বাংলাদেশের ফুটবল এখন হতাশার আরেক নাম। যেখানে প্রত্যাশা আছে, কিন্তু নেই প্রাপ্তি। এই দুই বার্কের ফারাক এখন অনেক। যেখানে কোনভাবেই সম্মিলন ঘটানো যাচ্ছেনা। একটার পর একটা টুর্নামেন্ট খেলছে কিন্তু শিরোপা জেতা সম্ভব হচ্ছেনা। এছাড়া ফিফা আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচেও আসছেনা সাফল্য। যেমন করে আসেনি সর্বশেষ মালদ্বীপের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচেও।
২-০ গোলে পরাজিত হয়ে আজকে মঙ্গোলিয়া ম্যাচের দিকে তারিয়ে রয়েছে জামাল ভুইয়ার দল। এই দুটি ম্যাচের আগে কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় হ্যাভিয়ের কাবরেরাকে। বেশ কয়েকটা পরিবর্তন এনে আশানুরুপ ফুটবল খেলতে পারেনি মালদ্বীপে। অথচ একটা সময় হালি হালি গোল দিত দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে। আর সেই দলটির বিপক্ষে এখন জয় পাওয়া হয়ে গেছে অনেক বড় ব্যপার।
তাইতো মালদ্বীপের বিপক্ষে প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার ক্ষতটা মুছতে চায় মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে। সিলেচ জেলা স্টেডিয়ামে বিকাল সাড়ে পাঁচটায় মাঠে নামবে দুই দেশ। ফিফা আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ হলেও বাংলাদেশের জন্য বিশেষ গুরুত্বের ম্যাচ এটি। বিশেষ করে কোচ কাবরেরার কাছে প্রথম জয়ের ম্যাচ হতে পারে এটি। বাংলাদেশ যেখানে জয় চায়, সেখানে মঙ্গোলিয়া চাইছে ড্র করতে। যেহেতু ঘরের মাঠে খেলা সেহেতু জয়েল কোন বিকল্প নেই বাংলাদেশ দলের সামনে।
খেলোয়াড়রাও কোচকে জয় উপহার দিতে চান। আর বাংলাদেশ দলও ফিরতে চায় জয়ের ধারায়। ২০০১ সালে পর দীর্ঘ ২১ বছরের বিরতি দিয়ে প্রথম মুখোমুখি হবে দল দুটি। ইতিহাসে এবারই প্রথমবার লাল সবুজ খেলবে ফিফা র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের চেয়ে দুই ধাপ এগিয়ে থাকা দলটি। বাংলাদেশ যেখানে ১৮৬ নাম্বারে সেখানে মঙ্গোলিয়া রয়েছে ১৮৪ তে। সিলেটে মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে মাঠে নামার আগে সুখ স্মৃতি নেই বাংলাদেশ দলের সামনে।
মালদ্বীপে গিয়ে জয়ের প্রত্যয় ব্যক্ত করেও হেরে এসেছে জামাল ভুইয়ার দল। এমন অবস্থায়, ঘরের মাঠে ভালো খেলে দর্শকদের জয় উপহার দিতে চায় স্বাগতিক দলের খেলোয়াড়রা। ম্যাচের আগে করা সংবাদ সম্মেলনে এমন কথা জানিয়ে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক বলেছেন, ‘সবাই প্রত্যেকটা ম্যাচই জয়ের জন্য খেলতে নামে। সিলেটের এই স্টেডিয়ামটিতে খেলা আমি সবসময় পছন্দ করি। মনে হয়, সবসময় দর্শকরা খুব কাছে থাকে এখানে। আমরা সবাই চাই দর্শক মাঠে আসুক, আমরা তাদের ভালো খেলা উপহার দিয়ে জয় নিয়ে ঘরে ফিরতে চাই।’
এখন পর্যন্ত সিলেটে এই মাঠে চারটি ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ দল। যেখানে জয়-হারের সংখ্যাটা একেবারে সমান সমান। ২০১৫ সালে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে মালয়েশিয়ার কাছে হারের পর শ্রীলংকার বিপক্ষে জিতেছিল দল। এরপর কয়েক বছরের বিরতি পড়ে।
২০১৮ সালে লাওসের বিপক্ষে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপেই জয়ের পর ফিলিস্তিনের কাছে হেরে গিয়েছিল বাংলাদেশ। এবার সেই পরিসংখ্যানকে পেছলে ফেলে এগিয়ে যেতে চায় দল। মালদ্বীপের কাছে হেরে হতাশ হলেও ঘরের মাঠে খেলার সুবিধা কাজে লাগিয়ে, মঙ্গোলিয়া চ্যালেঞ্জ জেতার আত্ববিশ্বাসের কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। পরিবর্তন আনা হয়েছে খেলার ধরনে। মালেতে খেলা ৪-৪-২ ফরমেশনে সাফল্য মেলেনি। তাইতো সিলেটের অনুশীলনে ৪-১-৪-১ ফরমেশনে দলকে পরখ করেছেন কোচ কাবরেরা।
যদিও কৌশল নিয়ে মুখ খোলেননি ৩৭ বছর বয়সী এই স্প্যানিশ কোচ। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন নতুন ছকে খেলার। মঙ্গোলিয়া ম্যাচ নিয়ে কাবরেরা বলেন, ’শুধু হারলেই সবকিছু নৈতিবাচক হয়ে যায়না। মালের ম্যাচের ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে ভাবছি। যদি মালদ্বীপ ম্যাচের কথা ধরা হয়, আমাদের কতগুলো ইতিবাচক দিক ছিল, যেগুলো আমাদের পরিকল্পনার সঙ্গে মিলে এই ম্যাচের জন্য কাজে লাগাতে হবে। রক্ষণভাগ ভালো থাকলেও দ্বিতীয়ার্ধে বিল্ডআপ ফুটবল খেলতে পেরেছি। কিছু ভালো আক্রমণ করতে পেরেছি, তবে গোলের সুযোগগুলোকে কাজে লাগাতে পারিনি। আজকের ম্যাচে জন্য এই ভুলগুলো যাতে না হয় সেভাবেই ফুটবলারদের বলেছি।’ দুই দশকেরও বেশি সময় আগের দুই দেখায় বাংলাদেশের প্রাপ্তির পরিমানই বেশি।
প্রথম ম্যাচে স্ট্রাইকার আলফাজ আহমেদের জোড়া গোলে ৩-০ গোলে জিতেছিল লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। বাছাইয়ের ফিরতি লেগ ২-২ গোলে ড্র হয়েছিল। এরপর নিজেদের সবশেষ ম্যাচে হারের তেতো স্বাদ পেয়েছে দুই দলই। লাওসের বিপক্ষে ১-০ গোলে হেরে এসেছে মঙ্গোলিয়া আর মালদ্বীপে প্রীতি ম্যাচে বাংলাদেশের হার ২-০ ব্যবধানে। সে হিসেবে সর্বশেষ ম্যাচে পরাজিত দুই দল আজকে খেলতে নামছে।
দীর্ঘ ২১ বছর পর দুই দেশ লড়ছে। বাংলাদেশ কি পারবে ঘরের মাঠে জিতে সম্মান রক্ষা করতে? শুরুতে ড্রয়ের কথা বরলেও মঙ্গোলিয়ার জাপানি কোচ ইচিরো ওসোকার লক্ষ্য জয়। সেটা যে অসম্ভবও নয়, তা অনেকেই জানেন। বাংলাদেশের মতো দেশটির ঘরোয়া ফুটবলে বাংলাদেশের মতো এত টাকার ঝনঝনানি নেই। বাংলাদেশের শীর্ষ ফুটবলাররা যেখানে বছরে ৬০-৭০ লাখ টাকা পান ক্লাব থেকে, সেখানে ১৯৯৮ সালে ফিফার পূর্ণ সদস্যপদ পাওয়া মঙ্গোলিয়ার একজন শীর্ষ ফুটবলার ক্লাব থেকে মাসে বেতন পান সর্বসাকুল্যে ৫০০-৬০০ ডলার। অর্থাৎ মাসে ৫০ হাজার টাকা আয় করে বছরে ছয় লাখ টাকার মতো আয় হয়। অথচ এই টাকা বাংলাদেশের অনেকে খেপ খেলেই আয় করতে পারেন। যদিও আজকের ম্যাচে এসব নিয়ে ভাবনা নেই মঙ্গোলিয়ার।
এর আগে সিঙ্গাপুরে পেশাদার লিগে একটি ক্লাবের প্রধান কোচ ছিলেন ইচিরো। দুই মাস আগে তিনি দায়িত্ব নেন মঙ্গোলিয়া জাতীয় দলের। দল নিয়ে অনেক অসন্তুষ্টি থাকলেও তাঁর লক্ষ্য বাংলাদেশকে কিন্তু হারানো। নিজেই সেই প্রত্যাশার কথা বলেছেন, ‘আমরা ২৪ মার্চ লাওসের কাছে তাদেরই মাঠে ১-০ গোলে হারলেও ছেলেরা ভাল ফুটবল খেলেছে। তবে সিলেটে জিততেই এসেছি, একথা জোর দিয়েই বলবো। আমরা চাই মঙ্গোলিয়ার জাতিগত ফুটবলটা আজকের ম্যাচে খেলতে।’
মঙ্গোলিয়া মানে পৃথিবীর ১৬তম বৃহত্তম দেশ হলেও জনসংখ্যা মাত্র ৩৬ লাখ। তুষারাবৃত এই দেশে জনপ্রিয়তার পারদে ফুটবল থাকবে ৩-৪ নম্বরে। তবে ভুলে গেলে চলবে না এই ফুটবলাররা চেঙ্গিস, হালাকু খানের বংশধর হিসেবে সারা দুনিয়ায় পরিচিত। বরফাচ্ছাদিত পাহাড় পেরিয়ে চেঙ্গিস, হালাকু খানরা একসময় বেরিয়ে পড়তেন দিগ্নিজয়ে। মঙ্গোলিয়ার ফুটবল দলও এখন বেরিয়ে পড়েছে সিলেট জয়ের মিশন নেয়। সেখানে বাংলাদেশ হতে পারে তাদের শিকার।
বাংলাদেশ ফিফার সদস্য হয়েছে সেই ১৯৭৬ সালে। আর মঙ্গোলিয়া ফিফার সদস্য হয়েছে ১৯৯৮ সালে।
১৯৬০ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মঙ্গোলিয়া কোনো আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচও খেলেনি। ১৯৯৮ সালে ফিফার সদস্য লাভের পর এশিয়ান গেমস ফুটবলের বাছাইয়ে খেলার সুযোগ পেয়ে কুয়েতের কাছে ১১-০ এবং উজবেকিস্তানের কাছে ১৫-০ মিলিয়ে দুই ম্যাচে ২৬ গোল হজম করে। ২০০২ সালে দক্ষিণ কোরিয়া-জাপান যৌথভাবে এশিয়ায় বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন হয়।
এই বিশ্বকাপের বাছাইয়ের খেলায় ৫ ম্যাচ হেরে বাংলাদেশের বিপক্ষে ড্র করে প্রথম পয়েন্ট পেয়েছিল মঙ্গোলিয়া। এরপর প্রথম ম্যাচে তিন গোলের মধ্যে দুটি করেছিলেন আলফাজের এবং একটি রোকনুজ্জামান কাঞ্চনের। ২-২ গোলে ড্র হওয়া ম্যাচের দুই গোলই আবার ডিফেন্ডার মোহাম্মদ সুজনের। দীর্ঘ ৩ বছর পর দর্শকপূর্ণ গ্যালারি বাংলাদেশকে উজ্জীবিত করবে বলেই বিশ্বাস। সেক্ষেত্রে একটা জমজমাট ম্যাচের অপেক্ষা এখন।