক্রিকেট খেলুক। এজন্য কোনোদিন প্রথাগতভাবে প্রশিক্ষণও নিতে পারেননি ছোটবেলায়। যখন স্কুলের ক্রিকেট দলে সুযোগ পেলেন তখন ওনার মা, ওনার বাবার জামাকে দিয়ে ওনার পোশাক তৈরি করে দিয়েছিলেন। আর মাঠে নেমেই নিজের জানান দিয়েছিলেন অসাধারণ একটি ইনিংস খেলে যা পরদিন স্থানীয় সংবাদপত্রে পড়েন তাহার পিতা, বরফ গলতে আর দেরি হয়নি।

ক্লাব ক্রিকেট খেলতে খেলতে মাত্র ১৯ বছর বয়সেই সুযোগ পেয়ে গেলেন তখনকার বিশ্বসেরা ও সব দলের ত্রাস ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে খেলবার, ক্রিকেট ক্লাব অব ইন্ডিয়ার হয়ে। সেই ম‍্যাচে তিন নম্বরে নেমে সামলাতে হয়েছিল ওয়েস হল, গ্যারি সোবার্স, সনি রামদিন, ডেনিস অ্যাটকিনসনদের মত ক্রিকেটারদের। না ব‍্যাট হাতে তেমন কিছু করতে পারেননি।

তবে দস্তানার কাজ ছিল অসাধারণ এবং এই অভিজ্ঞতা পরবর্তী জীবনে অনেক কাজে দেওয়ার মত ছিল। পরের বছর রিচি বেনোর অস্ট্রেলিয়া দলের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি ম‍্যাচে ইনিংসের সূচনা করে ভাল করেই নির্বাচকদের চোখে পড়লেন এবং তৃতীয় টেস্টে দলে জায়গা পেলেন যদিও তখন ভারতের ঐতিহ্যশালী রঞ্জি ট্রফি খেলবার সুযোগ তাহার হয়নি।

ব্র্যাবোর্ন, বোম্বেতে (অধুনা মুম্বাই)দলে সুযোগ পাওয়ার সময় তাহার বয়স মাত্র ২০ বছর, পরিবার দৈণ‍্যতায় ডুবে।বাড়িতে নিজের একটি ঘর পর্যন্ত নেই, বেশিরভাগ সময় উঠোনে রাত কাটাতে হত। কিন্তু তিনি দলে থেকেও হোটেল পেলেন না কারণ তখনকার নীতি অনুযায়ী তিনি স্থানীয় ক্রিকেটার যার ফলে ওই সুযোগ সুবিধা পেলেন না।

কিন্তু স্বপ্নকে দমিয়ে পারে। ওই স্বপ্নকে চোখে নিয়েই ব্র্যাবোর্নের ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস হতে বম্বে জিম খানায় যেতেন প্রত‍্যেকদিন খেলা শেষ হওয়ার পর। সঙ্গে থাকতো কাথা,বালিশ ও অন‍্যান‍্য অনুষঙ্গিক জিনিস পত্র। যা দিয়েই বাগানে ঘুমিয়েছিলেন পাঁচটি রাত।‌ না কোনো মশায় বা বোম্বের গরম তার ঘুমের ব‍্যাঘাত ঘটাতে পারেনি কারণ পরের দিনই তো তাকে উইকেটের পেছনে দাড়াতে হবে।

আচ্ছা কেমন ছিল তাহার অভিষেকের সময় তাহার অস্ত্র-শস্ত্রের ভান্ডার।।পুরানে যেমন মহিষাসুর বধে দেবী দূর্গা সবার কাছ থেকে অস্ত্র পেয়েছিলেন তেমনই তিনি তাহার টুপিটি পান তার হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছ হতে, তাহার ব‍্যাট ও প‍্যাডটি পান তাহার ক্লাব ‘ফোর্ট বিজয়’ হতে।

সর্বোপরি তার প্রধান অস্ত্র তথা তাহাকে দুখানি দস্তানা দিয়েছিলেন পুণ্যাত্মা নরেন তা-মহানে, যার বদলে তিনি দলে জায়গা পেয়েছেন। সত্যি পুণ্যাত্মা নাহলে এমন কাজ কে করতে পারে।ক্রিকেট মাঠে সেই ম‍্যাচে তার কি অবদান ছিল তা বলার আর প্রয়োজন নেই, আসলে স্কোরবোর্ড তো গাধা।‌

৩ টি টেস্ট খেলবার পর যখন রঞ্জি অভিষেক হল, তিন নম্বরে নেমেই দ্বিশতরান করলেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে ভাল করতে থাকলেও দেশের হয়ে তেমন ভাল করতে পারেন নি। অন‍্যদিকে, এই সময় ভারতীয় ক্রিকেটে উদয় হয় আরেক আকষর্ণীয়, উত্তেজক ফারুক ইঞ্জিনিয়ারের। ফলে দলে অনিয়মিত হয়ে পড়েন।

১৯৬৩-৬৪ মৌসুম বুধি কুন্দেরনের আন্তর্জাতিক জীবনের সেরা সময়। মাদ্রাজে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওপেন করতে নেমে ১৯২ রানের অসাধারণ ইনিংস খেলেন, যা একজন ভারতীয় উইকেটরক্ষক হিসেবে একটা সময় পর্যন্ত সর্বোচ্চ রান ছিল। ও ম‍্যাচে উইকেটের পেছনেও অসাধারণ ছিলেন। ওই সিরিজে প্রথম উইকেটরক্ষক ব‍্যাটসম‍্যান হিসেবে একটি টেস্ট সিরিজে ৫০০ বা তার বেশী রান করবার কৃতিত্ব অর্জন করেন।

এই সিরিজের পর তেমন যদিও বলবার মত তেমন কিছু ছিল না। ইঞ্জিনিয়ারকে দলের প্রধান উইকেটরক্ষক হয়ে ওঠেন। ১৯৬৭ এর ইংল্যান্ড সফরে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় টেস্টে ব‍্যাটসম‍্যান হিসেবে খেলেন। তৃতীয় টেস্টেই দীলিপ সরদেশাই যখন চোটের জন্য নামতে পারলেন না তখন সেই ইঞ্জিনিয়ারের সাথেই ওপেন করে দলের সর্বোচ্চ রান করেন। অন‍্যদিকে, বোলিংও শুরু করেছিলেন তিনি। যদিও দুর্ভাগ্যবশত ওটাই ওনার শেষ আন্তর্জাতিক ম‍্যাচ।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জীবন এইভাবে শেষ হয়ে যাওয়ায় খুবই ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। স্কটল্যান্ডে স্থায়ী বসবাস করতে যাওয়ার পূর্বে একটি সাক্ষাৎকারে ভারতীয় বোর্ডের সমালোচনাও করেন। তিনি সত্যি কথা বলতে ভয় পেতেন না। সেই সময়কার বিভিন্ন লবি অন‍্যান‍্য বিষয় নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন। একথা কিন্তু ভারতীয় বোর্ড ভাল ভাবে নেয়নি বা ভুলে যায়নি। ১৯৮০ সালে বম্বে জুবলি টেস্টের নিমন্ত্রণ পত্র তাকে পাঠানো হয়নি।

স্কটিশ স্ত্রী হওয়ার দরুণ ভারত ছেড়ে অনেক দু:খ নিয়ে স্কটল্যান্ডে বসবাস শুরু করলেও ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা ছেড়ে দেননি। তাহার দল স্থানীয় চাম্পিয়নশিপ একাধিকবার সাতের দশকে জিততে পেরেছিল তাহার জন্যই। স্কটল্যান্ডে তিনি ১৯৯৫ পর্যন্ত অর্থাৎ ৫৬ বছর বয়স পর্যন্ত ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেছিলেন যা ওই দেশের ক্রিকেটে রেকর্ড।

২০০৬ সালে ফুসফুসের ক‍্যান্সারের সাথে বহুদিন লড়াই করে দেহত্যাগ করেন স্কটল্যান্ডেই। কিন্তু তাহার কীর্তি-গাঁথা আমাদের কাছে সারাজীবন অমর রয়ে যাবে। উইকেটকিপারদের সংজ্ঞাকে বদলে দেওয়ার এমন কারিগরের আত্মার চিরশান্তি কামনা করি। আমরা আধুনিকতার চাপে পড়ে এমন বিস্মৃত-প্রায় নায়কদের প্রায় ভুলতেই বসেছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link