‘দিস ইজ ইনক্রিডিবল, দিস ইজ হিউজ !’- সত্যিই বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য অবিশ্বাস্য, অবিস্মরণীয় এক জয়। পুরো ক্রিকেট দুনিয়াকে আবার নরে চরে বসতে বাধ্য করা এক জয়। এবার আর কোন আপসেট নয়, এবার ইতিহাসের নতুন অধ্যায়, নতুন কোন মহাকাব্য। যেই মহাকাব্যের নায়ক তাসকিন, সাকিব, মিরাজ, একটা গোটা ক্রিকেট বোর্ড কিংবা একটা গোটা ক্রিকেট জাতি।
এই মাস দুয়েক আগে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট জয়। বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে নতুন বার্তার জানান দেয়া। তবুও এবার যখন বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকা যাচ্ছে, তাও তাঁদের সবচেয়ে প্রিয় ফরম্যাটে। সমালোচকরা নাক সিটকেছে। বাংলাদেশ যে অন্তত একটা ম্যাচ জিততে পারে সেই বিশ্বাসটাও ছিল না। তাতে তাসকিনরা থোরাই কেয়ার করেন। তাঁরা বিশ্বাস আদায় করে নিতে পারেন, আকাশটাকে ছুঁয়ে ফেলতে পারেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার এই দুর্গ ভেদ করার সাহস কজনই বা দেখতে পারে। এই কিছুদিন আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে ভারতের মত দল নাকানি চুবানি খেয়েছে। প্রোটিয়া দুর্গে ফ্রন্টলাইনটাও ভাঙতে পারেনি। তবে বাংলাদেশের ছেলেরা সাহস দেখিয়েছে, চোখে চোখ রেখে লড়াই করেছে। শুধু এই ইতিহাসটা গড়বে বলে প্রতিটা ক্রিকেটার নিজেদের মাঠে নিঙরে দিয়েছে।
মাঠের বাইরেও তো যুদ্ধটা কম হয়নি। নিজের মা ও সন্তানরা হাসপাতালের বিছানায়। স্ত্রীও অসুস্থ। খুব করে পরিবারের পাশে থাকা প্রয়োজন। সাকিবও টিকিট কেটে ফেললেন এই ম্যাচটা না খেলেই ফিরে আসার। তবে শেষ মুহূর্তে কী একটা অদৃশ্য শক্তি তাঁকে টেনে ধরলো। কী একটা কিছু পাওয়ার নেশায় সাকিব থেকে গেলেন দলের সাথে। এই ত্যাগ সাধারণ কোন মানুষ করতে পারেনা, আমরা পারিনা, সাকিব পারে। এজন্যই বোধহয় তিনি সাকিব।
সাকিব জানতেন এই একটা জয় দেশের ক্রিকেটের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ন। জয়টা ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশকে নতুন সম্মান এনে দিতে পারে। যে বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকাকে কখনো তাঁদের মাটিতে হারাতেই পারেনি সেই বাংলাদেশই একটা সিরিজ জয় করে ফেললো। দাপটের সাথে, একেবারে বাঘের মত।
এই সাফল্যের সবচেয়ে বড় নায়ক তাসকিন আহমেদ। মাঠে তিনি গর্জে উঠেছেন, মাঠের বাইরে রেখে গেছেন এই অবিশ্বাস্য ত্যাগের নজির। তিন বছর আগেও বিশ্বকাপ দল থেকে ছিটকে গিয়েছিলেন ইনজুরির অযুহাতে। সেখান থেকে নিজের যোগ্যতায় ফিরে এসেছেন, কঠিন পরিশ্রম করেছেন।
পরশু সকালেই আইপিএল থেকে প্রস্তাব এলো। পুরো মৌসুমের জন্য তাসকিনকে চায় তাঁরা। কত বড়ে মঞ্চের হাতছানি। একটা ক্রিকেটারের স্বপ্নের জায়গা। তাসকিন সেই মঞ্চকেও ত্যাগ করেছেন। নিজের পুরোটা জমা করে রেখেছেন এই ম্যাচটার জন্য, লাল সবুজের জার্সি গাঁয়ে একটা ইতিহাস লিখার জন্য।
তাসকিনের স্বপ্ন এবার সত্যি হয়েছে। প্রথম ম্যাচেও বাংলাদেশের জয়ের অন্যতম নায়ক ছিলেন। যখনই প্রয়োজন হয়েছে উইকেট এনে দিয়েছেন। তবে আজ আর তাসকিন ছাড়া সেঞ্চুরিয়নে কোন আলোক রশ্মি ছিলনা। পাঁচ উইকেট নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার অভেদ্য সেই দুর্গ তচনচ করেছেন। তাসকিন জানান দিয়েছেন তিনি কতটা ভয়ংকর, তিনি কত বড় ক্রিকেটার।
শুধু সাকিব, তাসকিনই নয়। বাংলাদেশ দলের প্রতিটা ক্রিকেটার নিজের দায়িত্বটুকু পালন করেছেন। প্রয়োজনের সময় জ্বলে উঠেছেন। ইয়াসির আলী রাব্বির মত নবীনতম সদস্যও দলের হাল ধরেছেন। নিজেকে চিনিয়েছেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছেন।
শরিফুল ইসলামের মত একুশ বছর বয়সী পেসার প্রোটিয়া ব্যাটসম্যানদের সামনে ভয় পেয়ে যাননি। বরং দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং লাইন আপে কাঁপন ধরিয়েছেন। তাসকিন আহমেদকে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছেন। তাঁর শরীরি ভাষায় প্রতিপক্ষের সমীহ আদায় করে নিয়েছেন।
বিদেশের মাটিতে মিরাজের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। মিরাজ সেসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। কখনো বল হাতে, কখনো ব্যাট হাতেও। মনে করিয়ে দিয়েছেন মিরাজ ইজ অ্যা জেনুইন অলরাউন্ডার। লিটন দাস নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি যেন পন করেছেন যেখানেই তাঁকে নিয়ে যাওয়া হোক, যাদের সাথেই খেলা হোক রান করাটাই তাঁর একমাত্র কাজ।
এই ইতিহাসে রচনার পিছনে বড় অবদান ছিল অধিনায়কেরও। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারেননি, তবে তাঁর অধিনায়কত্ব মনে ধরেছে। আজ ব্যাট হাতে তামিমও সাধ মিটিয়েছেন। ফিরে আসার কাব্য লিখেছেন, দলকে জিতিয়ে তবেই মাঠ ছেড়েছেন। কঠিন সব দুর্গ জয় করেই চলেছেন, বিশ্বজয়েরও স্বপ্ন দেখাচ্ছেন।