বাংলাদেশের ক্রিকেটে এক রূপকথার নায়ক হয়ে এসেছিলেন। হারতে থাকা একটা দলের হাল ধরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সাফল্য এনে দিয়েছিলেন। অধিনায়ক হিসেবে গোটা দলটাকে একটা সুতোয় বেঁধে ছিলেন। তবে সেই অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজাকে নিয়েই পরে আবার অনেক জল ঘোলা হয়েছে।
অবসরে যাবেন কি যাবেন না সেই তর্ক উঠেছে। এখন আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেননা। তবে বিপিএল, ডিপিএলের মত টুর্নামেন্ট গুলো খেলছেন। বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক নায়কের যাত্রাটা শেষ হচ্ছে। ক্রিকেট মাঠে তাঁর শেষ দিনগুলোই কাটাচ্ছেন মাশরাফি। তবে মাশরাফি চিরকাল ক্রিকেটের একজন হয়েই থাকুক।
একটু পিছনের গল্প বলা যাক। বাংলাদেশের ক্রিকেট তখন সবেমাত্র হামাগুড়ি দেয়া শিখেছে। সেই সময়ে দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা হাবিবুল বাশার সুমন ও বাংলাদেশের সফলতম কোচ ডেভ হোয়াটমোরের পাঁয়ে ভর দিয়ে মাঝেমাঝে এক-দু পাঁ এগোতেও চায় দেশের ক্রিকেট।
তবে এরপরই আবার নতুন হাঁটতে শিখা শিশুর মত মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। তবে সেই সময়েই দেশের ক্রিকেটে আগমন ঘটে পাথর ভাঙতে চাওয়া কিছু কিশোরের। পরবর্তীকালে যারা হয়ে উঠেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের জ্বল জ্বল করা নক্ষত্র। যাদের হাত ধরে দেশের ক্রিকেট শুধু হাঁটতেই শিখে না, দাপিয়েও বেড়ায়।
২০০৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপের আসর বসে ক্যারিবীয় দ্বীপে। সেখানেই প্রথম নিজেদের প্রমাণ করে হাবিবুল বাশার সুমনের দল। সেই দলে আছে সাকিব, তামিম, মুশফিকদের মত ঊনিশ বছরের কয়েকজন কিশোর। আছেন বাংলাদেশের প্রথম গতি তারকা মাশরাফি বিন মর্তুজা। এই নামগুলো পরবর্তী দশকে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে নিয়ে যাবে অনন্য উচ্চতায়। মাশরাফি হয়ে উঠবেন দেশের ক্রিকেটের পথ প্রদর্শক।
২০০৭ বিশ্বকাপে আবার একটু ফিরে আসা যাক। গ্রুপ পর্বে ক্রিকেট পরাশক্তি ভারকে হারিয়ে গোটা ক্রিকেটবিশ্বকে চমকে দিয়েছিল বাংলাদেশ। জায়গা করে নিয়েছিল বিশ্বকাপের সুপার এইটে। সেখানেও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে বাংলাদেশ প্রমাণ করলো নিজেদের দিনে বাংলাদেশ যে কাউকে হারাতে পারে। তবে সমস্যাটা হয়েছিল যে এই নিজেদের দিনটা ছিল ঈদের চাঁদের মত। অবশ্যই ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারত কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার মত দলকে হারানো ক্রিকেট বিশ্বের কাছে নিতান্তই একটা আপসেট ছিল।
তবে সেই আপসেট দিয়েই বাংলাদেশ আশায় বুক বেঁধেছিল। নড়েচড়ে বসেছিল দেশটির ক্রিকেটের হর্তা-কর্তারা। যে করেই হোক এই বাচ্চা ছেলেগুলোকে আগলে রাখতে হবে। এরাই হয়তো একদিন হাল ধরবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের। সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাশরাফিরা হাল ধরেছেও। একেকজন বিশ্বক্রিকেটেও নিজেদের প্রতিভার জানান দিয়েছেন। তবে পথটা এতটা সহজ ছিল না।
হাবিবুল বাশার সুমন ও ডেভ হোয়াটমোর দুজনই এর মধ্যে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে বিদায় বলেছেন। ফলে আবার দিশেহারা হয়ে পড়ে দেশটির ক্রিকেট। দল এরপর তেমন বড় কোনো সাফল্য না পেলেও সাকিব আল হাসান বিশ্ব ক্রিকেটের সেরা হয়ে উঠেন। দলের সেরা পারফর্মারকেই দেয়া হয় অধিনায়কত্বের দায়িত্ব। নিয়মিত না হলেও ফল আসতে শুরু করে। ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইট ওয়াশ ও ২০১১ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বসে সাকিবের দল।
তবে কোনোভাবেই নিয়মিত জয়ের দেখা পাওয়া যাচ্ছিল না। ঘরের মাঠে মাঝেমাঝে চমক দেখা গেলেও তা নিমিষেই মিলিয়ে যেত আবার। এরমধ্যে ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত ২০১১ বিশ্বকাপ ইনজুরির কারণে খেলতে পারেননি মাশরাফি বিন মর্তুজা। তাঁর অশ্রুসিক্ত চোখের ছবিতে ছেয়ে গিয়েছিল তখনকার পত্রিকার পাতাগুলো। বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের মনেও সেই ছবি দাগ কেটেছে। সবমিলিয়ে ভালো সময় পাড় করছিল না বাংলাদেশের ক্রিকেট। বিশেষ করে ২০১৩-২০১৪ সালে জয় যেনো হরিণের চোখ হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের জন্য।
২০১৫ বিশ্বকাপকে সামনে রেখে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে ক্রিকেট কর্তাদের কপালে। চার বছর আগে বিশ্বকাপ খেলতে না পারা সেই মাশরাফিরই দ্বারস্থ হয় বাংলাদেশ। হারের বৃত্তে ঘুরতে থাকা দলটিএ ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্বের দায়িত্ব কাধে তুলে নেন মাশরাফি। বিশ্বকাপের ঠিক আগে ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ে সিরিজে শুরু হয় মাশরাফি যুগের। সেই থেকে শুরু হলে বাংলাদেশের কল্পলোকের পথে চলা।
৫ টি ওয়ানডেতে যথাক্রমে বাংলাদেশের ৮৭ রানে, ৬৮ রানে, ১২৪ রানে, ২১ রানে এবং ৫ উইকেটের জয়। এরমধ্যে দ্বিতীয় ম্যাচে ম্যাচসেরাও হলেন মাশরাফি। ৫ ম্যাচে তাঁর উইকেট সংখ্যা ৯। মাশরাফিকে কখনোই সংখ্যা দিয়ে বিচার করতে চাই না। তবে সংখ্যা গুলো বললাম এটা মনে করিয়ে দিতে যে মাশরাফি শুধু অধিনায়কত্বই করেননি, কিঞ্চিৎ বোলিংও করেছেন।
আসলে বারবার ইনজুরিতে পড়া মাশরাফির হাঁটু থেকে প্রায় সব রসই শুষে নিয়েছিল ঈশ্বর। গুনে গুনে ঠিক সাতবার ছুড়ি-কাচির নিয়ে হাঁটুটি পেতে দিয়েছেন আরেকবার ওই লাল-সবুজের জার্সিটা গায়ে চাপাবেন বলে। ডাক্তার বলেছিলেন এভাবে খেলতে থাকলে তুমি একসময় আর হাঁটতে পারবে না হয়তো। মাশরাফি বলেছিল, ‘তাও খেলব। আরেকবার দেশের হয়ে বল করবো।’
এসবকিছুর পরে মাশরাফি তাঁর কৈশরের গতি হয়তো হারিয়েছিলেন তবে মাপা লাইন-লেন্থে তিনি তখনো দেশের সেরা পেস বোলার। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে মাশরাফির বোলিং কতটা ভয়াবহ ছিল তা বোঝা যায় স্বনামধন্য ক্রীড়া সাংবাদিক দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের লেখা বই ‘মাশরাফি’ এর একটি ছোট্র অংশ থেকে-
‘‘২০০১ সালের এপ্রিলে প্রথমবার পূর্নাঙ্গ বিদেশ সফরে যায় বাংলাদেশ দল। সে দলে ছিলেন না মাশরাফি। তবে সে বছরই নিউজিল্যান্ড সফরের পরিকল্পনার মধ্যমণি তিনি। এই দুটো সফরের মাঝেই বাংলাদেশ ‘এ’ দল গিয়েছিল ভারতে।
অনুর্ধ্ব-১৭ টুর্নামেন্ট সাড়া ফেলে দেয়া মাশরাফির সামনে শেষ হার্ডল ছিল ওটাই। হার্ডলটা অনায়াসেই টপকেছেন তিনি। দলের সঙ্গে যাওয়া সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান ফিরে বলেছিলেন, ‘ছেলেটা ১৪৫ কিলোমিটার গতিতে বোলিং করেছে।’ যা বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেসময়ের প্রেক্ষাপটে চরম বিস্ময়ের। আর অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ গর্ব করে বলছিলেন, ‘মুম্বাইয়ের একটা ম্যাচে বাউন্সারে এক ব্যাটসম্যানের হেলমেটের গ্রিল ভেঙে ফেলেছিল কৌশিক। খেলার পর ওরা ঠাট্টা করে বলছিল তোমরা কৌশিককে দিয়ে আমাদের একজন ব্যাটসম্যানকে নিয়ে যাও।’
বল হাতে ঝড় তোলা সেই কৌশিক বারবার ছুড়ি-কাচির নিচে পড়ে হয়ে উঠেছেন নিখুঁত লাইন-লেন্থের মাশরাফি বিন মর্তুজা। যার ক্রিকেট দর্শনে বাংলাদেশের ক্রিকেট উঠে এসেছে এক অনন্য উচ্চতায়। অধিনায়ক মাশরাফি বাংলাদেশের ক্রিকেটে পাওয়া সবচেয়ে বড় সম্পদ। কোনো জাতির ইতিহাসে এমন মানুষই আসে শতবর্ষের আরাধনায়। আপনাদের এবার একটু মাশরাফির নেতৃত্বে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের কাছে নিয়ে যাই।
ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়েকে হারানোর ২০১৫ বিশ্বকাপ খেলতে যায় বাংলাদেশ। সেখানে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে কোয়াটার ফাইনাল খেলে বাংলাদেশ। তবে এবার ইংল্যান্ডকে হারানোটা আর আপসেট ছিল ছিল না। সেটার প্রমাণ হয় সেবছরই ঘরের মাঠে পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে ওয়ানডে সিরিজ হারায় বাংলাদেশ।
সময়ের গোড়াকলে সাকিব, তামিম, মুশফিকরা অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। সাথে দলে এল মুস্তাফিজ, সৌম্য, তাসকিনদের মত তরুণ তুর্কিরা। পরের বছর এশিয়া কাপের ফাইনালও খেলে বাংলাদেশ। ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে সেমিফাইনাল খেলে বাংলাদেশ। মাশরাফির দল হয়ে উঠছে বিশ্বক্রিকেটের নতুন পরাশক্তি।
তবে মাশরাফি নিজেকে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে নিলেন। তিনি চান এবার নতুন কেউ আসুক। হ্যা, মাশরাফি তাঁর কাজটি করে গিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে ৮৮ টি ওয়ানডে খেলে ৫০ টিতেই জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেটকে একটু নতুন উচ্চতায় রেখে গিয়েছেন। সৌরভ ভারতকে শিখিয়েছিল কিভাবে চোখ চোখ রেখে জয়ের জন্য খেলতে হয়।
তারপর তাঁর উত্তরসূরিরা সেই পথ মেনে ভারতের ক্রিকেটকে নিয়ে গিয়েছেন আরো উপরে। মাশরাফির দেখানো পথেই তাঁর রেখে যাওয়া দলকে পরবর্তী প্রজন্ম সর্বোচ্চ শিখড়ে নিয়ে যাবেন সেটাই আশা। যেই সময় বসে লিখছি তখনো বাংলাদেশ ওয়ানডে সুপার লিগের তালিকায় সবার উপরে অবস্থান করছে। বছর কয়েক আগে বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব ১৯ দল বিশ্বকাপ জয় করে এসেছে। মানে মাশরাফির দেখানো পথেই নতুন আরেকটি প্রজন্ম আসছে।
তবুও বাংলাদেশের ক্রিকেট স্বস্তিতে নেই। দেশের ক্রিকেটের অবকাঠাবো আরো শক্তিশালি করা প্রয়োজন। ক্রিকেটারদের আরো নানা রকম সুযোগ সুবিধা দেয়া প্রয়োজন। সাকিব,তামিম,মুশফিকরা এখনো হাল ধরে আছেন। জুনিয়রদেরও আরো সামনে এগিয়ে আসতে হবে।
টেস্ট ক্রিকেটের উন্নয়ন নিয়ে আরো অনেক কাজ করাও বাকি। সর্বপরি ক্রিকেটের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর সমস্যা গুলো নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ। এখন আর আমরা লিখি না যে নিজেদের দিনে যেকোনো দলকে হারানোর ক্ষমতা রাখে বাংলাদেশ। আমরা লিখতে চাই যেকোনো দিনে যেকোনো দলকে হারাতে পারে বাংলাদেশ। সে পথেই এগোচ্ছে বাংলার ক্রিকেট।