একটা প্রশ্ন করি, আপনার মতে বর্তমান সময়ের অন্যতম উপভোগ্য এবং জমজমাট ফ্রাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট লিগ কোনটি? উত্তর যাই হোক, ধরে নেই ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগই (আইপিএল) সেরা।
আপনি এটা তো মানবেন যে অন্তত ভারতীয় ক্রিকেটের প্রেক্ষাপটে আইপিএল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক টুর্নামেন্ট। এখান থেকেই ভারতের ভবিষ্যতের খেলোয়াড়দের খুঁজে নেওয়ার একটা প্রক্রিয়া চলে তা মানতে নিশ্চয়ই আপনার বা আমাদের কারই দ্বিধা হওয়ার কথা নয়।
হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে এমন দূরত্বে অবস্থান করছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আরও একটি আসর। সেই আসরকে সামনে রেখে নিশ্চয়ই ভারত জাতীয় দলের নির্বাচকেরা নিজেরদের দলের একটা রুপরেখা সাজিয়ে ফেলতে চাইবেন এবারে আইপিএলের পারফর্মেন্সের উপর ভিত্তি করে। সুতরাং প্রতিটি খেলোয়াড় নিজেদের সেরাটা দিয়ে কেটে নিতে চাইবে বিশ্বকাপের টিকিট। সেদিক থেকে বেশকিছু খেলোয়াড়দের পরীক্ষা মঞ্চ এবারের আইপিএল।
- তিন নম্বরে কি বিরাট কোহলিই সেরা?
ভারতের বর্তমান সময়ে অন্যতম সেরা ব্যাটার বিরাট কোহলি। এ নিয়ে সন্দেহ, দ্বিধা কিছুই থাকার কথা নয়। তবে একটা প্রশ্ন নিশ্চয়ই মনের গহীন থেকে উঁকি মারা স্বাভাবিক, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট তিন নম্বর ব্যাটিং পজিশনে বিরাটই কি সেরা? এমন প্রশ্ন আসার প্রধান কারণ বিরাটের ‘ব্যাটিং অ্যাপ্রোচ’। বিরাট সাধারণত একটু রয়ে সয়ে ইনিংস শুরু করেন। তবে বর্তমান টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সেই ধীরস্থির ব্যাটিং পরের দিকের ব্যাটারদের উপর একটা বাড়তি চাপের সৃষ্টি করে।
আর অস্ট্রেলিয়ার পিচগুলো সাধারণতই ব্যাটিং স্বর্গ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। রান হবে প্রচুর। কিন্তু তিন নম্বরে ব্যাট করতে নেমে যদি কালক্ষেপন করে ফেলেন বিরাট তাহলে হয়ত আশানুরুপ রান তুলতে পারবে না ভারত। তাছাড়া সুরিয়াকুমার যাদব ও শ্রেয়াস আইয়ারে মতো ব্যাটারদের উপর বাড়তি রান তোলার চাপে তাঁদের পারফর্মেন্সেরও ব্যাঘাত ঘটতে পারে। তাছাড়া শেষের দিকে ‘বিগহিট’ করা খেলোয়াড়দের অভাব রয়েছে ভারতের।
সুতরাং বিরাট খুব একটা সময় হয়ত ব্যয় করা বিলাসিতা করতে পারবেন না। আর নিজেকে বদলে ফেলার সবচাইতে মোক্ষম মঞ্চ হতে পারে এবারের আইপিএল। নিজের সামর্থ্যের পূর্ণ প্রমাণ দিয়ে নিজেকে যোগ্য তিন নম্বর ব্যাটার হিসেবে প্রমাণ করেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের টিকিট কাটবেন বিরাট কোহলি, এমনটাই হয়ত প্রত্যাশা করেন বিরাটের ভক্ত-সমর্থকেরা।
- রোহিত শর্মার সঙ্গী কে হবেন?
গেল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে রোহিত শর্মার ব্যাটিং পারফর্মেন্সের উপর অনেকটাই নির্ভর করেছিল ভারতের সার্বিক ব্যাটিং প্রদর্শন। তাছাড়া বর্তমান সময়ে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে তাঁর বিকল্প খোঁজাটা বেশ একটা কষ্টসাধ্য কাজ। তাঁকে হঁটিয়ে এই মুহূর্তে ভারতের ব্যাটিং ইনিংস শুরু করবার মতো খেলোয়াড় নেই বললেই চলে। তবে সবচেয়ে বড় এক দ্বিধা হচ্ছে তাঁকে সঙ্গ দেওয়ার মত যোগ্য ব্যাটার খোঁজা।
লোকেশ রাহুল নিজেকে ওপেনিং এ প্রমাণ করেছেন। তাছাড়া তিনি প্রথম থেকেই পুরোদস্তুর আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করতে পারেন সে প্রমাণও রেখেছেন গতবারের আইপিএলে। বাড়তি কোন চাপ না থাকলে তিনি অনায়াসে মারকুটে এক ইনিংস খেলে ফেলতে পারেন। আবার তাঁর সাথে লড়াই করে একাদশে জায়গা করে নেওয়ার জন্যে মুখিয়ে আছে তরুণ ক্রিকেটার ঈশান কিষাণ। মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সে রোহিতের নিয়মিত সঙ্গী ঈষানের হাতেও বেশ শক্তি রয়েছে।
তাছাড়া একেবারে শুরু থেকেই তিনি এক্সিলারেট করার সক্ষমতা রাখেন। তবে এটা দেখার বিষয় অস্ট্রেলিয়ার বড় মাঠে এবং বিশ্বসেরা সব পেসারদের বিপক্ষে কেমন পারফর্ম করার ক্ষমতা নিজের মধ্যে ধারণ করেন কিষাণ। সেটা তাঁকে প্রমাণ করতে হবে আইপিএলে। তবে সে দিক বিবেচনায় রাহুল প্রথম পছন্দ। আবার পৃথ্বি শয়ের কাছ থেকেও যদিও ধারাবাহিক দূর্দান্ত পারফর্মেন্সের দেখা মিললে আরও একজন প্রতিযোগি বেড়ে যাবে।
- ভুবনেশ্বর কুমার নাকি দীপক চাহার?
ভারত জাতীয় দলের এখন সম্পদ জাসপ্রিত বুমরাহ ও মোহাম্মদ সামি। তাঁদের দুইজনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। এখনই তাঁদের বদল হয়ত ঘটবে না। ভারতের নির্বাচকদের এখন প্রথম মাথা ব্যথার বিষয় একজন সুইং বোলার। সেদিক থেকে ভুবেনেশ্বর কুমার ও দীপক চাহারের মধ্যে একটা স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা হতে চলেছে এবারের আইপিএলে। নতুন বলে সুইং করানো একটা মোক্ষম বিষয়। সেদিকটা দীর্ঘদিন ধরেই সামাল দিচ্ছিলেন ভুবনেশ্বর কুমার। তবে ক্রমশ তাঁর ধার কমেছে।
অন্যদিকে গত মৌসুমে দীপক চাহার নতুন বলে তাঁর ম্যাজিক দেখিয়েছেন। ব্যাটারদের সুইংয়ে কাবু করেছেন বহুবার। সেই সাথে তাঁর ব্যাটটাও দারুণ চলে। সেদিক বিবেচনায় বাড়তি একজন ব্যাটারও পেয়ে যেতে পারে ভারত। তবে নিশ্চয়ই খুব সহজেই ভুবনেশ্বর তাঁর জায়গাটা ছেড়ে দিতে চাইবেন না। এই দু’জনকে হটিয়ে আবার শার্দুল ঠাকুরের দলে জায়গা পাওয়ার একটা সুযোগ হয়ে গেলেও যেতে পারে।
তবে শার্দুল ঠাকুরকে এবারের পুরো আইপিএলেই থাকতে হবে ছন্দে। তাছাড়া পুরো মৌসুম জুড়েই নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। ব্যাট ও বল হাতে যদি শার্দুল অসাধারণ পারফর্ম করতে পারেন তবে তাঁরও হয়ত সুযোগ হতে পারে বিশ্বকাপ দলে জায়গা করে নেওয়ার। এখন আইপিএলে ম্যাচ গড়ালে সকল প্রশ্নের উত্তর ক্রমশ স্পষ্ট হবে।
- স্পিন ধাঁধাঁ
প্রথমত বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হতে চলেছে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে। সেখানের কন্ডিশন সবসময়ই পেসারদের পক্ষে কথা বল। তেমন এক কন্ডিশনে স্পিনারদের ভূমিকা কি থাকবে এবং তাঁদের কাছে প্রত্যাশাই বা কি থাকবে সেদিকটা আগেভাগেই নিশ্চিত হয়ে নেওয়া উচিৎ। সাধারণত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে স্পিনারদের দলে রাখা হয় ব্রেক-থ্রু এনে দেওয়ার পাশাপাশি রানের গতি কমিয়ে দ্রুত বেশ কয়েকটি ওভার করে ফেলা। সেদিক থেকে এগিয়ে থাকছেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন।
আবার অন্যদিকে লেগ স্পিনার যুজবেন্দ্র চাহাল ও চায়নাম্যান কুলদ্বীপ যাদবও রয়েছেন এই তালিকায়। তাঁদের মধ্যেও রয়েছে উইকেট তুলে নেওয়ার সক্ষমতার পাশাপাশি রান আটকে রাখার দক্ষতা। অন্যদিকে আবার তরুণ রবি বিষ্ণয় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ খুঁজছেন। তাঁর মধ্যে সে সম্ভাবনাও রয়েছে দলকে দীর্ঘ সময় সার্ভিস দেওয়ার। গেল আসরে দলে নেওয়া স্পিনার রাহুল চাহার ও বরুণ চক্রবর্তীদের সুযোগ খানিক ক্ষীন।
এত এত স্পিন বোলারদের মাঝে থেকে ভারতকে খুঁজে নিতে হবে যোগ্য খেলোয়াড়কে। আর এই খেলোয়াড়দেরকে নিজেদের প্রমাণ করতে হবে আইপিএলের মত বড় মঞ্চে। যেখানে বিশ্বের নানান প্রান্তের খেলোয়াড়দের বিপক্ষে খেলার সুযোগ তৈরি হয়। স্পিনে এই জটিল ধাঁধাঁর উত্তর খুঁজতে একটু বেগ পোহাতেই হবে নির্বাচকদের।
- পাওয়ার হিটার হবে কে?
সজোরে ব্যাট চালানোর মত সক্ষমতা রয়েছে এমন খেলোয়াড়দের কদর রয়েছে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে। আর তাছাড়া শেষের দিকে হাতখুলে খেলার মত খেলোয়াড়দের বেশ প্রয়োজন রয়েছে। ম্যাচ শেষ করে আসা এবং ‘পাওয়ার হিট’ করতে পারা একজন মাত্রই খেলোয়াড় রয়েছেন ভারতের রাডারে, তিনি ঋষাভ পান্ত। তবে এর আগে হার্দিক পান্ডিয়াকে পাওয়ার হিটার ভাবা হলেও নির্বাচকরা নতুন করে তাঁকে একজন অলরাউন্ডার হিসেবেই ভাবতে চাইছে।
এখন পাওয়ার হিটার কিংবা ফিনিশার যাই হোক না কেন সেদিক থেকে ভেঙ্কেটেশ আইয়ার হতে পারে একজন বিকল্প। অন্যদিকে শাহরুখ খানও বেশ সম্ভাবনার দ্যুতি ছড়িয়েছেন গেল আইপিএলে। এবারের আইপিএলে এই সব ব্যাটাররা কত উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেন নিজেদেরকে সেটাই এখন দেখবার বিষয়।
- বুমরাহের সাথে কে বাঁধবেন জুটি
স্লগ ওভারে ভারতের বোলিং আক্রমণের অন্যতম অস্ত্র জাসপ্রিত বুমরাহ। তিনি বরাবরই ইনিংসের শেষভাগে দূর্দান্ত বোলিং করেন। আর তাঁর বলের গতির তারতম্য ও একেবারে অপ্রতিরোধ্য ইয়োর্কারগুলো যেন প্রতিপক্ষের জন্যে এক একটি বিষ মিশ্রিত তীর। তবে তাঁর এমন বিষাক্ত বোলিংয়ের সাথে অপরপ্রান্ত থেকে আরও বিষিয়ে তোলার ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকছেন মোহাম্মদ সামি ও হার্শাল প্যাটেল।
তবে এই দু’জনের মধ্যে শেষমেশ কে টিকে থাকবে তা নির্ভর করবে এবারে আইপিএলের পারফর্মেন্সের উপর। ভাল-খারাপ এসবকিছুই তারতম্য গড়ে দেবে। তাছাড়া আগের মৌসুমের দ্যুতি যদি হার্শাল আবার ফিরিয়ে না আনতে পারেন তবে অন্যকেউ হয়ত তাঁর পরিবর্তে অনায়াসে জায়গা করে নেবে অস্ট্রেলিয়াগামী বিমানে। তাছাড়া আবার অজি কন্ডিশন মাথায় রেখে বাড়তি একজন পেসার নিয়ে উড়াল দিতেও পারে ভারত।