৪৬৩ বার তিনি ডাগআউট থেকে বাইশ গজে ব্যাট হাতে হেঁটে হেঁটে গিয়েছেন, রঙিন পোশাকে। রীতিমত আইকনিক এক দৃশ্য। কখনো ব্যাটটা নিয়ে খানিক স্যাডো করে নিচ্ছেন, কখনও বা হেলমেটটা এদিক-সেদিক করে নিচ্ছেন, কখনও একটু জগিং করেই দিতেন ছোট্ট এক লাফ।
শেষবারের মতো এই দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে ছিল ঢাকার শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম। মাঠ ভরা দর্শক শেষবারের মত দেখে নিলেন এই কিংবদন্তির রঙিন পোশাকের আয়েসি চলন। যে দৃশ্য এখনও চোখের সামনে উজ্জ্বল, যে দৃশ্য চিরসজীব। তবুও শেষবার ‘দ্য গড অব ক্রিকেট’ শচীন টেন্ডুলকার নেমেছিলেন তাঁর সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে কাছের বাইশ গজে।
যে বাইশ গজ থেকে তিনি হয়েছেন কিংবদন্তি। যে বাইশ গজ তাঁকে দিয়েছে দু’হাত ভরে। সেখানটায় তিনি আবার উপস্থিত ১৮ মার্চ ২০১২ সালে। নিজের আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ইতি টেনে নিতে। প্রতিপক্ষ পাকিস্তান। এশিয়া কাপের এক ম্যাচ। পাকিস্তান টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান। মোহাম্মদ হাফিজ ও নাসির জামশেদের জোড়া সেঞ্চুরিতে ৩২৯ রানের বড় সংগ্রহ গড়ে পাকিস্তান। মাঝে ইউনুস খানের একটি অর্ধশতক এত বড় সংগ্রহক গড়তে সহয়তা করে।
জবাবে ব্যাট করতে সেদিন গৌতম গম্ভীরকে সাথে নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন শচীন টেন্ডুলকার। এর আগে বলও করেছিলেন শচীন। শেষ ওয়ানডে ম্যাচটা আরও বেশি স্মরণীয় হয়ে থাকতো যদি উইকেটের ট্যালিতে একটু কলমের খোঁচা পড়ত। তাছাড়া আগের ম্যাচেই অনন্য এক রেকর্ড গড়েছিলেন শচীন। বাংলাদেশের বিপক্ষে নিজের শততম শতক হাঁকিয়েছিলেন শচীন। সে এক দূর্ভেদ্য মাইলফলক হয়ে রয়ে গেল।
সে যা হোক। পাকিস্তানের বিপক্ষে সে ম্যাচের শুরুতেই গম্ভীর ছেড়ে চলে যান শচীনকে। এরপর শচীন তরুণ বিরাট কোহলিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এগিয়ে নিতে থাকেন দলের ইনিংস। শচীন সেদিন খুব সাবধানে অগ্রসর হচ্ছিলেন। অপরদিকে বিরাট নিজের আপন ছন্দে খেলেছিলেন। ভারতের ব্যাটিংয়ের অতীত আর ভবিষ্যৎ তখন একসাথে সেই বাইশ গজে। একসাথে হাঁটলেন বেশখানিকটা পথ। গড়লেন ১৩৩ রানের জুঁটি।
সাইদ আজমলের বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে সেই ডাগআউটের পথের হাঁটার আগে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৯৬তম অর্ধশতক করে ফেলেছিলেন শচীন। সে প্রস্থান যেন হয়ে রইলো রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প। কেমন যেন আরও দেখা ইচ্ছে রয়ে গেল, শেষ হয়েও হইলো না শেষ। কেমন যেন এক স্পৃহা রয়ে গেল, কেমন এক তৃষ্ণা। যার অমৃত সুধা শুধুই শচীনের ব্যাটিং।
তবে সে তৃষ্ণা আর মিটল না। শচীন সেবার গেলেন একেবারের জন্যেই গেলেন। তাঁর ক্যারিয়ার শেষ হল না বরং থেমে গেল। থেমে গেল ১৮৪২৬ রানে। রঙিন ৯৬টা অর্ধশতক ও ৪৯টা শতক। হয়ত কোন এক শীতের সকালে কুয়াশা ঠেলে বাইশ গজ আবার আলোকিত করবেন ক্রিকেটের দেবতা। হয়ত থেমে যাওয়া চিত্রপটটা আবার সচল হবে। আবার রেকর্ড বইয়ে নাম উঠবে শচীন টেন্ডুলকারের।
তবে শচীন সে ম্যাচে আউট হয়ে যাওয়ার পর ঠিকই সচল ছিল বিরাট কোহলির ব্যাট। তরুণ বিরাট দূর্দান্ত এক শতকের পাশাপাশি করেছিলেন ১৮৩ রান। আরেকটু সুযোগ পেলে হয়ত দ্বিশতকও করে ফেলতে পারতেন। তবে পাকিস্তানের পেসার উমর গুল তাঁকে আর সেই সুযোগ দিতে চাননি। যদিও তাঁতে হার এড়াতে পারেনি পাকিস্তান। শচীন টেন্ডুলকারের শেষ ম্যাচ তো আর ভারত হারতে পারে না।
যে শচীন তাঁর ক্রিকেট নৈপুন্যে ভারতকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। যে শচীন ভারতের ক্রিকেটের ভাবমূর্তি বদলে দিয়েছেন, হয়েছেন সেরাদের সেরা। তাঁর বিদায় তো আর বিষাদগ্রস্ত হওয়া চলে না। তাইতো নিজেদের সবটুকু দিয়ে সেদিন ৩৩০ রানের টার্গেট ছুঁয়ে জয় নিয়েই ক্ষান্ত হয়েছিল ভারতের সব ব্যাটাররা। অবিশ্বাস্য এক জয় দিয়েই শেষ হয় কিংবদন্তির ক্রিকেট ক্যারিয়ার।
সমান্তরাল কোন পৃথিবী যদি আদৌ থেকে থাকে তবে সেখানে হয়ত কিশোর শচীন দাপট দেখাচ্ছেন ক্রিকেট মাঠে। কিংবা তিনি গড়ছেন কতশত রেকর্ড। সে পৃথিবীতে যাওয়ার এক ব্যবস্থা থাকা গেল মন্দ হতো না। অন্তত আবার উপভোগ করা যেত। শচীন, শচীন বলে চেঁচেয়ি গলা ফাঁটানো যেত।