ওয়ার্ন: দ্য ম্যাজিক, দ্য থিয়েটার

পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন কিন্তু হঠাৎ মনে হয় ২২ গজে এখনও যেন ওয়ার্ন বল হাতে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন ওয়ার্ন। তিনি চলে গেলেও ক্রিকেট পাড়ায় এখনও তিনি প্রতিটি সমর্থকদের মনে গেঁথে আছেন। পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে ম্যাজিক্যাল সব ডেলিভারিতে ব্যাটারদের নাস্তানাবুদ করছেন। ওয়ার্ন নেই ঠিক, তবে ওয়ার্নের কীর্তি রয়ে গেছে ২২ গজের প্রতিটি কোনায়। বিশ্বের সেরা ব্যাটারদের কৌশলও পাত্তা পায়নি ওয়ার্নের ম্যাজিক্যাল বোলিংয়ের সামনে।

বিশ্বের বাঘা বাঘা ক্রিকেটারদের নাকানিচুবানি খাইয়েছেন বহুবার। ওয়ার্নকে খেলতে হিমসিম খেয়েছেন এমন ক্রিকেটার অসংখ্য। তবে এর মাঝে কিছু গ্রেট ক্রিকেটারদের ওয়ার্ন সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি –

সে সবসময়ই কিভাবে আপনাকে আউট করবে সেই পথ খুঁজে বের করতো – শচীন টেন্ডুলকার

১৯৯৮ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরটা ছিল ওয়ার্নের বিপক্ষে ভারতের প্রথম সিরিজ। সিরিজের মূল আকর্ষণই ছিল ওয়ার্ন বনাম টেন্ডুলকার! ওই সিরিজ নিয়ে ১০০এমবি নামক এক মিডিয়া সাক্ষাৎকারে শচীন বলেন, শেন ওয়ার্নের মত বিশ্বসেরা বোলারের বিপক্ষে খেলা! অবশ্যই আপনি কিছুটা চাপে থাকবেন। আপনাকে অবশ্যই সেরা প্রস্তুতিটা নিতে হবে। শুধু নেটের অনুশীলনেই নয়, ড্রেসিং রুমে থাকাকালীনও আপনাকে ভাবতে হবে তাঁর পরিকল্পনা কি? কারণ সে মাইন্ড গেইম খেলে চাপ তৈরি করতে জানে এবং আপনাকে আউট করার সর্বোচ্চ চেষ্টাই করবে। তাঁর শরীরি ভাষা দেখে বোঝার উপায় নেই সে চার উইকেট নিয়েছে নাকি পাঁচ উইকেট নিয়েছে নাকি সে উইকেটশূন্য ছিল। সে প্রতিটা বল করার সময় আগ্রাসী রুপে থাকে। তাই দিনের শেষ ওভার হোক কিংবা শেষ বল ব্যাটারকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হয়। সে সব সময়ই খুঁজতে থাকে কিভাবে আপনাকে আউট করা যাবে।

 

আমি আমার ক্যারিয়ারে অনেক স্পিনারকে খেলেছি। কিন্তু ওয়ার্ন একেবারেই ভিন্ন। সে খুব কম বোলারের একজন ছিলেন যাদেরকে আপনি চাইলেই হিট করতে পারবেন না। অনেক স্পিনারের বিপক্ষে আপনি চাইলেই সামনে গিয়ে আক্রমণাত্মক খেলতে পারবেন কিন্তু ওয়ার্ন এমন একজন যার বল কোথায় পিচ করবে কেমন টার্ন করবে সেটার ঠিক নেই!

আমি মনে করি এটাই তাঁর ক্লাস। সে যেভাবে বল ড্রিফট করে এটা বিশ্ব ক্রিকেটে খুব বেশি বোলার করতে পারে না। অনেক ভাল ভাল সেরা স্পিনার আছে কিন্তু নিঃসন্দেহে ওয়ার্ন সবার চেয়ে আলাদা। আমাকেও ওর বিপক্ষে খেলার জন্য ভিন্নভাবে অনুশীলন করতে হত। কারণ সে সময় কেউই রাউন্ড দ্য উইকেটে রাফ বল করতো না। রাউন্ড দ্য উইকেটে রাফ অথবা লেফট আর্ম ওভার দ্য উইকেটে রাফ বোলিংয়ে ব্যাটার রান বের করতে বেগ পায়। তাই ওয়ার্নের বিপক্ষে খেলার আগে আমাকে আমার রক্ষণাত্মক ও আক্রমণাত্মক খেলার অপশনগুলো নিয়ে প্রস্তুতি নিতে হত।

ওয়ার্ন সাদা বলের ক্রিকেটেও রাজা – মাহেলা জয়াবর্ধনে

ওয়ার্ন সম্পর্কে লঙ্কান কিংবদন্তি তারকা মাহেলা জয়াবর্ধনে বলেন, চাপ সৃষ্টি করার জন্য ওয়ার্ন সব সময় সেরা। আমি প্রথম তাঁকে খেলেছি ১৯৯৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হোম সিরিজে। ২০ বছর বয়সে ওয়ার্নকে মোকেবেলা করি। তখন সে ছিল তাঁর সেরা সময়ে। আমার জন্য এটা ছিল একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কখনও কখনও সে ব্যাটারকে রান করার সুযোগ দিয়ে ফিল্ডারদের কিছুটা সরিয়ে রেখে গ্যাপ তৈরি করে টোপ ফেলতো। কখনও আবার আক্রমণাত্মক ফিল্ড সাজাতো। আমার মনে আছে ক্যান্ডি টেস্টে যখন আমার রান চল্লিশের ঘরে সে মিডউইকেটে গ্যাপ রেখে আমার জন্য ফাঁদ পাতলো। সে ভেবেছিল আমি এই গ্যাপে তাঁকে মারতে যাব। কিন্তু এমন এক টার্নিং উইকেটে যেকোন ডান হাতি ব্যাটারের জন্যই এটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ শট।

টেস্টের প্রথম দিনে রক্ষণাত্মক ভূমিকায় থাকলেও চতুর্থ ও পঞ্চম দিনে হয়ে ওঠে আক্রমণাত্মক। আর দেখা যায় দলের মূল ভূমিকায় তখন সে থাকে এবং সে তাঁর কাজটা ঠিক করে ফেলে। তাঁর যে দক্ষতা বা টেম্পারমেন্ট, বুদ্ধিমত্তা এসব খুব কমই কারও মাঝে দেখা যায়। এমনকি সাদা বলের ক্রিকেটেও ওয়ার্ন রাজা ছিলেন। সে চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করতো। কারণ ব্যাটার রান বের করার চেষ্টা করতো এই ফরম্যাটে। আর এটাই তাঁর কাজ আরও সহজ করে দিত। ১৯৯৯ সেমিফাইনালের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। সে বড় ম্যাচে পারফর্ম করতে ভালবাসে।

ক্যারিয়ারের শেষ দিকে এসে সে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেও খেললো। যখন সে মূলত দক্ষতা দিয়ে নয় বরং মাথা খাটিয়ে উইকেট নিত! এটাও ভিন্ন রকম চ্যালেঞ্জ ছিল তাঁর জন্য। কারণ সে মাঠে ট্রল করতো কিংবা আপনার সাথে কথা বলে মনযোগ নষ্ট করতে চাইতো। সে সব সময়ই এমন অবস্থা তৈরি করে ব্যাটারকে চাপে ফেলতে চাইতো। আমার জন্য স্কিলের চেয়েও মানুষ হিসেবে ওয়ার্ন গুরুত্বপূর্ণ। সে একজন বিনোদনদাতা। সে আমাদের শিখিয়েছে কিভাবে নিজের জীবন উপভোগ করতে হয়। সে মাঠ এবং মাঠের বাইরে জীবন উপযোগ করেছে। ‘

তাঁর জন্য প্রত্যেকটা বলই একটা প্রতিযোগিতা – রাহুল দ্রাবিড়

দ্য ওয়াল খ্যাত ভারতের সাবেক অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড় বলেন – আমি যখনই তাঁর বিরুদ্ধে খেলতে নেমেছি, মনে হয়েছে সে আমাকে আউট করার কিছু একটা পরিকল্পনা আগেই করে রেখেছে। যখনি আপনি চিন্তা করবেন যে ডাউন দ্য উইকেটে গিয়ে মারবেন তখনি দেখবেন সে ফ্লিপার দিবে! যখনি ভাববেন এই বল সুইপ বা পায়ের ব্যবহার করে খেলতে হবে, সে এমন এক বল করবে যে আপনার জন্য ওই শট ঝুঁকিপূর্ণ হবে। এমন মনে হয় যেন সে সব জানে আপনি কখন কোন শট খেলবেন। এটা সব সময়ই একটা চ্যালেঞ্জ। ভাল বল করবে, ডট বল দিবে এবং চেষ্টা করবে চাপ সৃষ্টি করে উইকেট নেওয়ার। তাঁর মাথায় সব সময়ই ঘুরতে থাকে কিভাবে আপনাকে আউট করবে।

আমার কাছে ভারতের চেয়ে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ওয়ার্নকে খেলাটা বেশি চ্যালেঞ্জের। কারণে সেখানে অতিরিক্ত বাউন্স হয়, বল বাতাসে বেশি ড্রিফট করে! আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হল সে আমাকে আউট করার জন্য প্যাডে বল ফেলে। বল ড্রিফট করতে পারে বিধায় প্যাডে বল করলে আমি চেষ্টা করি সেগুলো না খেলার। ওয়ার্নের বল খেলতে আমি সামান্য কিছু সময় বেশি নেই অন্যান্য স্পিনারকে খেলার তুলনায়। যদি এসব কৌশল সব সময় কাজ করে না। আমি খেলেছি এমন স্পিনারদের মধ্যে সে একমাত্র যার বল ড্রিফট করতো।

সে লেগ স্পিনে অনেক টার্ন করাতে পারতো। অফ স্টাম্পে পিচ করিয়ে টার্ন করাতো। সে হঠাৎ এমন করতো। আপনি খেলতে খেলতে একটা পর্যায়ে দেখবেন হয়তো মিডল স্টাম্পে এক বল করছে, আবার অফ স্টাম্পে করছে আবার প্যাডে বল করছে। ওয়ার্নির হলমার্ক হল প্যাডের আশেপাশে বল করা। আমরা দেখেছি মাইক গ্যাটিংকে আউট করা বল, ২০০৪ সালে ব্যাঙ্গালুরুতে ভিভিএস লক্ষ্মণকে আউট করা বলটিও দেখেছি সবাই। ওয়ার্নের জন্য প্রতিটি বলই একটি প্রতিযোগিতা। এটা শুধু ধৈর্য্যের খেলা না। অনেকবার এমন হয়েছে শুধু ডট বল আর মেইডেন দিয়েই চাপ সৃষ্টি করেছে।

ওয়ার্নি ডট আর মেইডেন দিয়ে চাপে ফেলতে পারে না এমন নয়। ২০০৪ সালে ভারতের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার পেসাররা বেশ ভাল বল করছিল। সেখানে ওয়ার্ন শুধু ডট আর মেইডেন দিয়েই রান আটকে রাখছিল। ওয়ার্নির সেই সামর্থ্য আছে আপনাকে সহজেই আউট করার, শুধু যে আপনি ভুল করলেই উইকেট পাবে সে এমন না। আমরা একে অপরের বিপক্ষে অনেকবার খেলেছি। যদিও কয়েকবার আমাকে আউট করেছে। আমি তাঁর বিপক্ষে খুব বেশি সফল হইনি। কিন্তু কখনোই মনে হয়নি তাঁর বিপক্ষে স্বস্তিতে আছি। আমি জানি আমাকে আউট করার মত কৌশল, দক্ষতা তাঁর আছে।

ওয়ার্নি টেস্ট ক্রিকেটের চিত্র বদলে দিয়েছে নিজের ব্যক্তিত্ব আর পারফরম্যান্স দিয়ে। নব্বইয়ের দশকে পেসারদের দাপট ছিল। ওয়ার্নি লেগ স্পিন ভেলকি দিয়ে স্পিনকে আরও আক্রমণাত্মক করেছিল। তাঁর আগে যে সেরা স্পিনার ছিল না এমন নয়, কিন্তু ওয়ার্নির বোলিংয়ে ক্রিকেট ভিন্ন মাত্রা পেয়েছিল। পেস বোলিং থেকে স্পিন বোলিং – সে টেস্ট ক্রিকেটে আবহ পরিবর্তন করে দিয়েছে। স্পিন বোলিং দিয়ে ম্যাচ জেতা যায়, এটার জন্য ওয়ার্নের চেয়ে ভাল উদাহরণ আর কিছু হতে পারে না। ম্যাগ্রা, গিলেস্পি, ব্রেট লিদের সাথে বোলিং বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। প্রশংসা করার মত এর চেয়ে বেশি কি থাকতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link