অন্য যেকোন দলীয় খেলার তুলনায় ক্রিকেটে একজন অধিনায়কের দায়িত্ব বা ভূমিকা বেশি লক্ষ্য করা যায়। ফুটবল, হকি কিংবা অন্যান্য খেলাগুলোতে একজন অধিনায়কের খুব বড় কোন ভূমিকা না থাকলেও ক্রিকেটে অধিনায়ককেই মাঠ এবং মাঠের বাইরে দলের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলো পালন করতে হয়। ফুটবল কিংবা হকির দিকে তাকালে দেখা যায় সেখানে একজন অধিনায়ক মাঠে শুধু ‘মোটিভেটর’ হিসেবে কাজ করে থাকেন।
এসব খেলায় কোচই হলেন একটি দলের সর্বেসর্বা। সেখানে একজন কোচের কাজ কেবল মাঠে নামার আগে খেলোয়াড়দের রণকৌশল সাজিয়ে দেবার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং খেলা চলাকালীন সময় মাঠের পার্শ্বরেখার বাইরে থেকে খেলোয়াড়দের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেয়াও তাঁর দায়িত্বের মধ্যে বর্তায়। এখানে তিনিই সবচেয়ে বড় ‘ডিসিশন মেকার’। ম্যাচের আগে একাদশ নির্বাচন থেকে শুরু করে ম্যাচের সময় পার্শ্বরেখার বাইরে থেকে খেলোয়াড়দেরকে বাতলে দেয়া তাঁর কিছু পরিকল্পনা ম্যাচে অভাবনীয় প্রভাব ফেলে।
ফুটবল কিংবা হকিতে পুরো ম্যাচজুড়ে মাঠের সীমারেখার বাইরে দাঁড়িয়ে খেলোয়াড়দের অনুপ্রেরণা জোগানোর পাশাপাশি ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনায় খেলোয়াড় বদলানো, কারো কারো খেলার ধরণ বদলানো বা পজিশন বদলানোর নির্দেশনা দিয়ে ম্যাচের চিত্র পুরোপুরি পাল্টে দেয়ার দায়িত্বে থাকেন একজন কোচ, দলের অধিনায়ক নন।
কিন্তু ক্রিকেটের ক্ষেত্রে কোচের চেয়ে অধিনায়কের ভূমিকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। ফুটবলের মত ক্রিকেটেও দলীয় কোচ প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তা ও দুর্বল দিক, প্লেয়িং কন্ডিশন বিবেচনা করে রণকৌশল সাজান। আর মাঠে তা প্রয়োগ করেন অধিনায়ক। এমনকি ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে মাঠের অধিনায়ককেই যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ক্রিকেটে ম্যাচ শুরুর আগে কোচের যথেষ্ট ভূমিকা থাকলেও টসের পর পুরো দলের দায়িত্বে থাকেন দলটির অধিনায়ক। ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনায় মুহূর্তের মধ্যে তাকে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়।
ব্যাটসম্যানের গতিবিধি লক্ষ্য করে ফিল্ডারদের জায়গামত দাঁড় করানো থেকে শুরু করে বুদ্ধি খাটিয়ে বোলিং পরিবর্তন করা, সময়মত ইনিংস ঘোষণা দেয়া ইত্যাদি দায়িত্ব তাকেই একা পালন করতে হয়। এমনকি তাঁর এক একটা সিদ্ধান্তে মুহূর্তের মধ্যে ভোজবাজির মত পাল্টে যেতে পারে পুরো ম্যাচের দৃশ্যপট। সেজন্য অবশ্যই একজন ক্রিকেট অধিনায়ককে ক্ষুরধার মস্তিষ্কের অধিকারী হতে হয়।
তাছাড়া শুধু মাঠে নয়, মাঠের বাইরেও একজন ক্রিকেট অধিনায়কের দায়িত্ব কম নয়। দলের সবাইকে এক সুতোয় গাঁথা, সবাইকে সবসময় অনুপ্রাণিত করা ও উৎফুল্ল রাখা, দলের অনুজদের প্রতি স্নেহাশিস মনোভাব পোষণ করা সবই অধিনায়ককে ঠিক রাখতে হয়। এসব দিক বিবেচনায় ক্রিকেটে একজন অধিনায়কের গুরুত্ব লিখে শেষ করা যাবে না। আসলে ক্রিকেটে একটি দলের মেরুদন্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয় দলের অধিনায়ককে।
অদ্যাবধি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলেও মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করেছেন অনেক অধিনায়ক। যুগ যুগ ধরে বহু অধিনায়কের হাত ধরে সামনে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট। আকরাম খান থেকে শুরু করে নাইমুর রহমান,আমিনুল ইসলাম, খালেদ মাহমুদ, খালেদ মাসুদ, হাবিবুল বাশার, মোহাম্মদ আশরাফুল, মুশফিকুর রহিম সবাই বাংলাদেশ দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বর্তমানে যে দায়িত্ব পালন করছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা ও সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশ দল এদের আগেও অনেক অধিনায়কের নেতৃত্বাধীন ছিল। রকিবুল হাসান যেমন দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন সত্তরের দশকের দিকে। তবে বাংলাদেশ প্রথম যার নেতৃত্বে বাইশ গজে যাত্রা শুরু করে তিনি হলেন জনাব শামিম কবির। তিনিই ছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বপ্রথম অধিনায়ক।
শামিম কবির যিনি আনোয়ারুল কবির শামিম নামেও পরিচিত, ১৯৪৫ সালের চার এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন নরসিংদী জেলার ঘোড়াশালের মিয়াপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। পিতা আবু ইউসুফ লুৎফর কবির ও মা সুফিয়া খাতুনের চার ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে কনিষ্ঠ। মিয়াবাড়ির সেই কনিষ্ঠ ছেলেটি পড়ালেখার জন্য বেশিরভাগ সময়ই অবস্থান করত ঢাকায়। সেখান থেকেই মূলত ক্রিকেটে প্রবেশ তাঁর।
ছাত্রজীবনের শুরুতে চট্টগ্রামের সেন্ট প্লাসিড স্কুলে পড়ালেখা করলেও তিনি মেট্রিক পাস করেন পুরনো ঢাকার সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। মূলত ক্রিকেটে তাঁর যাত্রা শুরু এই স্কুলের হয়ে খেলার মাধ্যমেই। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া অবস্থায় আন্ত:স্কুল ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অভিষেক হয় তাঁর। টুর্নামেন্টের একটি ম্যাচে একজন উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান অনুপস্থিত থাকায় স্কুলের হয়ে প্রথমবারের মত খেলার সুযোগ পান তিনি।
খেলোয়াড়ি জীবনে একজন ওপেনিং ব্যাটসম্যান হিসেবেই পরিচিত ছিলেন শামিম কবির। সেই সাথে মাঝেমাঝে উইকেটের পিছনে গ্লাভস হাতেও তিনি দায়িত্ব পালন করতেন। ১৯৬১ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষিক্ত হওয়া শমিম কবির বাংলাদেশকে নিজেদের ইতিহাসের প্রথম ম্যাচে নেতৃত্ব দেন ১৯৭৭ সালে।
ইংরেজি বর্ষ ১৯৭৭ সালে পা দেবার ঠিক চার দিন আগে বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলতে টেড ক্লার্কের নেতৃত্বে ঢাকায় পা রাখে মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি)। পরে ১৯৭৭ এর ৭ জানুয়ারি শামিম কবিরের নেতৃত্বে নিজেদের ইতিহাসের প্রথম কোন ক্রিকেট ম্যাচ হিসেবে ৩ দিনের একটি ম্যাচ খেলতে ঐতিহ্যবাহী এমসিসির বিপক্ষে মাঠে নামে বাংলাদেশ। ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয় তৎকালিন ঢাকা স্টেডিয়ামে যেটা বর্তমানে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম হিসেবে পরিচিত।
সেদিন টস জিতে প্রথম ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন অধিনায়ক শামিম কবির। ব্যাট হাতে প্রথম ইনিংসে তিনি করেন ৩০ রান যা ছিল সেই ইনিংসে ব্যক্তিগত তৃতীয় সর্বোচ্চ। আর দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যক্তিগত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হিসেবে তিনি করেন ২৫ রান। তিন দিনের ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত ড্রয়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছিল।
জাতীয় দলের হয়ে খেলার আগে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে মাত্র ষোল বছর বয়সে ইস্ট পাকিস্তানের জার্সি গায়ে অভিষেক ঘটে শামিম কবিরের। অভিষেকের পর ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ব্যক্তিগত প্রথম হাফ সেঞ্চুরি পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হয় তিন বছর। ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে কারদার সামার ট্রফিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনায়ক হিসেবে পিআইএ এর বিপক্ষে খেলা ৬৪ রানের ইনিংসটি ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের প্রথম হাফ সেঞ্চুরি।
সেই মৌসুমে ব্যাট হাতে ভাল ছন্দে ছিলেন তিনি। এর আগের বছর আইয়ুব ট্রফিতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বের দায়িত্বে ছিলেন শামিম কবির। সেখানে ব্যাট হাতে ৪০ রান এবং গ্লাভস হাতে একটি স্ট্যাম্পিং ও দু’টি ক্যাচ ধরে ইস্ট পাকিস্তানের বিপক্ষে জয় তুলে নিতে অবদান রাখেন তিনি। ক্রিকেটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় ১৯৬৫ সালে তিনি সম্মানসূচক ব্লু পান। তাছাড়া ক্রিকেটের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে ফুটবল, হকি ও বাস্কেটবলেও পারদর্শীতার ছাপ রেখেছেন তিনি।
তারপর ১৯৬৬ সালে এমসিসির বিপক্ষে ইস্ট পাকিস্তান যুব দলের হয়ে খেলার সুযোগ পান শামিম কবির। পরের বছর হানিফ মোহাম্মদ, মোশতাক মোহাম্মদ ও ওয়াজির মোহাম্মদের শক্তিশালী করাচি হোয়াইট দলের বিপক্ষে তিন দিনের একটি ম্যাচে তাঁর নেতৃত্বেই জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়েও শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি ড্র করতে সক্ষম হয় ইস্ট পাকিস্তান।
ক্রিকেট ক্যারিয়ারে শামিম কবিরের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রান ৮৯ যেটা এসেছে ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে। ঢাকা স্টেডিয়ামে ইস্ট পাকিস্তানের হয়ে ইস্ট পাকিস্তান রেলওয়ের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটি খেলেন। সবমিলিয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে মোট ১৫ ম্যাচে ১৭.৮৬ গড়ে শামিম কবিরের সংগ্রহ ৪৪১ রান। তিনি ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি অনিয়মিত উইকেট কিপিংও করতেন। ক্লাব ক্রিকেটে আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়েই তিনি সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছেন।
শামিম কবির ক্রিকেট থেকে বিদায় নেন ১৯৭৬-৭৭ মৌসুমে। সেসময় ব্যাট-প্যাড তুলে রাখলেও ক্রিকেটের সাথে তাঁর যে সখ্যতা তাতে বিন্দুমাত্র ছেদ পড়েনি। অবসর গ্রহণের পর পরই তিনি ক্রিকেট ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িয়ে যান এবং উঠতি বাংলাদেশ ক্রিকেটের উন্নয়নে অবদান রাখতে শুরু করেন। ১৯৮২ ও ১৯৮৬ সালের আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশ দলের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। দীর্ঘ চার দশক ধরে তিনি ঢাকা ক্লাবের সদস্য ছিলেন।
১৯৮২ ও ১৯৮৩ সালে ক্লাবের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি নির্বাহী সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন বেশকয়েকবার। ক্রিকেটার ও সংগঠক হিসেবে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৯ সালে জাতীয় পুরস্কার পান শামিম কবির। তারপর ২০১৪ সালে গ্রামীণফোন প্রথম আলো আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হন তিনি। দেশের ক্রিকেটের পাশাপাশি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধেও তাঁর ভূমিকা ছিল। লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনে জাস্টিস আবু সাইদ চৌধুরীর সেক্রেটারি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি।
তাছাড়া ১৯৭৩ সালে খেলা চালিয়ে যাবার পাশাপাশি বিসিসিআই ব্যাংকের কম্পিউটার কনসালটেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন শামিম কবির। পরের বছর চা ব্যবসায় নিজেকে জড়ান তিনি। তারপর বাংলাদেশে ওটিস লিফট ও এক্সেলেটর সোল্ড ডিস্ট্রিবিউটরের কাজ করার পাশাপাশি দৈনিক সংবাদ পত্রিকার পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন।
শামিম কবির ৭৫ বছর বয়সে ২০১৯ সালে (২৯ জুলাই) ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে জীবন নদীর ওপারে চলে যান। বয়সের কাছে হার মেনে ক্রিকেট থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন অনেক আগেই। এখন তিনি উঠে গেলেন সকল হিসাব-নিকাশের উর্ধ্বে!