ওভালের মাঠের বাইরে, রাস্তার ওপারে একটা জুতো তৈরির কারখানা আছে। কারখানাটির দ্বিতীয় তলার জানালার কাচটি ভাঙা ছিল ষাট বছরেরও বেশী সময় ধরে। ভিক্টর ট্রাম্পার নামের এক ব্যাটসম্যানের ব্যাটের দাপটে ভেঙে পড়ে জানালার কাচ। ভিক্টরের সম্মানে, তাঁর স্মৃতিতে সেই জানালার মেরামত করেন নি কারখানার মালিক।
ট্রাম্পারকে নিয়ে আরও একটা বিখ্যাত গল্প আছে যা বলেছিলেন বিখ্যাত স্পিনার আরথার মেইলি। একটা ক্লাব ম্যাচে মেইলি আর তাঁর হিরো ভিক্টর মুখোমুখি। বেশ কয়েকটা অসম্ভব সুন্দর শট খেলার পর মেইলির স্পিনে পরাস্ত হয়ে স্ট্যাম্পড আউট হয়ে ফিরে যাচ্ছেন ট্রাম্পার। মাঠ ভর্তি দর্শকদের সঙ্গে মোচড় দিয়ে উঠল মেইলির বুকও, ‘মনে হল যেন একটা সুন্দর পায়রাকে মেরে ফেললাম আমি!’ – এই ছিল তাঁর তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া।
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যানের আলোচনায় প্রথমেই যে নামটা উঠে আসে সেটা স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের। ওনার প্রায় অলৌকিক ব্যাটিং গড়ের সঙ্গে অন্যদের তফাৎ এতটাই যে এ বিষয়ে আলোচনা খুব তাড়াতাড়িই কে ‘সেকেন্ড বেস্ট’এর আলোচনায় রূপান্তরিত হয়। এখন যদি বলি যে বিশ্বের তো দুরের কথা, ওনাকে অস্ট্রেলিয়ারও সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান মানতে রাজি নন অনেক ক্রিকেট বোদ্ধা তাহলে নিঃসন্দেহে আধুনিক ক্রিকেট প্রেমীরা বিভ্রান্ত হবেন। বিশেষ করে তারা যখন রেকর্ড বই উল্টে দেখবেন যে যাকে অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যানের শিরোপা দিয়ে থাকেন অনেকে সেই ভিক্টর ট্রাম্পারের টেস্ট ব্যাটিং গড় ৪০-এরও কম।
কথাটা কিন্তু সত্যি। আর শুধুমাত্র সাধারন অস্ত্রেলিয়ানদের মতে নয়, সিবি ফ্রাই, জ্যাক ফিঙ্গলটন, উইফ্রেড রোডস এবং জ্যাক হবসের মতো বোদ্ধাদের মতেও স্যার ডন নন, ভিক্টর ট্রাম্পার ছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান। সব ধরনের উইকেটে, সব ধরনের বোলিংয়ের বিরুদ্ধে যে প্রভুত্ব আর সৌন্দর্যের সঙ্গে ব্যাটিং করতেন ট্রাম্পার তার উপমা ক্রিকেট ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই।
১৮৭৭ সালের দুই নভেম্বর জন্মগ্রহণ করে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে মারা যান ক্রিকেটের এই রাজপুত্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের কয়েকটা বছরকে ক্রিকেটের স্বর্ণযুগ বলা হয় (১৮৯০ থেকে ১৯১৪ সালকে) – আর সেই স্বর্ণযুগের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র ছিলেন ট্রাম্পার। মানুষ বা ক্রিকেটার ট্রাম্পার সম্বন্ধে কটূক্তি করতে আজ পর্যন্ত কাউকেই শোনা যায় নি – এও ক্রিকেটারদের মধ্যে খুব স্বাভাবিক ঘটনা নয়। একটু কান পাতলেই শুনতে পাবেন ব্র্যাডম্যানের ব্যাটিংয়ের প্রশংসার সাথে সাথে ওনার স্বার্থপরতার, ওনার প্রতিশোধস্পৃহার কাহিনী। কিন্তু ট্রাম্পার? উনি এসবের অনেক ওপরে।
ট্রাম্পারের গ্রেটনেস নিছক পরিসংখ্যানের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না কারণ গুরুত্বহীন ম্যাচে গাদা গাদা রান বা সেঞ্চুরিকে ডাবল বা ট্রিপল সেঞ্চুরিতে পরিবর্তিত করার ব্যাপারে তাঁর প্রবল অনীহা ছিল। মোটামুটি ভদ্রস্থ রান করার পর, বিশেষ করে সেঞ্চুরি করে ফেলার পর উনি নিজের পছন্দের কোন বোলারকে নিজের উইকেট উপহার দিয়ে ইচ্ছামৃত্যু বরণ করতেন।
অন্যদিকে খারাপ, বিশেষ করে ভেজা উইকেটে ওনার ব্যাটিং অন্য মাত্রা লাভ করত। এই ধরনের উইকেটে ওনার করা ৩০ বা ৭৪ রানের ছোট্ট অথচ অমুল্য ইনিংস যারা দেখেছেন তারা প্রায় সবাই একবাক্যে ট্রাম্পারের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন।
তবে ব্যাটসম্যান ট্রাম্পারের চেয়েও মানুষ হিসেবে আরও বড় ছিলেন ভিক্টর ট্রাম্পার। এই দাবীর সমর্থনে দুই একটা গল্প বলি।
একবার উনি ব্যাট করতে নামার কিছু আগে একটা প্রায় গদার ওজনের ব্যাট হাতে হাজির হল এক ছোকড়া। ওর আব্দার যে আজকে ভিক্টরকে আজ এই ব্যাট দিয়ে খেলতে হবে। সে নাকি সবে ব্যাট তৈরির ব্যাবসায় নেমেছে, ওর ব্যাট দিয়ে ভিক্টর যদি খেলে তাহলে ওর দোকানে ব্যাট কেনার জন্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে।
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি যে ভিক্টর ট্রাম্পারেরও একটা ব্যাটের দোকান ছিল আর সেজন্যেই ওনার ব্যাটের অভাব কোনকালেই ছিল না। সে যাই হোক, ছোকড়াকে ‘না’ করতে না পেরে ওর হাত থেকে ব্যাটটা নিলেন তিনি।
ব্যাটটা এতটাই ভারী ছিল যে সেটা তুলতেই ওনার অন্যান্য টিমমেটদের জিভ বেরিয়ে গেল। তার মধ্যেই একজন মন্তব্য করল, ‘তুমি নিশ্চই এই গদাটাকে নিয়ে ব্যাট করার কথা ভাবছ না?’
ট্রাম্পার উত্তর দিলেন, ‘বেচারির বয়স কম আর ও সবে ব্যবসায় নেমেছে। এই ব্যাট দিয়ে যদি কিছু রান করতে পারি তাহলে তার হয়ত কিছুটা উপকার হবে।’
ওই ব্যাট দিয়ে ৮৭ রান করেছিলেন ট্রাম্পার। তারপর সেই ব্যাটের ভূয়সী প্রশংসা করে, ওটার ওপর নিজের স্বাক্ষর করে আবার সেই ছেলেটিকে সেই ব্যাট ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। উচ্ছাসের চোটে সেই ছেলেটির তখন মাটিতে পা-ই পড়তে চায় না।
আরও একদিন নিজের ব্যাটের দোকানে বসে আছেন ট্রাম্পার এমন সময় একজন খদ্দের ব্যাট কিনতে এসে একটা অদ্ভুত দাবী করে বসল। সে নাকি ভিক্টর ট্রাম্পারের ব্যাবহার করা কোন একটি ব্যাট কিনতে চায়। ভেতর থেকে একটা ব্যাট হাতে ফিরে এসে ট্রাম্পার জানালেন কিছুদিন আগেই তিনি এই ব্যাট দিয়ে ১৮৫ রানের একটি ইনিংস খেলেছেন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। অনেকে সেই ইনিংসকে তাঁর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইনিংসের শিরোপাও দিয়ে থাকেন।
খদ্দের উচ্ছসিত, ‘কত দিতে হবে এটার জন্যে?’ সে জিজ্ঞেস করলো। ‘এমনিতে এটার দাম ৪৫ শিলিং কিন্তু এটা তো এখন সেকেন্ড হ্যান্ড হয়ে গেছে, তুমি না হয় তার অর্ধেক দাম দিও।’, নির্বিকার স্বরে বললেন ট্রাম্পার।
এ জন্যেই সম্ভবত ভিক্টর ট্রাম্পার ব্যবসায় সুবিধে করতে পারেন নি কোনদিন, যদিও তার বিনিময়ে পেয়েছেন মানুষের কাছ থেকে বুকভরা ভালোবাসা।
এবার ওনার ব্যাটিংয়ের কিছু গল্প শোনা যাক।
ভিক্টোরিয়ার বিরুদ্ধে সিডনিতে ম্যাচ। ভেজা, স্যাঁতস্যাঁতে উইকেটে ব্যাট করতে নামলেন ভিক্টর ট্রাম্পার। বল জ্যাক সণ্ডারসের হাতে যিনি ছিলেন ঐ ধরনের উইকেটে মূর্তিমান আতঙ্ক। প্রথম বলেই আউট না হলেও সম্পূর্ণ পরাস্ত হলেন ট্রাম্পার।
অল্প হেসে বোলারের উদ্দেশ্যে বললেন ট্রাম্পার, ‘নিজের পুরনো বন্ধুর সঙ্গে এ কি ব্যবহার তোমার, জ্যাক? ঠিক আছে, আজকে নয় তুমি, নয় আমি।‘
তারপর ব্যালে ডান্সারের ফুটওয়ার্ক আর অসি যোদ্ধার নিপুণতা কে একত্রিত করে ষাট মিনিটে সেঞ্চুরিতে উড়ে গেলেন ট্রাম্পার।
১৯০৪ সালের শুরুতে মেলবোর্নের ভেজা উইকেটে রোডস আর হার্স্টের মুখোমুখি হন ট্রাম্পার। এই দুজনকে সর্বকালের অন্যতম সেরা বাঁ হাতি বোলারের জুটি হিসেবে সম্মান দেওয়া হয় আর মেলবোর্নের ভেজা উইকেটও সেই সময় ছিল বিশ্বের সবচেয়ে কুখ্যাত। গুড লেন্থ থেকে আচমকা প্রায়ই চিবুকের দিকে ছোবল মারতো বল।
দলের মোট ১২২ রানের মধ্যে ৭৪ রান করেন ট্রাম্পার সেদিন (সম্ভবত মাত্র ৮৪ বলে) – প্রথমে নেমে আউট হন শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে। ধ্বংসস্তুপের মধ্যে দাঁড়িয়ে সেই ৭৪ রানের মুল্য অনেক ডাবল সেঞ্চুরির চেয়েও বেশি।
একবার স্প্রিংবক নামের একটা দলের বিরুদ্ধে বোলিঙকে নিয়ে ছেলেখেলা করে ২১৪ রানের ইনিংস খেলার পর বোলিং টিমের ক্যাপ্টেন পার্সি শের্বেলকে তার ক্যাপ্টেনশিপ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তর দেন, ‘ওসব কথা ছাড়ুন! আজকে আমরা ব্যাটিং কাকে বলে সেটা প্রাণ ভরে দেখলাম।‘
আরও একবার জর্জ হার্স্টকে তার ক্যাপ্টেন ওয়ারনার জিজ্ঞেস করেন ট্রাম্পারের বিরুদ্ধে তিনি কেমন ফিল্ড চান যার উত্তরে হার্স্ট হতাশ গলায় উত্তর দেন, ‘যেখানে ইচ্ছে রাখুন মশাই! ভিক্টর তা সত্বেও ওর যা ইচ্ছে হবে তাই করবে।‘
ভিক্টর ট্রাম্পারের প্রথম টেস্ট প্রবাদপ্রতিম ডাবলু জি গ্রেসের শেষ টেস্ট ছিল। কিছুদিন পর লর্ডসে ট্রাম্পারের কাব্যিক সেঞ্চুরি দেখে নিজের ব্যাট তাকে উপহার দেন গ্রেস – সেই ব্যাটের ওপর লেখা ছিল, ‘ফ্রম দ্য পাস্ট চ্যাম্পিয়ন টু দ্য ফিউচার চ্যাম্পিয়ন!’ প্রবীণ ডাক্তারের চোখ ভুল দেখে নি। ব্যাট নয়, সেদিন যেন ব্যাটন তুলে দিলেন গ্রেস ভিক্টরের হাতে।
ভিক্টরের ব্যাটিং অন্যদের থেকে দৃষ্টিনন্দন ছিল কারন একই বলকে ট্রাম্পার ইচ্ছেমত কাট, পুল বা অন ড্রাইভ মেরে সীমানার ওপারে পাঠাতে পারতেন অনায়াসে – পাঠাতেনও। অন্যদিকে ব্র্যাডম্যান বা হবস সেই শটটিই খেলতেন যেটিতে আউট হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম। সুতরাং ব্র্যাডম্যান বা হবসের লম্বা ইনিংস দেখতে দেখতে একটা সময় আসতো যখন দর্শকদের মনে হত তাঁরা এবার নিজেদের আগে খেলা শট রিপিট করছেন, ভিক্টরের ব্যাটিং দেখার সময় এই সম্ভাবনা ছিল না। এ সেই চিরায়ত দ্বন্দ্ব – একদিকে শিল্প, অন্যদিকে টেকনিক; একদিকে সৌন্দর্য, অন্যদিকে কার্যকারিতা। বা নেভিল কার্ডাসের ভাষায় যদি স্যার ডন উড়োজাহাজ হন, তাহলে ট্রাম্পার হবেন শিকারি ঈগল!
ভিক্টর ট্রাম্পারের একমাত্র টেস্ট ডাবল সেঞ্চুরি আসে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে। অথচ সিরিজ শুরু হওয়ার আগে অনেকেই বাজি রেখেছিলেন যে সিরিজে একটাও সেঞ্চুরি করতে পারবেন না ট্রাম্পার কারণ তাঁর ম্যাটিং উইকেটে খেলার অভ্যেস নেই। ট্রাম্পারের সেই স্বপ্নের ইনিংসের মাঝখানে একবার ক্যাপ্টেনকে নিজের শ্রেষ্ঠ বোলার পেগ্লারের উদ্দেশ্যে বলতে শোনা যায়, ‘কি করছ সিড? ভিক্টরকে ক্রিজ থেকে সরিয়ে ফেল এবার।‘
হতাশ পেগ্লার উত্তর দেন, ‘জীবনে আমি এর চেয়ে ভালো বল করিনি কিন্তু ও যেন আমাকে ওর ইচ্ছেমত জায়গায় প্রত্যেকটি বল করতে বাধ্য করছে।‘
২৪৭ বলে ডাবল সেঞ্চুরি করেন ট্রাম্পার – অপরাজিত ২১৪ – টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম অপরাজিত ডাবল সেঞ্চুরি সেটাই।
শুরুতেই লিখেছি যে স্ট্যাটিস্টিকস নিয়ে কোনদিনই মাথা ঘামাতেন না ট্রাম্পার, মোটামুটি ভদ্রস্থ স্কোর করার পরই নিজের পছন্দমত বোলারকে নিজের উইকেট উপহার দিয়ে প্যাভিলিয়নের দিকে হাঁটা দিতেন তিনি। তবে যখনই ম্যাচের বা উইকেটের পরিস্থিতি চ্যালেঞ্জিং মনে হত, ট্রাম্পারের ব্যাটিংয়ের একটা নতুন মাত্রা যোগ হতো।
এবার একটু ওনার রানের অ্যানালাইসিস করা যাক।
সেই সময় মাঝে মাঝে ‘টাইমলেস ম্যাচ’ খেলা হত – অর্থাৎ ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত ম্যাচগুলি চলবে। শিল্ড এবং টেস্ট মিলে মোট পাঁচবার অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে ১০০ বা তার বেশি রানে পেছিয়ে পড়েছিল এরকম ম্যাচগুলিতে। এই ম্যাচগুলির দ্বিতীয় ইনিংসে ট্রাম্পারের স্কোর ছিল এইরকম – ২৩০, ১৮৫*, ৬৩, ১৬৬ এবং ১৬৯। এই পাঁচটা ইনিংসে আর কেও ৮৬ রানের বেশি করেন নি।
যেখানে প্রতিপক্ষ ৩৮০ বা তার বেশি রান করে, সেখানে দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ট্রাম্পারের স্কোর এরকম – ২, ১৭৮, ৬৫, ৭৪ এবং ২১৪*। এই পাঁচটা ম্যাচে অন্য ব্যাটসম্যানেরা ৭০ বা তার বেশী রানের মাত্র ৪ টি ইনিংস খেলেন।
এবার ভেজা উইকেট। এই ধরনের উইকেটে ব্যাটিং করা এতটাই কঠিন ছিল যে টসে জিতেও কোন চিন্তাভাবনা ছাড়াই ক্যাপ্টেনরা ফিল্ডিং নিতেন। মোট আটবার বিপক্ষ দলের ক্যাপ্টেন টসে যেটা সত্বেও অস্ট্রেলিয়াকে এই ধরনের উইকেটে আগে ব্যাট করতে পাঠান। এই আট ইনিংসে ট্রাম্পারের স্কোর ছিল – ৪৫, ০, ১৬, ৪৬, ৫৮, ৪৭, ৫১ ও ২৫। মোট ২৮৮, গড় ৩৬। এই আটটা ইনিংসে অন্যান্য ব্যাটসম্যানেরা ৪৮ বার আউট হয়ে মোট ৪৫০ রান করেন – গড় ৯।
অস্ট্রেলিয়ার এক শিক্ষক একবার কঠিন পরিস্থিতিতে অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ব্যাটসম্যানদের পারফর্মেন্সের এনালিসিস করেন। দেখা যায় ব্র্যাডম্যান সেই সময়ের অন্যান্য ব্যাটসম্যানের তুলনায় ২ গুণ বেশী রান করতেন সেই সব ইনিংসে, জ্যাক হবস ১.৫ গুণ, পন্টিং ১.২ গুণ। আর ট্রাম্পার? ৫ গুণ। সুতরাং পরিস্থিতি আর বোলিঙের মানকে বিচারে রাখলে, ভিক্টর ট্রাম্পারের গড় আর ততটা কম মনে হবে না।
তবে গড় নয়, একজন ক্রিকেটারের মানের সবচেয়ে সঠিক মাপকাঠি মনে হয় সেই সময়ের অন্যান্য ক্রিকেটারদের তাঁর সম্বন্ধে মতামত। সেইদিকে একবার চোখ ফেরানো যাক।
১৯০৫ সালের ইংল্যান্ড সফরের আগে ট্রাম্পারের স্বাস্থ সমন্ধে একটু অনিশ্চয়তা ছিল। ইংল্যান্ডের ক্যাপ্টেন আর্চি ম্যাক্লারেন সেটা শুনে বলেন, ‘আশাকরি খবরগুলো সত্যি নয়। আর যদি হয়, তাহলে ট্রাম্পার বিহীন অস্ট্রেলিয়ার আর খেলতে আসার দরকার নেই কারন ওকে রিপ্লেস করার মত ব্যাটসম্যান অস্ট্রেলিয়া দলে নেই।‘
সিডনি হারবার্ট পারডন উইজডেনের সম্পাদক ছিলেন ১৮৮০ সালের পর থেকে ৩৫ বছর ধরে। ১৯২০ সালে ওনার দেখা শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যানের প্রসঙ্গে উনি বলেন, ‘ডাবলু জি, স্টিল, ম্যাক্লারেন, রঞ্জি ইত্যাদি সবাই একটু আধটু ব্যাট করতে পারতেন বটে কিন্তু একজনের সামনে ওদের সবাইকে টুপি খুলে দাঁড়াতে হবে – ভিক্টর ট্রাম্পার – সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান ওই।‘
স্প্রফোর্থ (সম্ভবত ১৯ শতকের শ্রেষ্ঠ বোলার, ওনার ডাকনাম ছিল ‘ডেমন’) আর জর্জ হার্স্টের (বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডার) মতেও তাঁদের দেখা শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যানের নাম ট্রাম্পার।
দুর্ভাগ্যবশত ভিক্টর ট্রাম্পারের খেলার ভিডিও আমাদের কাছে নেই। তবে বেশ কিছু সুন্দর ছবি আছে ওনার ব্যাটিংয়ের যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হোল জর্জ বেলডামের তোলা নিচের ছবিটি – ড্রাইভ খেলার জন্যে এগিয়ে আসছেন ট্রাম্পার, একাগ্র দৃষ্টি বলের দিকে, লম্বা হ্যান্ডেল উন্মুক্ত ব্যাট বাতাসে, সামনের পা এখনও মাটিতে পড়ে নি – ব্যাটের আঘাতের পর নিশ্চিত ভাবেই বল বাউন্ডারির ওপারে গিয়ে পড়বে, হয়ত বা মাঠেরও বাইরে। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের বাইরে একটা সরোবর আছে যেটা আজ পরিচিত ‘লেক ট্রাম্পার’ নামে কারন প্রায়ই ভিক্টরের ব্যাটের আঘাতে বল সেই সরোবরে আশ্রয় নিত।
ড্রাইভ, পুল, কাট – সব ধরনের স্ট্রোকই পারদর্শিতার সঙ্গে মারতে পারতেন ট্রাম্পার তবে তাঁর সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন শট ছিল লেগ গ্লান্স। আরও একটা বিশেষ শট ছিল তাঁর একান্তই নিজস্ব। ফাস্ট ইয়র্কারের বিরুদ্ধে নিজের পেছনের পা তুলে ব্যাটকে এমন অ্যাঙ্গেলে নাবিয়ে আনতেন শেষ মুহূর্তে যে তার আঘাতে বল দ্রুতগতিতে ছুটে যেত স্কয়ার লেগ বাউণ্ডারির দিকে। এই শটটা বিখ্যাত ছিল ‘ডগ শট’ নামে – কারণটা অনুমান করা কঠিন নয়।
অনেকেই জানেন না, ফিল্ডার হিসেবেও দুরন্ত ছিলেন ট্রাম্পার – খেলার বিরতির সময় উনি আর ক্লেম হিল প্রায়ই মাঠের দুই ধারে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে বল ছোঁড়াছুঁড়ি করে দর্শকদের আনন্দ দিতেন। দুজনের মধ্যেকার দুরত্ব হত ১০০ গজেরও বেশি – এর থেকেই ট্রাম্পারের কাঁধের শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। মাঝে মধ্যে মিডিয়ম পেসে বলও করতেন ট্রাম্পার।
সেকালের বিখ্যাত উইকেটরক্ষক হ্যান্সন কার্টার একবার ক্রিকেট লেখক ফিঙ্গলটনকে বেশ কড়া গলায় বলেন, ‘দেখ, কোনদিনও ব্র্যাডম্যান, হবস বা অন্য কারও সঙ্গে ট্রাম্পারের তুলনা করার চেষ্টা কোর না। যদি ব্যাটসম্যানদের নিয়ে আলোচনা করতে হয় তাহলে ওঁকে সবার ওপরে একটা আলাদা স্থান দিয়ে বাকিদের নিয়ে কথাবার্তা শুরু করতে পারো।‘
অন্যদিকে, নেভিল কার্ডাস লিখেছিলেন ট্রাম্পারের ব্যাটিং হচ্ছে পাখির ওড়ার মত সহজ, স্বাভাবিক, সে নিজেই তার সৌন্দর্য্য সম্বন্ধে সচেতন নয়। ক্রিকেটার এবং প্রশাসক চার্লস ফ্রাইয়ের স্ত্রী বলেছিলেন, ‘ব্যাট হাতে সবুজ গালিচা আর সুনীল আকাশের প্রেক্ষাপটে ভিক্টর বলের জন্যে অপেক্ষা করছে – দেখলেই মনে হয় অর্কেস্ট্রা শুরু হতে চললো।’