হাল ছেড়ো না বন্ধু

রেকর্ড সপ্তমবারের মতো মেয়েদের ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার মেয়েরা। সেমিফাইনালে তাঁদের দুই উদ্বোধনী ব্যাটার র‍্যাকেল হায়নেস ও অ্যালিসা হিলির অনবদ্য এক জুঁটি ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর ভিতটা গড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। দুইজনে মিলে দূর্গ গড়ে রান তোলেন ২১৬। অথচ বছর পাঁচেক আগেই এই দুইজন ছিলেন হারিয়ে যাওয়ার তালিকায়। আজ তাঁরা অস্ট্রেলিয়ার রেকর্ডের দিনের উজ্জ্বল নক্ষত্র।

২০১৭; এই সালটা এই দুইজন খেলোয়াড়ের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার একটি বছর। এই বছর থেকেই যেন হিলি এবং হায়নেস নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করতে শুরু করে। তাঁদের ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ হতে শুরু করে। যোগ হতে থাকে নানানরকম অর্জন। একটা ছন্দ ফিরে পেলেন, মন্থর ক্রিকেট ক্যারিয়ারটা একটু বেগবান হল। নিজেদের সামর্থ্যের প্রমাণ রাখা শুরু করলেন দু’জনেই।

এই যে ধরুণ অ্যালিসা হিলির কথা। ২০১০ সালে অভিষেক হয়েছিল তাঁর। দীর্ঘ প্রায় আট বছর যাত্রায় তিনি ছিলেন একেবারেই নিষ্প্রভ। নিজেকে মেলে ধরার সুযোগটুকু যেন পেতেন না তিনি। ব্যাট হাতে বাইশ গজে থিতু হওয়া তো দূরে থাক নির্দিষ্ট কোন ব্যাটিং পজিশনই ছিলনা তাঁর। তিন থেকে নয় সব ব্যাটিং পজিশনেই তিনি কোন না কোন সময় নেমেছিলেন। নিজের সামর্থ্য প্রমাণের বিন্দুমাত্র সুযোগ যেন ছিল না তাঁর।

একটা পরিসংখ্যান ঘেটে দেখলে বিষয়টা আরও বেশি পরিষ্কার হয়ে যাবে। ২০১৭ সালে বিশ্বকাপের আগে অবধি ৪১টি ওয়ানডে ইনিংস খেলেছিলেন হিলি। সে সময় তাঁর রান ছিল ৪৯৫। গড় ১৫.৯৬, স্ট্রাইকরেট ৯২.০০। মোটে দুইটি অর্ধশতক। তবে তিনি যে ছিলে প্রতিভাবান, কার্যকরী একজন ব্যাটার তাঁর পূর্ণ ব্যবহার তখনও করতে পারেনি অস্ট্রেলিয়া দল।

এরপর হঠাৎ করেই তাঁর সামনে নতুন দ্বার নিয়ে হাজির হলেন অস্ট্রেলিয়ার নারী দলের প্রধান কোচ ম্যাথু মট। তিনি তাঁর ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন করিয়ে দিলেন। ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়ানো হিলির জায়গা হল ওপেনিংয়ে। ব্যাস অন্য এক যাত্রার শুরু ঠিক সেখান থেকেই। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কারের শুরুও ঠিক সেখান থেকেই। নিজের সামর্থ্যের সবটুকু নিংড়ে দিতে শুরু করলেন হিলি। আবার তবে পরিসংখ্যানে ঢুঁ মারা যাক।

২০১৭ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ৪১টি ইনিংস খেলেছেন। এই সময়ে তিনি সেঞ্চুরি করেছেন চারটি। ২০২২ এর বিশ্বকাপের মঞ্চেই দূর্দান্ত এক সেঞ্চুরি করলেন। গড়টা হঠাৎ করেই এক লাফে প্রায় ছুঁয়েছে পঞ্চাশের ঘর। ১০০ পার করা স্ট্রাইকরেট হাফসেঞ্চুরি করেছেন ১৩টি। উত্থানের উপাখ্যান। অন্যদিকে র‍্যাকেল হায়নেসের গল্পটাও প্রায় একই রকম।

তাঁর গল্পেও ২০১৭ সালটার একটা প্রাধান্য কিংবা প্রভাব রয়েছে। বছরটা যেন এই দুই খেলোয়াড়ের জন্যে ক্রিকেট দেবতার এক আশীর্বাদ। এবারের বিশ্বকাপে হায়নেস দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ৮৫ রানের সুবাদে তাঁর রান এখন ৪২৯। ফাইনাল ম্যাচে তাঁর হাতে সুযোগ থাকছে এবারের আসরের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হওয়ার। তবে ঠিক এমনভাবেই চলছিল না তাঁর দিন। একটা পর্যায়ে তিনি পেশাদার ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার দ্বারপ্রান্তে ছিলেন।

আবার টেনে আনি পরিসংখ্যান। ২০১৭ সালের আগে হায়নেস অজিদের হয়ে খেলেছেন ২৮টি ইনিংস। এ সময় ছয়টা অর্ধশতকে তাঁর রান ছিল ৭৮২ রান। গড়টা ৩১.২৮। স্ট্রাইকরেট সত্তরের ঘরের শুরুর দিকে। মুদ্রার উল্টোপিঠ দেখতে শুরু করেন এরপর থেকেই। ২০১৭ সাল থেকে এখন অবধি ৪২টি ইনিংস ব্যাট করতে নেমেছেন র‍্যাকেল হায়নেস। তিনি দুইটি শতক হাঁকিয়েছেন, তাছাড়া ১২টি অর্ধশতক যুক্ত করেছেন তাঁর নামের পাশে।

গড় ৪৪.৪৮, স্ট্রাইকরেট প্রায় ৮১। কিন্তু ভাবুন তো সে ২০১৭ এর ঠিক আগে তিনি ক্রিকেটকে বিদায় নিয়ে নিতেন তবে কি আমরা এই বিশ্বকাপের মঞ্চে ২১৬ রানের এক অনবদ্য ইনিংসের দেখার পেতাম? নিশ্চয়ই পেতাম না। বিশ্বকাপের মঞ্চ, সেমিফাইনাল ম্যাচ। সেই ম্যাচে স্নায়ুচাপকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিব্বি রান করে গেলেন হিলি এবং হায়নেস জুঁটি।

মহাকাব্যিক এক জুঁটি গড়ে খানিক নিশ্চিত করেছিলেন নিজেদের ফাইনালের টিকিট। এই ফাঁকে টানা দুই ম্যাচে ম্যাচ সেরার পুরষ্কারটাও বাগিয়ে নিয়েছেন অ্যালিসা হিলি। জীবনে থেমে থাকতে হয়না। লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। ভাগ্য হয়ত একদিন বদল হবে। হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকার পথটা একদিন ঠিক খুঁজে নেয় আলোকচ্ছটা। হিলি হায়নেসের ক্রিকেট ক্যারিয়ার তো আমাদের সে শিক্ষাটাই দেয়। হাল ছেড়ো না বন্ধু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link